সম্পর্ক
– দেবস্মিতা ঘোষ
বারান্দায় বেরোতেই সোনালি রোদ্দুর আপ্যায়ন করল অরুনিমাকে। বাতাসে হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ। সাড়ে নটা মত বাজে। তমালের সাথে দশটা নাগাদ দেখা করার কথা। কিন্তু অটো করে যেতে যেতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। তার মানে আজ আবার লেট। বারান্দার একপাশে বসে অরুনিমার দাদা আকাশ এতক্ষণ বোনের চিন্তিত মুখের দিকেই তাকিয়েছিল।
‘’এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে লেট তো হবেই। বাইরের কলেজে পড়তে গিয়ে তোর অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে অরু।‘’ হাসতে হাসতে বলল আকাশ।
‘’মোটেই না, দিল্লিতে আমি প্রতিদিন সকাল সকাল উঠতাম। বাড়িতেই বরং তুই এত আদর যত্ন দিচ্ছিস যে আরামের ঘুম ভাঙতেই চাইছে না।‘’
‘’পরের মাস থেকে চাকরি শুরু তখন দেখবো এত আরাম কোথায় যায়। যাইহোক দু’ মিনিট দাড়া অজিত তোকে বাইকে ছেড়ে দিয়ে আসবে, আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবি। লেট হবি না।‘’
‘’ তুই বেস্ট দাদা’’ অরুনিমার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
আকাশ ওর থেকে আট বছরের বড়। অরুনিমার যখন তেরো বছর বয়স তখন ওর মা বাবা মারা যান। দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে ওদের গাড়ি খাদে পড়ে যায়। একুশ বছরের আকাশ কলেজের হস্টেল ছেড়ে চলে এসেছিল তার এক সপ্তাহের মধ্যে। টাকা পয়সার দিক থেকে ওদের কোনও অভাব ছিল না, আকাশের বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। মামার বাড়ির তরফ থেকেও অনেক সাহায্যের হাত এগিয়ে এসেছিল। অরুনিমার দাদু মারা যাবার আগেই আকাশকে পারিবারিক ব্যবসায় যথেষ্ট দক্ষ করে দিয়েছিলেন। কম বয়সে মা বাবা হারাবার ফলে ভাই বোনের বন্ধনটা খুবই শক্ত। বোনের পড়াশোনার সাথে কোনও আপোষ করেনি আকাশ। সর্বদা পাশে থেকেছে। স্বাধীনতা দিয়েছে। তাই অরুনিমা দিল্লির কলেজে সুযোগ পাওয়ার পর ওকে একবারও আটকায়নি। আর বোনের চাকরির খবর পেয়ে অরুনিমার থেকেও বেশি খুশি হয়েছিল ও। এই দাদা বোনের চলার পথে আকাশের ছোট বেলার বন্ধু অজিতও এক সহযাত্রী। সবসময় আকাশকে মনের জোর জুগিয়েছে। দরকারে অদরকারে অরুনিমার পাশে থেকেছে।
অজিতকে বাইক নিয়ে আসতে দেখে অরুনিমা প্রায় দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ল।
‘’অমালের সাথে দেখা করার এত যখন তাড়া, তো দেরি করিস কেন বলত?’’ স্টার্ট দিল ও।
‘’জানি তো তোমরা কেউ একটা দিয়ে আসবে ঠিক’’ অরুনিমা উত্তর দিল।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেল ওরা। বাইক থেকে নামতেই অজিত বলল, ’’দাঁড়া অরু, কথা আছে।‘’
অরুনিমা ঘুরে দাঁড়াল। ‘’আমি জানি অজিতদা তুমি কি বলবে’’
‘’জানারই কথা। আমি জানি না তোর দাদা তোকে কি বলেছে না বলেছে। কিন্তু আমি তোকে বলতে পারি, তোর ভালোর জন্য আমি আর আকাশ সব সহ্য করতে পারি। কিন্তু আমাদের জন্য তোকে অখুশি দেখতে পারবো না। তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি সবসময় তোর পাশে থাকবো, সে কাছে থেকে হোক বা দুরে থেকে। সেটা বড় কথা নয়। তমালকে তুই কতটা ভালবাসিস আমি জানি। আকাশও জানে। তাই বলছি…’’ অজিত থামল।
অজিতের গম্ভীর মুখ দেখে অরুনিমা হেসে ফেললো,’’আমি যা করছি তা নিজের জন্য। তোমাদের জন্য নিজের ক্ষতি করছি এরকম ভেবো না। বাড়ি যাও। ফেরার সময় ফোন করবো চলে এস। দাদা বাড়িতে আছে। পারলে প্ল্যানগুলো করে ফেল। আমি যাই।‘’ ও এগিয়ে গেল তমালের দিকে। তমাল এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে ওকে।
যেতেই গোলাপটা এগিয়ে দিল তমাল। পার্কের বেঞ্চে বসল দুজন। রবিবার হলেও এইসময়ে পার্কটা খালিই আছে।
‘’দিল্লি থেকে এসেছিস তো এক সপ্তাহ আগে। সবে দেখা করার সময় হলো’’ তমাল নিস্তব্ধতা ভাঙলো।
‘’বাড়িতে কিছু কাজ ছিল।‘’ অরুনিমা চুপ করে গেল। ভেবে এসেছিল অনেক কথা বলবে। কিভাবে শুরু করবে গুছিয়ে নিতে ওর একটু সময় লাগবে। অরুনিমাকে চুপচাপ বসে গোলাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে তমাল মুখ খুললো,’’ তুই কি কিছু বলবি না! সারাদিন চুপ করে বসে থাকবি?”
‘’দেখ তমাল এড়িয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই। আজ না হোক কাল এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতেই হবে। পরের মাস থেকে আমি চাকরিতে জয়েন করছি তো তার আগেই আমি চাই ওদের বিয়েটা হয়ে যাক’’
‘’বিয়ে, অরু তুই কি পাগল হয়ে গেছিস। রুল হয়েছে, ওরা স্বাভাবিক সব মানছি কিন্তু বিয়েটা বাড়াবাড়ি নয় কি…বিয়ে না করেও তো থাকা যায়’’ তমালের গলায় অবিশ্বাসের সুর।
‘’তুই পারবি বিয়ে না করে আলাদা থেকে জীবন কাটাতে’’
‘’আমাদের ব্যাপারটা আলাদা অরুনিমা। তুই একবার আমাদের কথাটা ভাব, আমার বাড়ির লোক কখনই মেনে নেবে না ওদের ব্যাপারটা।‘’ তমাল বলল।
‘’এখানেই সমস্যা, ওরা আমাদের থেকে আলাদা নয়।:তুই আমাকে যতটা ভালবাসিস, অজিতদা আমার দাদাকেও ঠিক ততটাই ভালবাসে। ওরা কোনও অংশে কম না। আমি মানছি তোর বাড়ির ব্যাপারটা, কিন্তু তুই ভেবে দেখ ওরাই আমার পরিবার। ওদের জন্যেই আমি আজ এখানে আছি। তুই তো সবই জানিস।‘’ অরুনিমা চেষ্টা করলো নিজেকে শক্ত করতে।
‘’কিন্তু এর সমাধানও আছে, ওরা তো অন্য কোথায় চলে যেতে পারে। আমার ফ্যামিলি না জানলেই হবে। তুই নয় মাঝেমাঝে দেখা করে আসবি। ‘’ তমাল জেদের সাথে বললো।
‘’আমি পারব না তমাল। ওদের কেন পালিয়ে, লুকিয়ে বাঁচতে হবে। ওরা সম্মান নিয়ে বাঁচবে। আরও বাকি সবাইয়ের মত।‘’ অরুনিমা আপোষ করতে রাজি না।
‘’তুই জানিস আমি তোকে ভালবাসি অরু, কিন্তু আমার পরিবার কখনোই তোর দাদার ব্যপারে জানার পর তোকে মেনে নেবে না। নিয়ম হয়েছে, সমাজ আধুনিক হয়েছে সব কথাগুলো সিনেমাতেই মানায়। আসল পরিস্থিতিটা তুইও জানিস আমিও জানি। সেটাকে অস্বীকার করার প্রশ্ন আসে না।‘’ তমাল হাল ছেড়ে দিতে নারাজ।
‘’পরিবর্তন তো আর একদিনে আসে না। আমি বেশি বুঝি না। আমার খারাপ সময়ে ওরাই আমার পাশে ছিল। ওরা আমার জন্য সব করেছে তাই আজ ওরাই আমার সমাজ। আমি আর কারুর কথা ভেবে ওদের ভালবাসাকে নষ্ট হতে দেবো না। এইটাই আমার সিদ্ধান্ত। আজকের পর থেকে আমাদের আর দেখা হবে না। ক্ষমা করে দিস তমাল।‘’ গোলাপটা তমালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অরুনিমা উঠে এল।
পার্ক থেকে বেরিয়ে ও আকাশ আর অজিত দুজনকেই দেখতে পেল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দুজনেই আন্দাজ করে নিল কি ঘটেছে। নিজের অজান্তেই অরুনিমার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। অজিত রুমাল এগিয়ে দিয়ে বলল, ’’এই নে, রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করলে লোকে ভাববে আমরা তোকে কিডন্যাপ করছি’’
আকাশ বলল, ’’এসবের দরকার কি ছিল অরু। অজিত আর আমি নয় চলে যেতাম কোনও জায়গায়। আমাদের লড়াইটা পুরো সমাজের বিরুদ্ধে, এতে তোকে জড়াতে চাইনি আমি।”
‘’ না দাদা। যেদিন থেকে তুই আমাকে তোদের ভালোবাসার কথা বলেছিস সেদিন থেকেই আমি ঠিক করেছি তোরা আর সাধারণ লোকের মতই থাকবি। তোদের ভালবাসাও প্রতিষ্ঠা পাবে। আমিও থাকবো তোদের পাশে। আর এরকম ছেলে তো নিশ্চয়ই আছে যে ভালোবাসাকে মন দিয়ে যাচাই করে শরীর দিয়ে না। তাই আমার জন্য ভাবিস না।‘’ হাসি মুখে আকাশের দিকে তাকাল অরুনিমা।
‘’এবার তোরা বাড়ি চল, সামনে একটা বিয়ে বাড়ি। তোড়জোড় করতে হবে তো নাকি!’’ অজিত বললো।
‘’তোর শুধু বিয়ের জন্য তাড়া’’ আকাশ হাসতে হাসতে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল।