গল্প- সেরা বিদূষক

সেরা বিদূষক
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

 

পর্ব- এক

সম্রাট আকবর যদি একবিংশ শতাব্দীতে রাজত্ব করতেন তাহলে তার রাজসভার পরিবেশ এই রকম হতো…

সম্রাট আকবরের রাজসভা। সকাল পৌনে দশটা। ঝাড়ু, পোছা মোটামুটি কমপ্লিট। রুম ফ্রেশনারের গন্ধে ভরে উঠেছে রাজসভা। বিয়াল্লিশ ইঞ্চি স্মার্ট টিভিতে চলছে ডিসকভারি চ্যানেলটা।সভাসদরা একে একে আসতে শুরু করে দিয়েছেন। প্রত্যেকেরই হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং সম্রাট। আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। সম্রাট আকবরের নব রত্নের আট রত্ন ইতিমধ্যে সভা কক্ষে প্রবেশ করেছেন। বাকি কেবল মাত্র বীরবল। সম্রাট আকবর স্বয়ং তাকে ছুটি দিয়েছেন আজকের দিনটার জন্য। বীরবলকে বাদ দিয়েই গ্ৰহণ করা হবে এক বিরাট সিদ্ধান্ত।

কাঁটায় কাঁটায় দশটা। দ্বাররক্ষীর আওয়াজ ভেসে এলো প্রত্যেক সভাসদের কানে। ‘শাহেন শাহ ,মুঘল ই আজম, বাদশা আকবর রাজসভায় পদার্পন করছেন।’ সকলে নিজ নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাদশাকে সম্মান জানালেন। বাদশা সিংহাসনে বসলেন চিন্তিত মুখে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দাসীটি বাতাস করতে শুরু করলে বাদশা বিরক্ত হয়ে বললেন- ‘এসি অন আছে। তাতেও বাতাস! যত সব।’ আসলে সম্রাট নিজের মানসিক চাপটা বেচারা দাসীর ওপর দিয়ে দিলেন। থমথমে পরিবেশ। হঠাৎ নাসিকা গর্জনে নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ হলো। টোডরমল বেচারা গরম ভাত খেয়ে এসে এসির ঠান্ডা হাওয়া, শান্ত পরিবেশ পেয়ে ভাত ঘুম আর কন্ট্রোল করতে পারে নি। তবে ভালোই হলো নাক ডাকার আওয়াজে বাদশার মুখে কিঞ্চিত হাসি ফুটলো।

এবার বাদশা আকবর বলে উঠলেন, ‘আমার প্রিয় সভাসদ, তোমরা সকলেই জানো বীরবল হচ্ছেন আমার রাজত্ব কালের বিশ্বের সেরা বীদূষক। কিন্তু বাংলার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও আরবদেশের সুলতান একথা মানতে রাজি নন। তেনারা জানিয়েছেন তাদের রাজসভাতেও গোপাল ভাঁড় ও মোল্লা নাসিরউদ্দিন নামক দুই সেরা বিদূষক উপস্থিত। তাই আমি আপনাদের সকলকে নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে চাই যে এনাদের তিনজনকে একসাথে বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আপনারা সকলে রাজী থাকলে আগামী তেরোই পৌষ মহা হাস্যরসের মেলার দিন ধার্য করা হোক।’ কারোর যদি কোনো যুক্তিপূর্ণ মতামত থাকে তাহলে এই সভাতেই ব্যক্ত করার অনুমতিও সম্রাট দিলেন। সম্রাটের বিরোধীতা করে কে নিজের বিপদ নিজের দিকে ডেকে আনবে! তাই সকল একসাথে বলে উঠল ‘আপনার সিদ্ধান্তই ধার্য হোক হুজুর।’

পর্ব- দুই

দিল্লির দরবার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজটা পেয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তো বিশ্বাস করতে পারছে না। চার পাঁচ বার ম্যাসেজটা পড়ার পর হঠাৎই চিৎকার করে ওঠেন ‘রানী ও রানী কোথায় গেলে সব। বাদশা আকবর যে এমন ভাবে চ্যালেঞ্জটা গ্ৰহণ করবে একদম বুঝতে পারি নি। ‘রানী সবে মাত্র পূজা সেরে উঠেছেন। মহারাজের কথার আদি অন্ত না জেনেও প্রসাদের থালাখানি দু’দুবার নিজের মাথায় ঠেকিয়ে নিলেন। মহারাজের হাতে সামান্য ফল প্রসাদ তুলে দিয়ে রানী সোহাগের সুরে বললেন ‘ভগবান আছেন গো। ভগবান আছেন। তা শুনি নদীয়ার মহারাজ মুঘল সম্রাট আকবরকে কী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল?’

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তার গোঁফে প্যাঁচ দিতে দিতে বললেন ‘বড্ড অহংকার! বীরবল ছাড়া আর কেউ নেই যেন।’ এবার রানী সামান্য বিরক্তির সুরে বললো এত গৌরচন্দ্রিকা না করে আসল কথাটা পরিবেশন করলে ভালো হয়। মহারাজ আবার শুরু করলেন ‘বাবা বাঙালির বুদ্ধি। গায়ের জোর একটু কম আছে তো কী হয়েছে। এবার বাদশা টের পাবেন টক্কর কাকে বলে।’ রানীও ভিতরে ভিতরে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছেন। তিনি এবার বিরক্তির সুরটা বদলে মহারাজের গলাটি জড়িয়ে ধরে আদর মাখা কন্ঠে বলে ‘প্রভু অনেক হয়েছে। আমার আর ধৈর্য্য নেই। প্লিজ বলুন।’ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রানীর চিবুকে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বলে ‘মহা হাস্যরসের মেলা অনুষ্ঠিত হবে খোদ দিল্লিতে। তারই আমন্ত্রণ পত্র। বাদশা নিজে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছেন। অফিসিয়ালি লেটারটা ফ্যাক্স করে দেবেন বলেছেন।’ সে সব তো বোঝা গেল কিন্তু চ্যালেঞ্জটা কিসের তা এখনও পরিষ্কার হল না। মহারাজ দু’ কদম নেচে বললেন ‘মহা হাস্যরসের মেলাতে বীরবল আর আমাদের গোপাল এবার সামনাসামনি লড়বে।গোপাল ভাঁড় যে আমার রাজত্ব কালের সেরা বিদূষক সেটাই আমি আকবরকে জানিয়ে ছিলাম। আরো বলেছিলাম শুধুমাত্র বাংলাদেশের সেরা বিদূষক তা নয় গোটা পৃথিবীতে গোপালের মতো উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন লোক পাওয়া মুশকিল। আর এতেই মহারাজের আঁতে ঘা লাগে।’

রানী মুখে এক খিলি পান ঢুকিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে ‘মহারাজ গোপাল এই সব কান্ডকারখানা জানে তো?’ না রানী, এখনও জানে না। অফিসিয়াল লেটারটা হাতে পেলেই জানাবো তাকে। বেলা এগারোটার মধ্যে ফ্যাক্স এসে হাজির। রাজা মন্ত্রীকে আদেশ দিলেন গোপাল ভাঁড়কে খবর পাঠাও। ঘন্টা খানেকের মধ্যে যেন রাজসভাতে হাজির হয়। মন্ত্রী বিনা বাক্যব্যয়ে গোপাল ভাঁড়ের কাছে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।

পর্ব- তিন

মন্ত্রীর আদেশে একজন সিপাই ছুটে গেল গোপাল ভাঁড়ের বাড়িতে। গোপাল প্রত্যহ সকালে তার সখের বাগানটাকে পরিচর্যা করে। কখনও ঘাস তুলে, কখনও মাটি কুপিয়ে। গাছের গায়ে একটা দু’টো পোকামাকড় দেখলেই ছোটে কীটনাশক স্প্রে করে। আসলে গোপালের কাছে তার বাগানটা সন্তান তুল্য। গোপাল ভাঁড়ের মেয়ে একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করে ‘বাবা তুমি দিনরাত বাগান বাগান করে কী পাও বলতো’। গোপাল তাকে বলেছিল যদি কোন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তাৎক্ষণিক আনন্দ পেতে চায় তাহলে তাকে শূকর মারতে হবে। আর যদি কেউ একবছরের জন্য আনন্দ পেতে চায় তাহলে তাকে বিয়ে করতে হবে। আর যদি কেউ সারাজীবনের জন্য আনন্দ পেতে চায় তাহলে তাকে বাগান করতে হবে। গোপালের মেয়ে সেদিন বাবার কথায় ভীষণ সন্তুষ্ট হয়েছিল।

বাগান থেকে ফিরে হাত পা ধুয়ে সবে মাত্র সিলিং ফ্যানটা চালিয়ে একটু আরাম করে ঘরের মেঝেতে শুয়েছে হঠাৎ কে যেন তার নাম ধরে লাগলো। ‘গোপালদা ও গোপালদা’। অগ্যতা তার স্থূলকায়, নধর শরীরটিকে মেঝে থেকে উঠিয়ে জানালায় উঁকি মেরে দেখে রাজার সিপাই। তাড়াতাড়ি করে আলনা থেকে একটা পেটিকোটকে গামছা ভেবে নিজের কাঁধে ফেলে সদর দরজা খুলতে ছোটে। গোপালকে দেখা মাত্রই সিপাইটি তো ফিক করে হেসে ফেলে।তারপর নিজেকে সংযত করে বলে ‘মন্ত্রী মশায়ের আদেশ এক্ষুণি মহারাজের সঙ্গে দেখা করুন। তবে অবশ্যই সঠিক পোশাক পরিধান করে রাজসভাতে হাজির হবেন।’
সিপাইয়ের শেষ কথাটা শুনে গোপাল ভাঁড় কেমন যেন চিন্তিত হয়ে পড়লো। সে তো সঠিক পোশাক পরিচ্ছদই পরে। তাহলে…..

বাড়ি ভিতর থেকে গোপালের গিন্নীর আওয়াজ ভেসে এলো। ‘স্নান করতে যাওয়ার আগে আলনায় কাচা পেটিকোটটা রেখে গেলাম এখন আর পাচ্ছি না। শুনছো তুমি গেলে কোথায়?’ গিন্নীর আওয়াজ শুনে গোপাল তার চিন্তাকে ত্যাগ দিয়ে ভিতরে আসা মাত্রই গোপালের গিন্নী বলে ওঠে ‘হ্যাঁ গা, তুমি আমার পেটিকোট কাঁধে নিয়ে ঘুরছো কেন?’ ‘পেটিকোট! তৎক্ষনাৎ গোপাল ভাঁড় কাঁধ থেকে পেটিকোট নামিয়ে বলে- ওওওওওও। তাই সিপাই আমাকে সঠিক পরিচ্ছদের কথা বলে গেল। ব্যাটা বড্ড পাজি। ভুলটা না ধরিয়ে পালালো।’ গোপাল এক মুখ হাসি দিয়ে বলে ‘নাও নাও। তোমার জিনিস তুমিই নাও। আমি এক্ষুণি রাজবাড়ী যাবো। ফিরতে দেরি হলে বারবার মিসডকল দিও না। আর না খেয়ে বসে থেকো না।’ এই বলে গোপাল ধুতি আর ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে একখানা গামছার খোঁজ করতে লাগলো। গোপালের গিন্নী বলে-
‘রাজবাড়ী যাবে তাতে গামছা কী কাজে লাগবে?’
-‘আরে, আজ রোদটা দেখেছো?কেশহীন মাথাটা তো ঢাকতে হবে।’ এবার গোপালের গিন্নী ঝাঁঝিয়ে বলে ‘তোমার কি আক্কেল জ্ঞান কোন দিন হবে না। তুমি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেরা বিদূষক। তোমার একটা পরিচিতি আছে। আর ছেলে মেয়েরা এখন বড়ো হয়েছে। তোমার চালচলনের জন্য ওদেরকে কম হেনস্থা হতে হয় না বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে। ঘরে কি ছাতা নেই!’

গোপাল ভাঁড় মুচকি হেসে বলে, ‘তাই বলো। আমার শরীরের থেকে তোমার তো প্রেস্টিজের চিন্তা বেশি দেখছি। ঠিক আছে তোমার জন্য ছত্রধর হতেও রাজি আমি।’ ছাতা মাথায় দিয়ে গুটিগুটি পায়ে রাজসভায় এসে হাজির গোপাল ভাঁড়। গোপালকে দেখা মাত্রই সভাকবি ভারতচন্দ্র ছুটে আসে। তাকে আলিঙ্গন করে বলে ‘গর্বিত ভীষণ গর্বিত। আমরা সকলে।’ রাজজ্যোতিষী অনুকূল বাচষ্পতিও এগিয়ে এসে গোপালের কপালের দিকে তাকিয়ে বলে ‘জয় টিকা জ্বলজ্বল করছে।’ গোপাল এবার মহারাজের সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যায়। মহারাজ ফ্যাক্স বার্তাটি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ ধরে গোপালের জন্য। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বলেন ‘এসো গোপাল। গ্ৰহণ করো আমন্ত্রণ পত্র। খোদ মুঘল সম্রাট আকবর তোমাকে পাঠিয়েছেন।’

গোপাল ভাঁড়ের তো বিষ্ময় বেড়েই চলেছে। হাতজোড় করে সে বলে ‘মহারাজ একটু পরিষ্কার করে ও বিস্তারিত বলুন আমাকে।আসল ব্যাপারটা কি?’ মহারাজ গদগদ কন্ঠে বলে, ‘গোপাল তোমার হাতে বাংলাদেশের মান সম্মান। বীরবলের সাথে তোমায় হাসির যুদ্ধে জয় লাভ করতে হবে’। এরপর এক এক করে আকবর ও কৃষ্ণচন্দ্রের সমস্ত কথোপকথন গোপালকে জানালেন স্বয়ং মহারাজ নিজে। এইসব কথা শুনে তো গোপাল ভাঁড়ের মুখ শুকিয়ে চুন।

পর্ব- চার

গোপালের মুখ দেখে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন বলে উঠলেন ‘সবই মায়ের ইচ্ছা।’ গোপাল মহারাজকে নমষ্কার করে বিনম্র ভাবে বলে ‘মহারাজ আমি হচ্ছি বাঁশ বাগানে শিয়াল রাজা। বীরবলের মতো ক্ষুরধার ব্যক্তির সাথে কী এঁটে উঠতো পারবো? তার ওপর হিন্দিটা বুঝতে পারলেও বলতে পারি না ঠিকমত। আমার জয় পরাজয় নিয়ে মাথা ঘামাই না। কিন্তু আপনার মান সম্মানের যদি হানি হয় এই ভেবেই শঙ্কিত আমি।’

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে উৎসাহিত করার জন্য বলেন ‘কোনো চিন্তা করো না। আগে তো ময়দানে নামো। তুমি কোনো চিন্তা করো না ভাষাটা নিয়ে।আমি একজন ভালো ইন্টারপ্রেটার এর ব্যবস্থা করছি।’ সুতরাং গোপাল ভাঁড়য়ের দিল্লি যাওয়া পাকা। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সমস্ত বন্দোবস্ত নিজ তদারকিতে করতে লাগলেন।

ভিনদেশে গিয়ে গোপালের খাওয়া দাওয়ার কষ্ট যেন না হয়। মুড়ি তিন-চার বস্তা, নারকেল নাড়ু, নিমকি, গজা ইত্যাদি দু’টিন মতো। গোটা নারকেল ছয়-সাতটা। আরো কিছু দরকার কিনা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বারংবার গোপাল ভাঁড়ের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন। এতসব বন্দোবস্তের পরেও গোপালের গিন্নীর মুখে হাসি নেই। সে গোপালকে বারবার বলতে লাগলো ‘তুমি দিল্লি চলে গেলে আমি একা সংসার সামলাই কি করে বলতো? ছেলের ইজ্ঞিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল পরীক্ষা, মেয়ের ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের লাস্ট ইয়ার। ওগো, তুমি নাইবা গেলে।’ কিন্তু গোপালের জীবনের এমন অমূল্য সুযোগ গোপাল হাতছাড়া করতে চায় না। বাংলা ছেড়ে দিল্লির দরবারে গিয়ে বাদশা আকবরের মনোরঞ্জন করতে পারলে তো আর কোন চিন্তাই থাকবে না। গোপাল ভাঁড় তার গিন্নীকে বলে, ‘গিন্নী শক্ত হও। তুমি চাও না তোমার স্বামীর নাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক। তুমি একজন নামকরা সেলিব্রেটির বউ হবে গো বউ!’

আবার অন্যদিকে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের জয় লাভের জন্য মসজিদে মসজিদে নামাজ পাঠ জোর কদমে চলতে লাগল আরব দেশে। নাসির তার বিবিকে বললেন ‘আমি যতদিন না দিল্লি থেকে ফিরছি আমার খচ্চরটার দিকে একটু খেয়াল রেখো। তুমি তো টিভির রিয়েলিটি শো নিয়ে মশগুল থাকবে, বেচারার সঙ্গী বলতে তো এই অধম।’ নাসিরের বিবি ঠাট্টা করে বলে, ‘সুদূর দিল্লিতে গিয়ে আমাকে মনে পড়বে কিনা বলা মুশকিল, তবে এই চারপেয়েটা তোমায় বড় অস্থির করবে মালিক।’ নাসিরও রসিকতা করে বলে ‘বিবিজান, শুনেছি বাদশা আকবরের পরমা সুন্দরী সব বেগম আছে। যদি তাদের সান্নিধ্য একটু আধটু পাই তাহলে ত্রিভুবনের আর কোন কিছুই আমায় অস্থির করে তুলবে না।’ নাসিরের বেগম চোখ গোল গোল করে বলে উঠলো ‘কী?’ এই আওয়াজেই নাসির আপাতত রসিকতা বন্ধ করে প্যাকিংয়ে মনোনিবেশ করে।

সুলতান বারবার নাসিরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভূ-ভারতের আবহাওয়া, খাওয়া দাওয়া আর চাল-চলনের কথা। ভারতীয়রা বড্ড বেশি আন্তরিক। ওদের আন্তরিকতায় নিজেদের ক্লাস ভুললে চলবে না। নাসির উদ্দিন সুলতানকে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, ‘সুলতান যতই আমরা তেল বিক্রি করি, তবে তেল লাগানো আমাদের স্বভাব নয়।’

পর্ব-পাঁচ

সম্রাট আকবর স্বয়ং গিয়ে বীরবলকে ‘মহা হাস্যরসের মেলার’ খবরটা দিয়ে এলেন। বীরবল কিছু প্রশ্ন করার আগেই বাদশা আকবর বলে উঠলেন ‘বীরবল আমার রাজত্বের মান সম্মান তোমার হাতে।’ বীরবল অভ্যাসবশত ‘জো আজ্ঞা বাদশাহ’ বলে উঠলো। বাদশা চলে যাওয়ার পর বীরবল মহা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। নাসির উদ্দিন, গোপাল ভাঁড় দুজনেই সাংঘাতিক উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি। তাদেরকে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে হারানো সোজা তো নয়ই বরং নিজের মান সম্মান অনেক খানি ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু বাদশা আকবরের হুকুম তামিল করতেই হবে। বীরবল তার পত্নীকে বললো ‘তোমার স্বামীর অগ্নিপরীক্ষার দিন ধার্য হয়েছে। বীরবলের স্ত্রী সদাহাস্য মুখে বলল ‘দ্বিতীয় বার অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে দেখো কি মেলে?’ বীরবল হাসতে হাসতে বললো ‘প্রথম বার তো আগুনের গোলা মিলেছে। এবার তাহলে মিলবে ছাই।’ যাই হোক প্রানেশ্বরী এবার হাসির যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।’

১০ই পৌষ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন কলকাতা বিমানবন্দরে। এই প্রথম জীবনে গোপাল হাওয়াই জাহাজে চড়বে। একটু ভয় ভয় লাগছে গোপালের। মহারাজ নানান ধরনের টিপস দিতে ব্যস্ত গোপাল ভাঁড়কে। যাই হোক গোপাল ভাঁড় চেকিং করার জন্য এয়ারপোর্টয়ের ভিতরে চলে এসেছে। ওদিক থেকে নাসির উদ্দিন ও কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করে গেছেন এবং দিল্লিগামী উড়ানের জন্য অপেক্ষা করছে। ভিজিটর লঞ্জ-এ গোপাল ও নাসির উদ্দিন পাশাপাশি বসে কিন্তু পরিচয় না থাকার দরুণ দুজনেই চুপচাপ। হঠাৎ একটি সুন্দরী ক্রু এসে বললো ‘নাসির জী আপনার ফ্লাইটয়ের সময় হয়ে এসেছে আপনি আসুন।’ গোপাল সাত তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করল ‘বোনটি দিল্লিগামী হাওয়াই জাহাজটি কখন ছাড়বে বলতে পারবেন!’
ক্রুটি হাস্য মুখে বলে ‘আপনি কি স্যার গোপাল ভাঁড়? তাহলে আমার সঙ্গে আসুন।’

সুন্দরী ক্রুটির হাইট হবে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি, গায়ের রং গমের মতো, ওজন হবে চল্লিশ কেজির মতো। আসলে পাতলা লিগলিগে কোমড় দেখে গোপাল ভাঁড় নিজেই আন্দাজ করে নিলেন ওজনটা। অত্যন্ত চড়া মেকআপে যাকে বলে অসাধারণ!
গোপাল মনে মনে বলে উঠলো ‘বঙ্গ ললনাদের সৌন্দর্য তো আজকাল অনেক খানি বদলে গেছে। এই পাট কাঠির মতো মেয়েগুলো হচ্ছে এখন সুন্দরী!

নাসির উদ্দিন নিজেই গোপাল ভাঁড়ের সাথে আলাপ শুরু করলেন হিন্দিতে ‘নমস্তে জী।আপকে বারে মে ম্যায় নে বহুত শুনা। ম্যায় নাসির উদ্দিন সাহাব হু’। গোপাল ভাঁড় হিন্দিটা ভালো ভাবে বলতে না পারলেও বুঝতে পারতো খুব ভালো। গোপাল ভাঁড় নাসির উদ্দিনকে বললো ‘ম্যায় বহুত ভাগ্যবান হু। মুছে আপকে সাথ হাসি কি জং লড়তে হবে।’ নাসির উদ্দিন জবাব দিল ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সহি বাত।’

পর্ব -ছয়

দিল্লি এয়ারপোর্টে হাওয়াই জাহাজ ল্যান্ড করতেই বাদশা আকবরের লোকজন নাসির উদ্দিন ও গোপাল ভাঁড়কে অভ্যর্থনার জন্য উপস্থিত। অতিথির অভ্যর্থনাই যখন এত জাঁক জমক পূর্ণ তখন অতিথি সৎকার না জানি কি হবে!

গোপাল ভাঁড় ও নাসির উদ্দিনকে বাদশার খাস গেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হলো। গোপাল ভাঁড়ের বিপুল পরিমাণ ল্যাগেজ দেখে নাসির উদ্দিন রসিকতা করে বলে ‘ইতনা সারে সামান? পুরা দিল্লিওয়ালা কা হ্যায় ক্যায়া।’ গোপাল লাজুক মুখে বলে ‘বাঙ্গালী লোক কা খানা দিল্লি মে ক্যাহা মিলতা হ্যা। ইস লিয়ে মহারাজ বন্দোবস্ত কিয়া হ্যায়। আপ লোক কা পাশ এ খানা হ্যায় কিন্তু মেরে লিয়ে এ মহারাজ কা আশীর্বাদ হ্যায়।’ নাসিরজী একটু হেসে বললো ‘সহি বোলা আপ নে। আপনো যব কুছ দেতা হ্যায় উসমে বহুত সারে প্যায়ার হোতা হ্যায়। পয়সা ফেকনে সে কোই ভি খানা মিল সাকতে হ্যায়। পর প্যায়ার নেহি।’

কিছুক্ষণ পর একজন হোটেলের কর্মচারী এসে জানিয়ে গেল আজ বিকালে স্বয়ং বাদশা আকবর আসবেন দেখা করতে। কাল সকাল এগারোটা নাগাদ হাসির মহারণ শুরু হবে। এই উপলক্ষ্যে লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত হবে ‘মহা হাস্যরসের মেলা’। প্রায় এক সপ্তাহ চলবে। অগ্ৰিম টিকিট বুকিংও শুরু হয়ে গেছে। অসম্ভব সুন্দর সাজানো হয়েছে হাসির মঞ্চকে। লাইভ টেলিকাস্ট করবে ডি ডি ন্যাশনাল। আকবরের সভাসদ ছাড়াও আমন্ত্রিত হয়েছেন বহু জ্ঞানী গুণী ও সম্মানীয় ব্যক্তিরা।

ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সকাল এগারোটা। লাল কেল্লায় নিজ সিংহাসনে বিরাজমান আকবর। টোডরমল একবার পুরো মেলা প্রাঙ্গণ থেকে ঘুরে এসে নিজ আসন সংগ্ৰহ করল। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ। এতো খরচা না করলেও চলতো বাদশার। আসলে বীরবলকে নিয়ে বাদশা আকবরের বাড়াবাড়িটা টোডরমলের পচ্ছন্দ নয়। সেবার টোডরমল সভাসদের মাইনে বাড়ানোর কথা বলতেই তো বাদশা ধমক দিয়ে উঠেছিলেন- ‘সবই তো সরকারি খাজানা থেকে মিটছে তোমাদের। তারপরও মাইনে বাড়াতে হবে। বলি তোমরা তো সরকারি চাকুরে। সরকারের কথা যদি তোমরা না ভাবো তাহলে কি বেসরকারি কর্মীরা ভাববে। মাইনে কাটা বা না পাওয়ার ফালতু চাপ কি জিনিষ তা তো তোমরা জানলে না।’

ঢং ঢং করে বেজে উঠল ডঙ্কা। চারিদিকে ছেয়ে গেল নীরবতা। প্রতিটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে মঞ্চে সবার প্রথম কে উঠবে এই কৌতহল নিয়ে। গোপাল ভাঁড়, নাসির উদ্দিন এদের নাম সকলে জানলেও এদেরকে এতো কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য এতকাল দিল্লিবাসীর হয়নি।

সবার প্রথম মঞ্চে এলেন নাসির উদ্দিন। বাদশা আকবর এবং সমবেত দর্শক দের কুর্নিশ জানালেন এইভাবে..
‘অধমের নাম নাসির উদ্দিন
আকবরের সাক্ষাৎ পাওয়ার
ইচ্ছা ছিল বহুদিন
অবশেষে সে সাধ মিটিল
কিন্তু ভাবি নি
পরিস্থিতি হবে এমন জটিল
হাসানো আমার পেশা ও নেশা
প্রচুর প্রচুর আনন্দ দেবো
এটাই আমার একমাত্র আশা।’

হাততালিতে ভরে উঠেছে লালকেল্লা। সকলের মুখে একটাই কথা কী আলাপের ভঙ্গিমা। একজন সুন্দরী সঞ্চালিকা মঞ্চে উঠে জানালেন এবার আপনাদের সামনে আসছেন সকলের প্রিয় গোপাল ভাঁড়।

পর্ব- সাত

আজকের এই বিশেষ দিনেও গোপালের পোশাক পরিচ্ছদ কিছুই পাল্টায় নি। সেই পরিচিত ফতুয়া আর ধুতি। আসলে এই পোশাকটির মধ্যে দিয়ে গোপাল মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজকে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। যদিও একবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পোশাক পরিচ্ছদ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। সদা হাস্য মুখে গোপাল ভাঁড় মঞ্চে উঠলেন সঙ্গে তার ইন্টারপ্রেটার।

গোপাল ভাঁড় তার নিজের আলাপ পরিচয় এই ভাবে শুরু করলেন –
‘ছোট খাটো কলেবর
আমার নাম গোপাল ভাঁড়।
বাংলার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সম্মান
আমার হাতে আজকাল।
দিল্লির বাদশার অতিথি পরায়নে
যারপর নাই খুশি
হাসিয়ে হাসিয়ে মারবো পেটে
সকলকে ঘুঁষি।
এবার আমি নিজের জায়গায়
গিয়ে বাবা বসি।’

গোপাল ভাঁড়ের এই আলাপের ভঙ্গিমাতে প্রথমেই উপস্থিত দর্শকবৃন্দ হেসে খুন। তারা গোপাল ভাঁড়কে এতো সহজে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে দেবে না। দর্শকদের অনুরোধে গোপাল ভাঁড় তাদের সঙ্গে একটা তার নিজস্ব বিচিত্র অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাইলো।

গোপালের এক অবাঙালি বন্ধু ছিল। বন্ধুটি দীর্ঘ দিন কলকাতায় থাকার সুবাদে বাংলা ভাষাটা ভালো শিখে গিয়েছিল। বন্ধুর স্ত্রী হরিয়ানা থেকে মাঝে মধ্যে স্বামীর কাছে আসতো এবং তখন গোপালের বাড়িতেও বেশ কিছু দিন থেকে যেতো। গোপালের গিন্নীর সাথে তার যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক ও জন্মায়। সেই সময় গোপাল ভাঁড় তার কলা গাছ থেকে একটা কলার মোচা পেরে এনে গিন্নীকে বলে ‘জমিয়ে কুঁচো চিংড়ি মাছ দিয়ে আজ মোচাটা রান্না করো কিন্তু।’ একে মোচা ছাড়ানো, তার ওপর চিংড়ি মাছ বাছা দু’টোতেই সময় লাগে বেশ। গোপালের গিন্নীকে চিন্তিত দেখে বন্ধুর স্ত্রীটি বলে, ‘দিদি, হামি কেলে কা ফুল বেছে দেবে।’ এই কথা শুনে গোপালের গিন্নী খুব খুশি।পরম নিশ্চিন্তে মনে গোপালের গিন্নী চিংড়ি মাছ বাছতে গেল। ফিরে এসে বলে, ‘দাও বন্ধু, এবার আমি মোচাটা মিহি করে কুচিয়ে নি। ‘একটা থালাতে জড়ো করা আছে মোচা থেকে যেসব বস্তু গুলো বাদ দিতে হয় সেই সব বস্তু গুলি। পুরো মোচাটাকে খোসা ভেবে বন্ধু পত্নী দিয়েছে সব ফেলে। গোপাল ভাঁড়ের গিন্নী বিরক্ত হলেও মুখে বলে, ‘আচ্ছা কিয়া।’ ঐ পরিস্থিতিতেও গোপাল ভাঁড়ের গিন্নী ভোলে নি অতিথি নারায়ণ।

হাত তালির আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে লালকেল্লা। এবার আকবরের অনুমতি নিয়ে বীরবল ও শুরু করলো
‘এই মহারন হাসির বন
লড়বো আজ আমরা তিনজন
হেসে খুন হবে সভাসদ
জিতবে দিল্লিরই মসনদ।
এসো শুরু করি হাসির জং
আমরা তিনজনে দেখাবো
আজ কতই না ঠং।’

তিন জনের আলাপচারিতায় বাদশা আকবর ভীষণ খুশী। তিনি তিন জনকে জানান তাদেরকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। প্রশ্নের জবাব প্রত্যেককে লিখিত দিতে হবে।
প্রশ্ন এক -শিশুর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কী?
প্রশ্ন দুই-একজন পরিশ্রমী পুরুষের কাছে সবচেয়ে দামী কি?
প্রশ্ন তিন-একজন সাধু সন্তের কাছে কোনটা সবচেয়ে লোভনীয়?

পনেরো মিনিট পর প্রত্যেকের উত্তর পত্র জমা নেওয়া হয়। আকবরের হাতে উঠে আসে প্রথম উত্তর পত্র নাসির উদ্দিন সাহাবের। নাসির উদ্দিন তার উত্তর পত্রে লিখলেন প্রথম উত্তর- একটি শিশুর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো তার মা।
দ্বিতীয় উত্তর -একটি পরিশ্রমী পুরুষের কাছে সবচেয়ে দামী তার সততা।
তৃতীয় উত্তর -একজন সাধু সন্তের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় আল্লাকে পাওয়া।
বাদশা আকবর প্রতিটি উত্তরে অত্যন্ত সন্তুষ্ট।

এরপর বাদশার হাতে এলো বীরবলের উত্তর পত্র।
প্রথম উত্তর- একটি শিশুর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মাতৃক্রোড়।
দ্বিতীয় উত্তর- একটি পরিশ্রমী পুরুষের কাছে সবচেয়ে দামী সৎ কর্ম।
তৃতীয় উত্তর- একজন সাধু সন্তের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ।
মোটামুটিভাবে নাসির উদ্দিন ও বীরবলের উত্তর এক। আর এক হওয়াটাই উচিত। প্রশ্ন গুলোতে সেভাবেই করা হয়েছিল। কিন্তু গোপাল ভাঁড় এর উত্তর পত্র দেখে বাদশা ‘থ’ মেরে গেলেন। এসব কী লিখেছে গোপাল ভাঁড়!
প্রথম উত্তর- একটি শিশুর কাছে সবচেয়ে দামী স্মার্ট ফোন।
দ্বিতীয় উত্তর- একটি পরিশ্রমী পুরুষের কাছে সবচেয়ে দামী অর্থ।
তৃতীয় উত্তর- একজন সাধু সন্তের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় পাবলিসিটি অর্থাৎ প্রচার।

বাদশা আকবর গোপাল ভাঁড়কে মঞ্চে ডেকে পাঠালেন। গোপাল ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠে এলেন। বাদশা আকবর উপস্থিত সকল দর্শকদের উদ্দেশ্য বলেন, ‘আমার প্রিয় প্রজা সকল, যে হাসির মহারণের আয়োজন আমরা করে ছিলাম তার ফলাফল পর্বে আমরা এখন উপস্থিত। বীরবল ও নাসির উদ্দিনয়ের উত্তর পত্র দু’টি প্রায় একই। কিন্তু গোপাল ভাঁড় যে কী পাগলের মতো উত্তর লিখেছে তার স্বয়ং বিচারক মন্ডলীর সাথে আমারও বোধগম্য হল না।’

দর্শক সকলেই গোপাল ভাঁড়ের দিকে আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে রইলেন। গোপাল বাদশাকে নমষ্কার করে যা বললো তাতে সকলে এক বাক্যে একমত।

প্রথম উত্তর- বাদশা আকবর এখন একবিংশ শতাব্দীর সম্রাট। এই সময় স্মার্টফোন ছাড়া কিছু ভাবা যায় কী? ছোট্ট বাচ্চারা হামাগুড়ি দেওয়ার আগেই স্মার্টফোনের ক্যামেরায় পোজ দিতে শিখে গেছে। ভাবতে পারেন হুজুর গর্ভাবস্থায় মায়ের ইন্টারনেট কানেকশন না থাকলে শিশুরা আজকাল ভূমিষ্ট হতে চাইছে না সেদিন টেলিভিশনের এক এ্যাডভেটাইজমেন্ট এ দেখলাম। মাতৃগর্ভ থেকেই ‘give and take পলিসি শুরু করে দিয়েছে। আগে ইন্টারনেট কানেকশন নাও তারপর আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাও।’
বাদশা আকবর বলে উঠলেন গোপালকে ‘তোমার এই ব্যাখ্যাটা যে কি প্রাসঙ্গিক বলে বোঝাতে পারবো না। আজকাল ছেলে মেয়েরা চকলেটে ভোলে না স্মার্ট ফোনে ভোলে। এরপর দ্বিতীয় উত্তরের ব্যাখ্যাটা আমায় দাও’।

বাদশা একবিংশ শতাব্দীতে একজন পরিশ্রমী পুরুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় অর্থ। যার কাছে অর্থ থাকবে না তার সবই অর্থ হীন। একবিংশ শতাব্দীতে পার্লামেন্টের সদস্য হতে গেলে নাকি শিক্ষা দীক্ষার চেয়ে অর্থে জোর বেশী থাকতে হবে। সৎ, পরিশ্রমী ও মানবিক গুণ সম্পন্ন ব্যক্তিরা এখন নেতা হন না। এখনকার বেশিরভাগ নেতাই অশিক্ষিত। হুজুর শিক্ষিত বলতে পুঁথি গত শিক্ষার কথা বলছি না। আমি সেই শিক্ষার কথা বলছি যা নম্র, ভদ্র ও মার্জিত হতে শেখায়। প্রতিটি মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে শেখায়। অর্থের বিচারে মান সম্মানের মাপকাঠি নির্ধারিত না হয়। একবিংশ শতাব্দীতে বেশীরভাগ মানুষই প্রচুর প্রচুর অর্থ উপার্জনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। বাদশা আকবর গোপালের কথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে বলেন ‘একদম ঠিকই বলেছো গোপাল। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের অর্থের পিছনে ছোটা দেখে আমিও অবাক হই’।

যাক গে, তোমার তৃতীয় উত্তর সম্বন্ধে এবার বলো। ‘বাদশা আমাদের সনাতন ধর্মে কখনো শুনেছেন মুনি, ঋষিরা সিঃহাসনে বসেছেন। রামায়ণ থেকে মহাভারতে বিভিন্ন মুনি ঋষির কথা আমরা জানতে পারি। কখনও দেখেছি তারা রাজকার্যে সাহায্য করেছেন, রাজপুত্রদের শিক্ষা দান করেছেন।তা বলে সিংহাসনে আরোহণ। সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম এক যোগী পুরুষ কোথাকার যেন মুখ্যমন্ত্রী হলেন। সেদিন আমার পরিবার আমাকে বললো ‘ওগো দিল্লি যাওয়ার আগে যোগ গুরুর কোম্পানির সরষের তেলটা এনে দিতে হবে।’ আমি তো শুনে অবাক। ব্যায়াম শিখিয়ে হচ্ছে না সরাসরি ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। এ সবই তো প্রচারের আলোয় আসার চেষ্টা।

আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে বারবার উঠে এসেছে বহু রাজা, রাজপুত্র রাজ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে সাধুসন্তের জীবন যাপন করেছে। তাহলে প্রভু আমি কেন লিখবো না এখানকার সাধু সন্তের একমাত্র লক্ষ্য পাবলিসিটি।

গোপালের একের পর এক যুক্তি শুনে বাদশা আকবর তো অবাক। কী সাংঘাতিক কঠিন সত্যগুলো গোপাল ভাঁড় অকপটে তুলে ধরলো। গোপাল ভাঁড় একজন নির্ভীক ব্যক্তি। বাস্তবের অনেক কঠিন অবস্থাকে হাস্যরসের মাধ্যমে গোপাল সহজে হাস্যরসের মেলায় উপস্থিত লোকজনের কাছে পৌঁছে দিল। বাদশা আকবর তার দুই বাহু প্রসারিত করে গোপালকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘সত্যি গোপাল তুমি আমারও চোখ খুলে দিয়েছো। অর্থ, প্রতিপত্তির জোরে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম বীরবল, নাসির উদ্দিন ও গোপাল এরা তিনজনই কমেডিয়ান। লোককে আনন্দ দেওয়াই এদের কাজ। এরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের জায়গায় সেরা। অহেতুক সেরা বিদূষকের লড়াই লাগিয়ে এদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম।’

সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment