গল্প- আপতন…….. স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখা

আপতন…….. স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখা
– দ্যুতিপ্রিয়া বন্দোপাধ্যায়

 

 

(১)
ঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা পড়লো। না আর পারা যাচ্ছে না.. মাথা পুরো ঝিম ঝিম করছে। চশমার ফাঁক থেকে ল্যাপটপের লেখাগুলো অনেকক্ষণ আগে থেকেই ঝাপসা হতে শুরু করে দিয়েছে। কোনো রকমে নোট প্যাডটা সেভ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করতে গিয়ে তানৌকা খেয়াল করলো মেইলটা খোলা থাকায় ল্যাপটপটা বন্ধ হচ্ছে না, Screen এ তখনও কম্পোজ new mail optionটা খোলা, সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা নতুন আনকোড়া মেইল, প্রকাশকের মেইল আইডি আর ওর শেষ না হওয়া একটা গল্প, প্রকাশককে পাঠাবে বলে মেলেতেই ‘সেভ’ করছিল আর কি। আসলে শেষ না হওয়ার কারণটা অন্য। ও ভেবেছিল আরো একটু ভেবে, অন্যরকম করে গল্পটা শেষ করবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেইলটা ডিলিট করতে গেলো, যাঃ!! কারেন্ট চলে গেল! মানে আজ যে কার মুখ দেখে সকালে উঠেছিল, কে জানে! এবার তানৌকার মাথা গরমটা কারেন্টের থেকে ঘুরে গিয়ে, নিজের ল্যাপটপটার ওপর পড়লো। বিরক্তিকর, যত পুরোনো হচ্ছে তত নিত্য নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। আগে তো ছিলই ল্যাপটপের নিজস্ব জায়গায় কিছু ‘সেভ’ করা যেতো না। ইদানীং হয়েছে, পাওয়ার ব্যাক আপের পুরো ষষ্ঠী পুজো হয়ে গেছে। কার্রেন্ট না থাকলে দু’ সেকেন্ড যে এক্সট্রা চলবে তার উপায় নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে তানৌকা বেশ বুঝতে পারলো পায়ের বুড়ো আঙুল অব্দি পুরো অসাড়, অগত্যা চেয়ারের ওপর অকাল কুষ্মাণ্ডর মতো বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ঘাড়ে যন্ত্রণাও করছে। অবশ্য হওয়ারই কথা- সেই সকালে প্রাতঃরাশ সেরে বসেছে তানৌকা। একটা গল্প লেখার ইচ্ছায়। না, ইচ্ছা বলাটা এখানে ঠিক না.. বরং বলা ভালো প্রকাশকের চাপে পড়ে। লেখা জমা দেওয়ার অন্তিম সময় যে আজ রাত সাড়ে বারোটা। তা রাত বারোটা বাজার ঘন্টাটা যেন তানৌকাকে ফাইনাল ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছে ‘অলরেডি..’  এর মধ্যে নাকি একটা নতুন গল্পো তানৌকাকে জমা দিতে হবে। তা না হলে শহরের নাম করা পত্রিকার, পুজো সংখ্যাতে এবারের মতো তানৌকার লেখা আর যে জায়গা পাবে না সেটা গতকালই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে প্রকাশক মহাশয়।

না এবার পা’টা একটু ছেড়েছে। চেয়ার থেকে উঠে বাথরুমের দিকে গেল তানৌকা। চোখে মুখে একটু জলের ঝাপটা দিয়ে এসে খাটে বসলো। মাথার মধ্যে তখনও একই জোট ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। লেখাটার কি হবে! ঘড়িতে সোয়া বারোটা… আদতে ও এমন একটা রক্ষণশীল পরিবারের অংশ যেখানে মেয়েদের সামান্য স্নাতক হওয়াটাই বিশাল বড় ব্যাপার, সেখানে ওর ইচ্ছা, সমাজকে দেখার ভঙ্গিমাটা যেন একটু অন্যরকম তাই গত তিন বছর ধরে একজন লেখিকা হবার স্বপ্ন দু’চোখে নিয়ে শহরের হেন কোনো সম্পাদক বা প্রকাশক নেই যে যার দরজায় ঘোরেনি তানৌকা। লেখালেখিটা যে খুব খারাপ করে তা না, আসলে পিছনে একটা আর্থিক আর মানসিক সমর্থন থাকলে ব্যাপারগুলো অনেক সহজ হয়ে যায় আর কি, সে যাকগে!! এতদিন বাদে গিয়ে যে শহরের অন্যতম পত্রিকা, “অনুরাগ”এর জাঁদরেল প্রকাশক শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদার মহাশয়কে নিমরাজি করনো গেছিলো সেটাও যে গেল হাত থেকে সেটা বোঝার বাকি রইলো না তানৌকার।
সব কিছুকে প্রথম থেকে শুরু করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়ে বিছানায় গা’টা এলিয়ে দিলো ও। চোখটা বন্ধ করে মনে মনে ভাবলো, “দুর্ছাই, এভাবে ধরে বেঁধে গল্প লেখা হয় নাকি! অমুক বিষয়ের ওপর একটা গল্প লিখে অমুকদিনে জমা দিতে হবে, তারপর সম্পাদক, প্রকাশক সবাই ‘এপ্রুভ’ করবে, কি সংশ্লিষ্ট লেখাটি ছাপা হবে কি না, তবে গিয়ে একটা লেখা প্রকাশ পাবে। দূর.. দূর এ;যেন প্রতিবারই মহাভারতের যুদ্ধ
ঘড়ির কাঁটা দুটো তখন একটা বারোটায় আর একটা  পাঁচটার ঘরে জ্বলজ্বল করেছে। নাঃ এভাবে ঘুম হবে না। তাই ঘড়িটার দিকে পিঠ করে শুলো তানৌকা। কাল থেকে আবার নতুন যুদ্ধ শুরু।

(2)
মোবাইল ফোনটা সেই কখন থেকে ‘ভাইব্রেট’ করছে, মাথার ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে আড় চোখে ঘড়িটার দিকে তাকালো তানৌকা, ধ্যাৎ! সবে সকাল সাড়ে আটটা।
এতো সকালে আবার কে ফোন করছে? একটু বিরক্ত হয়েই হাত বাড়িয়ে মাথার বালিশের তলা থেকে ফোনটা বের করে আনলো। একটা অচেনা নম্বর… ‘অলরেডি’ পাঁচটা ‘মিস কল্‌’.. অগত্যা ধরতেই হয়।
“হ্যালো, আমি শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদার, ‘অনুরাগ’ পত্রিকা থেকে। আপনার লেখাটা..”
এইরে এইভাবে উনি ফোন করে তানৌকাকে লেখাটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন, সেটা তানৌকা ভাবতে পারেনি। দু’বার ঢোক গিলে, তানৌকা বলার চেষ্টা করলো, “না, মানে, আসলে, আমি অনেক লেখার চেষ্টা করলাম”
কথাটা শেষ করতে পারলো না ও, উল্টোদিকের গুরুগম্ভীর আওয়াজটা ওকে চুপ করিয়ে দিলো।
“কি মানে মানে করছেন বলুন তো, ‘জাস্ট লিসেন টু মি ফার্স্ট’ , কাল একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে আপনার মেইলটা পেলাম আমরা, ওই বারোটা পাঁচ কি বারোটা দশ নাগাদ রাত, লেখাটা বেশ ভালো, ছাপা হবে এবারে পুজো সংখ্যাতে। কিন্তু আপনি কি বেয়াক্কেলে মানুষ! আর শুনুন এরপরের বার থেকে এইরকম করলে কিন্তু আপনার আয়ের দশ শতাংশ কেটে নেওয়া হবে।”
বলেই ফোনটা কেটে দিলেন প্রকাশক শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদার মহাশয়।

ফোনটা কেটে দেওয়ার পর দশ মিনিট কেটে গেছে। এখনো ঘুমের ঘোর আর আকস্মিক শকটা মিলিয়ে কেমন একটা আফিমের নেশার মতো লাগছে তানৌকার। ঘোর কাটলো ফোনে টুং টুং করে দু’বার আওয়াজে, শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদারের, লেখাটা ‘এপ্রুভাল’ এর একটা ‘অফিসিয়াল কনফার্মেশান এস .এম এস… সাথে আজ একবার দেখা করতে বলেছেন। হঠাৎ মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা চলে উঠলো, সেই কাল রাতের পর আজ এতক্ষণে কারেন্ট এলো। যথারীতি ল্যাপটপটাও চালু হয়ে গেছে। ওখানে তখনো একটা নোটিফিকেশন ‘শো’ করছে,

“Your mail has successfully sent”……

Loading

Leave A Comment