Site icon আলাপী মন

ভৌতিক গল্প- নর-কঙ্কাল

নর-কঙ্কাল
→ ইন্দ্রনীল মজুমদার

 

 

অমলেশবাবু বাড়িতে সোফায় বসে খবরের কাগজটা উল্টে-পাল্টে দেখছেন। বাইরে ঝম্‌ঝম্‌ করে বৃষ্টি পড়ছে, তাই কোথাও বেড়োনো যাবে না। তিনি রিটায়ার্ড মানুষ, তাই কোনও কাজকর্ম নেই। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন এবং মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামীর সাথে বিদেশে থাকেন। তাই বাড়িতে বলা যায় তিনি একলাই থাকেন। মাঝে মাঝে ও পাড়ার বন্ধু মানিকবাবু তাঁর সাথে আড্ডা মারতে আসেন। মানিকবাবু ছিলেন একজন সরকারি অফিসের চিফ্ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, এখন বেশ কয়েক বছর হল অবসর নিয়েছেন। তিনি কাজের সূত্রে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। তাই অফুরন্ত তাঁর গল্পের স্টক,বিশেষ করে ভূত বা অলৌকিক গল্পের। মানিকবাবু আসলে আড্ডাটা বেশ জমে।অমলেশবাবুর কেমন বিশেষ বন্ধু-বান্ধব নেই। তাই, অমলেশবাবু খালি ভাবছেন যে, আজ এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে একটিবার যদি মানিকবাবু আসতে পারে তাহলে আড্ডাটা বেশ জমে। অমলেশবাবু বড্ড একাকীত্ব বোধ করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, বৃষ্টিটা বেশ ধরেছে, মানিকবাবু আসতেই পারেন। এইরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এমন সময় কলিংবেলের ঘন্টা বাজলো। দরজা খুলতেই দেখা গেল হাসিমুখে মানিক চৌধুরীকে। তিনি একটি প্যাকেট তুলে বললেন, “বেগুনি ও আলুর চপ নিয়ে এসেছি মশাই। মুড়ি দিয়ে এই ওয়েদারে বেশ জম্পেশভাবে খাওয়া যাবে। এরসাথে চা হলে তো কোনো কথাই নেই।”

অমলেশবাবুও হেসে বললেন, “শুধু কি তাই? আপনার ভৌতিক গল্প শুনতে শুনতে বেশ জমে যাবে এই বৃষ্টি-বাদলার দিনটা। আমি তো খালি আপনার কথাই ভাবছিলাম আর ঠিক তখনই আপনি এসে হাজির। অনেক আয়ু আপনার মশাই।”

মানিকবাবু হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে সোফায় বসলেন। ওদিকে অমলেশবাবুও রান্নাঘরে চা ও খাবার রেডি করতে লাগলেন। সব রেডি হয়ে ট্রেতে করে খাওয়ার যখন অমলেশবাবু
আনছিলেন তখন মানিকবাবু বলে উঠলেন, “আজ ঘুরঘুটিয়া গ্রামে কি সব ঝামেলা হয়েছে। খবরে তা বেরিয়েছে। পড়েছেন কি?

– হ্যাঁ, ওই আর কি সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। মারামারি, খুন, থানা,পুলিশ আরও কত কি!

মানিকবাবু খানিকক্ষণ থেমে বললেন, “এই ঘুরঘুটিয়ায় সেই ঘটনাটি ঘটেছিল।”

অমলেশবাবু বেশ কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন ঘটনা?”

– নর-কঙ্কাল নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর ভৌতিক ঘটনা। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় মশাই, রোম খাঁড়া হয়ে যায়।

অমলেশবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার মতো বিজ্ঞান মনস্ক লোক ভূতে বিশ্বাস করেন,ভৌতিক গল্পে জমাটি আড্ডা দেন, ভৌতিক গল্প ও উপন্যাস লেখেন- এসব বিশ্বাস করতে কেমন একটা যেন লাগে।”

মানিকবাবু হো হো করে বেশ খানিকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, “আগে একদমই করতাম না জানেন মশাই। এই ঘটনাটার পর থেকে করি। আসুন আপনাকে ঘটনাটা পুরোটা বলছি।”

এইবার অমলেশবাবু ও মানিকবাবুর ভৌতিক আড্ডা শুরু হবে। সাথে চলবে খাওয়া-দাওয়া। ওদিকে আবার বৃষ্টির বেগও বেড়েছে, সাথে শুরু হয়েছে ঝড়। গল্প শুরুর সময় কারেন্টও অফ গেল। বাধ‍্য হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ভৌতিক আড্ডা শুরু করতে হল। অতএব পাঠকগণ বোঝাই যাচ্ছে একটা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে আর এই পরিবেশেই মানিকবাবু ঘুরঘুটিয়ার গ্রামে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা শুরু করলেন।

– সে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগেকার কথা। সরকারের কোনো এক প্রজেক্টের কাজে ঘুরঘুটিয়ায় আমার পোস্টিং হয়। তখন ঘুরঘুটিয়া গ্রাম এতটা জমজমাট ছিল না। যাকে বলে অজ পাড়া-গাঁ সেরকম একটা ছিল আর কি। তা আমার পোস্টিং যেখানে হয় সেই জায়গাটা বেশ ফাঁকাই ছিল। ফাঁকা মাঠের মাঝে থাকার জন্য মেসবাড়ি টাইপের একটি বাড়ি বলা যায়। বাড়িটার উল্টোদিকে একটি পোড়ো বাড়ি টাইপের একটা বাড়ি ছিল। দেখে মনে হয় বিশেষ কেউ ওখানে থাকে না, বাড়িটা পরিতক্ত। যাইহোক, মেসে আমার সাথে আরেক জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার শ্রী বিমল মিত্র ছিলেন। শুরু থেকেই কেন জানি না আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল উল্টোদিকের ওই বাড়িটা। চারপাশে ঘন-জঙ্গল ও মাঠের মাঝখানে এই বাড়িটাকে কেমন যেন অন্যরকম মনে হত। বাড়িটা বহু পুরনো তাই হয়তো আমার আকর্ষণ আরও বেড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, সকালে কোনোরকমে ব্রেকফাস্টে কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে যেতাম, সারাদিন অফিসের কাজ, প্রকল্পের কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরতাম। আমার পাশের রুমেই থাকতেন বিমলবাবু। এখানে বলে নিই আমাদের থাকার বাড়িটি ছিল একতলা, সেখানে ছিল মাত্র দুটোই ঘর। এই অজ গ্রামে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা না থাকার ফলে কর্মীরাও তেমন আসতেন না। আর সরকারি প্রকল্পও তেমন হত না। রাত্রে বাড়ি ফিরে আর রান্না করতে ইচ্ছে করত না তাই বাইরে কোথাও খেয়ে এসে শুয়ে পরতাম। যাই হোক, একদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করি। এমন সময় জানলার কাছে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম। উল্টোদিকের বাড়িটা সকালবেলা অফিস যাবার সময় দেখতাম অন্ধকার কিন্তু এখন দেখছি ওই বাড়ির উপরতলায় আলো জ্বলছে। একটা ছায়াও লক্ষ্য করলাম। তার মানে ওখানে কেউ থাকেন। কিন্তু সকালবেলায় বা এমনকি ছুটির দিনেও সারাদিন তো কাউকে ওখানে দেখা যায় না। কি ব্যাপার কে জানে? কৌতুহল নিয়েই জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। এরকম অভিজ্ঞতা আরেক দিনেও হয়েছে। সেদিন অবশ্য অফিসের কাজের চাপ ছিল তাই রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। ঘুম আসছিল না। তখন একেই গরমকাল, তাই জানলা খুলে খাটে শুয়ে শুয়ে একটি বই পড়ছিলাম। মাঝে মাঝে চোখ যাচ্ছিল উল্টোদিকের ওই বাড়িটায়। না বাড়িটা তো অন্ধকারেই আছে। তখন রাত বারোটা বেজে গেছে, চোখে ঘুম চলে এলো তাই বই বন্ধ করে ঘুমোতে যাব এমন সময় দেখি ওই বাড়িটার দোতলায় আলো জ্বলে উঠল। তাজ্জব ব্যাপার! যাই হোক, তখন বেশ ঘুম চলে এসেছিল তাই আর ওদিকে কৌতূহল না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কাল বিমলকে বলে দেখতে হবে। তা পরদিন অফিসের ক্যান্টিনে বিমলকে ঘটনাটা বলতেই, বিমলও দেখি বাড়িটার ব্যাপারে বেশ কৌতুহলী। বিমল জানালেন যে তিনিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন। তিনি বললেন, “দাদা, ওই বাড়িটায় একটু নজর দেওয়া দরকার। কোনো সমাজবিরোধীদের ঘাঁটি হতে পারে।

– একদম ঠিক কথা বলেছ। তাই হবে হয়তো।

– একদিন একটু ঢুঁ মারা দরকার।

– ক্ষেপেছ দাদা, ওদের হাতে অস্ত্রসস্ত্র থাকলে কি হবে?

– তা তো ঠিকই।

যাই হোক, সেদিন এর বেশি আর কথা এগোয়নি। আমরা দুজনেই কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকদিন পর বিমল অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল রাতে দেখেছ দাদা?”

– কাল রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কেন কি ব‍্যাপার বলতো?

– রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আর ঠিক তখন ওই বাড়িটায় চোখ পড়তে দেখি ছাদে একজন উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। একেই অন্ধকার, তাই অত ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। তাকে একটা ছায়ামূর্তি হিসেবেই দেখাচ্ছিল। স্পষ্ট না হলেও, গোটা বাড়িটা দেখলাম সম্পূর্ণ অন্ধকার। তাই, ওখানে একটিমাত্র লোক আছে বলেই মনে হয়।

– আচ্ছা। তাহলে একদিন তো যাওয়াই যায়। এই সামান্য       ইনভেস্টিগেশন করতে।

– গেলে তো রাতেই যাব।(উৎফুল্ল হয়ে বললেন বিমল)

– তা তো বটেই। তুমি ওই লোকটাকে দেখেছো?

– না। সেটাই তো তোমাকে বললাম তাকে দেখতে পারিনি। সে একভাবে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমারও এদিকে ঘুম পেয়ে গিয়েছিল তাই ঘুমিয়ে পড়লাম।

– আচ্ছা। তাহলে একদিন যাওয়া হচ্ছে।

সেদিন আর এ নিয়ে কথা হয়নি। পরে একদিন ঠিক হল যে সামনের শনিবার রাত দশটার সময় আমরা সেই বাড়িটায় যাব। তা সেই শনিবার টর্চ সমেত গেলাম সেই বাড়িটায়। বাড়িটার সামনে বাগান, বাগানে আগাছায় ভর্তি। অনেকদিন এই বাগানে কারুর পা যে পড়েনি তা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। নিজেদের নিরাপত্তার জন‍্য ভেবেছিলাম টর্চ প্রয়োজন ছাড়া চালাবো না। কিন্তু যা অন্ধকার, তাই একদণ্ড টর্চ ছাড়া চলছিল না। অগত‍্যা টর্চটা জ্বালাতে হল। সামনে দড়ির মতো কি একটা চলে গেল না। বেশ ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিমল বললেন, “ওটা সাপ ছিল, ডানদিকে চলে গেছে, চলো পা টিপে টিপে সামনের দরজার দিকে এগোই।” সেভাবেই এগোচ্ছিলাম দরজার দিকে। বলা যায় না, কোথায় কি বিপদ লুকিয়ে আছে, তাই চারিদিকে টর্চ ফেলছিলাম। দরজার কাছাকাছি চলে এসেছি, বাঁদিকে টর্চ ফেলে হঠাৎ ভয়ে আত্মারাম খাঁচা হবার জোগাড় হল। ভয়ে হাত থেকে টর্চটা পড়েই গেল। দরজার কাছে ওই গাছের ডালে ওটা কে বসে? মনে হয় তার দুটো চোখ যেন লাল আগুনের গোলা। টর্চটা কোনোরকমে তুলবার সময় বিমল বললেন “ওটা একটা প‍্যাঁচা গো দাদা। ভয় নেই।”

– কিন্তু প‍্যাঁচা হলে ওর চোখটা যেন লাল আগুনের গোলা কেন?

– তাইতো দাদা, চলো তো দাদা গিয়ে দেখি।

আমরা প‍্যাঁচাটার দিকে এগোতে লাগলাম। কাছাকাছি আসতেই সেটি ‛ক্র‍্যাও ক্র‍্যাও’ করে ডেকে উড়ে চলে গেল। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজায় তালা লাগানো নেই, তাই সহজেই সেখানে ঢোকা গেল। বাড়িটার দরজায় নামের প্লেটটা ভাঙা। তাই নামটা পড়া যাচ্ছিল না। সামনের আলোটাও ভাঙা। তাই আলোও থাকে না। পুরো বাড়িটাই এক অন্ধকারময় জগতে রয়েছে। তা দরজায় ঠেলা দিতেই সেটি খুলে গেল। ব্যাপারটা বড়োই আশ্চর্যজনক মনে হল। এ বাড়িতে কেউ কি থাকে আদৌ?একটু সন্দেহ হচ্ছিল। দরজার ঠিক ডানদিকের একটি ঘর খোলা। সেখানে টর্চ ফেলতেই দেখলাম উপরের সিলিং থেকে ঝুলে রয়েছে বাঁদুরের দল। তাদের দিকে টর্চ ফেলতেই তারা কিচিরমিচির করতে লাগল। বেশ কয়েকটা মাথার উপর দিয়ে উড়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়েও গেল। আমরা সেখান থেকে সরে এলাম। বিমল রসিকতা করলেন, “এখানে কি ভ‍্যাম্পায়ার আছে নাকি দাদা?” আমি শুধু বললাম, “কি জানি ভায়া থাকতেও পারে।” নীচের অন‍্যান‍্য ঘরগুলি বন্ধ। শুধু বাঁদিকে একটা বাথরুম খোলা ছিল, আর সেখান থেকে টপ্‌টপ্‌ করে আওয়াজ আসছিল। কাছে গিয়ে দেখি কল থেকে কিছু সময় অন্তর অন্তর জল কলের নীচে একটি বালতিতে পড়ছিল। বাথরুম থেকে কার যেন পায়ের ছাপ অন্য একটা বন্ধ ঘরের দিকে চলে গেছে। বেশ ভয় হল। ঘরের দরজা খুলে কোনো বিভীষিকা মূর্তি উপস্থিত হবে না তো? অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে। কিন্তু কেউ এলো না। আমরা এগোতে লাগলাম। বেশ একটা নিস্তব্ধতা অনুভব করছিলাম। আসলে, আমাদের দুজনের পায়ের শব্দ আর কথা বলার ফিস্‌ফিস্‌ ছাড়া আর বাথরুমের টপ্‌টপ্‌ করে জল পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছিল না।

খালি মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এখানে আদৌ কেউ থাকে? একটা কথা বলা হয়নি তা হল এই বাড়িতে আসার মূহুর্ত থেকেই মনে হচ্ছিল যে যেন এক অন‍্য জগতে চলে এসেছি। বেশ অসস্তি বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে, এই বাড়িতে না আসলেই ভালো হত। জানেন তো মশাই কোনো কিছুতে অতি কৌতূহল ভালো নয়। আমাদেরও তাই অবস্থা। যাইহোক, বিমল বললেন, “ওই তো সামনে একটা সিঁড়ি,চলো দাদা। উঠে দেখি তো।” সিঁড়িতে উঠতে মন চাইছিল না তবুও আমরা সেটা বেয়ে উপরে উঠলাম। অবশেষে দোতলার একটি ঘরে এলাম। ঘরটা ছিল ফাঁকা, তার দরজার সামনে বারান্দা। ওই বারান্দায় কেউ নেই তো? ভালোভাবে তো কিছু বোঝাই যাচ্ছে না। ভয়ে দুজনেই টর্চটা নেভালাম। আমরা ঘরেই অপেক্ষা করছিলাম। এরসাথে ঘরটাও পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সবকিছু ভালোমতোনভাবে দেখার জন্যে তাই টর্চের আলোটা আবার জালালাম।

ঘরটায় দুটো আলমারি রয়েছে। আলমারিগুলোতে ধুলো এতটাই জমে আছে যে আছে যে সেগুলোর ভেতর দেখা যাচ্ছিল না‌। দরজা জানালা সব বন্ধ, তাই ঘরটা বড্ড গুমোট। দেখলাম মেঝেতে একপুরু ধুলো জমে আছে, সামনে আলমারির কাঁচের দেরাজগুলোতে ধুলো জমে গিয়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো পরিস্কার করে ভালোভাবে দেখার জন্যে যেই না একটু পা বাড়িয়েছি অমনি শুনতে পা খট্‌খট্ করে একটা পায়ের আওয়াজ- কে যেন সিঁড়ি বেয়ে এদিকে আসছে। তড়িঘড়ি করে আমরা নিজেদের টর্চটা নেভালাম। অপরদিকে একটা ঘর দেখলাম আর মাঝে একটা প‍্যাসেজ, সামনে বারান্দা। আমরা বারান্দার দিকে এগিয়ে ডানদিকে ওই ঘরটার সামনে গিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম। এমন সময় খট্‌খট্ আওয়াজটা বেড়ে গেল। এমনসময় বেশ কয়েকটি শেয়াল ও কুকুর যেন ডেকে উঠল। মনে হল ওরা কিছু একটা অশনিসংকেত জানান দিয়ে গেল। আমরা ভয়ে দরদর করে ঘামছি। ‘কি হয়, কি হয়’- একটা টেনশন কাজ করছে। লুকিয়ে সবকিছু নজর রাখছি। এমনসময় যা দেখলাম তাতে রক্ত হিম হয়ে গেল, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। একটা নর-কঙ্কাল সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। তার চোখ দিয়ে যেন ঠিঁকরে বেরোচ্ছে আগুন। সে আমরা যে ঘরটায় ছিলাম, সেখানে ঢুকল। বেশ অনেকক্ষণ সেখানে থেকে বোধহয় আমাদের খোঁজ করছিল। তারপর কাউকে না পেয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উপরের সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলে গেল। ভাগ‍্যিস এদিকে তাকায়নি। খুব জোর বেঁচে গিয়েছি। আমার তখন হৃদপিণ্ড হাতে চলে আসার মত অবস্থা বুঝলেন মশাই। আমি কোনোরকমে বিমলকে ফিস্‌ফিস্‌ করে বললাম, “চলো বিমল, আর এখানে নয়। ছাদ থেকে নেমে পড়ার আগে আমরা পালাই এই বাড়ি থেকে। বিমলেরও দেখি একই অবস্থা। আমরা কোনোরকমে দৌড় মারলাম মেসবাড়ির উদ্দেশ্যে। ওইদিকে কুকুর ও শেয়াল আবার ডাকা শুরু করেছে। যাইহোক, কিভাবে যে এক নিশ্বাসে দৌড়ে মেসে পৌঁছে ছিলাম তা আমরাই জানি। কোনোরকমে মেসবাড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমাদের অবস্থা দেখে শশব‍্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক আছে তো, বাবুরা? কোনও রকমে বলে উঠলাম, “খুব জোর বেঁচে গিয়েছি।যা দেখলাম তা আর এ জীবনে ভোলার নয়।” তখন আমাদের অবস্থা দেখে একজন বলে উঠল,“এই বাবুদের জল দে।” গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ তাই জল খেয়ে একটু স্বস্তি বোধ হল। তো আরেকজন বলে উঠল, “চলুন আপনাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।” আমরা বললাম, “থাক, থাক।” যাই হোক, কোনোরকমে ঘরে ঢুকলাম। সাথে ওই মানুষগুলোও ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, “আমরা এই লোকাল ক্লাবের ছেলে। দূর থেকে এই ফটিক সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় আপনাদের দেখতে পায় ওই বাড়িতে ঢুকতে। তাই সে ক্লাবের সেক্রেটারি বিপনদাকে খবর দেয়। আমরা সবাই তা শুনেই ছুটে চলে এলাম। আপনারা ওই বাড়িতে ঢুকেছেন জানতে পেরে সবাই চলে এলাম আপনাদের বাঁচাতে। আসতেই দেখি ওই বাড়ি থেকে আপনারা এই অবস্থায় বেড়িয়ে আসছেন।”

–তা ভালোই করেছেন। আচ্ছা, ওই বাড়িটার ইতিহাস কিছু জানেন?

এবার একজন নেতা গোছের লোক এগিয়ে এলেন, ইনি মনে হয় বিপনদা। যাই হোক, তিনি বললেন, “নমস্কার, আমার নাম বিপন। আপনারা ওই বাড়িতে কেন যে গেলেন? আমরা তো ভুলেও এমন কি দিনের বেলাতেও ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় যাই না। ওটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি।”

আমি আমাদের কৌতূহলের ব্যাপারটা বললাম। বিমল বললেন, “বাড়িটার ইতিহাস সম্পর্কে যদি একটু বলেন।”

তখন আমরা কোনোরকমে ধাতস্থ হয়েছি। আর এমনিতেও তো ওই বাড়িটার প্রতি একটা কৌতূহল ছিলই। তা বিপনবাবু বলতে শুরু করলেন,“সে অনেকদিন আগেকার কথা। আজ থেকে বছর দশ-পনেরো তো হবেই। ওই বাড়িতে থাকতেন এক দম্পতি। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। গৃহস্বামী খুব একটা সুবিধার লোক ছিলেন না। নানান জায়গায় ধারদেনা করে শোধ দিতে পারছিলেন না। এদিকে তিনি তেমন কিছু কাজও করতেন না। অসৎ সঙ্গে পড়ে প্রচুর টাকা নষ্ট করেছেন। লোকটার জুয়া ও মদেরও নেশা ছিল। তা একদিন, তিনি তাঁর বিপদের কথা তাঁর এক বন্ধুকে জানালেন। সেই বন্ধু ছিল বড়োই সাহায্যকারী, তিনি কলকাতায় কাজ করতেন। তা একদিন বন্ধুকে সাহায্য করার জন্যে ওই বাড়িতে আসেন। বেশ কিছু অর্থ ধার দেন বন্ধুকে। যতদূর শুনেছি ঐই ভদ্রলোকের হাতে ছিল একটি হীরের আংটি যা সোনা দিয়ে বাঁধানো। তা সেই আংটি দেখে ওই বাড়ির গৃহকর্তার ভারী লোভ হল। তিনি ভাবলেন ওই আংটি বাগাতে পারলে প্রচুর অর্থ পাওয়া যাবে। তাঁর মাথায় সবসময়ের শয়তানি বুদ্ধি গিজগিজ করত। তা সেই লোভে পড়ে একদিন তিনি তাঁর বন্ধুর খাওয়ারে বিষ মিশিয়ে দিলেন এবং তাঁর বন্ধু তা খেয়ে মারা গেলেন। ভদ্রলোক তখন আন্টিটা খুলে নিয়ে বন্ধুর লাশটি কোথাও একটা গায়েব করে দিয়েছিলেন। পুলিশি তদন্ত হয়েছিল পরে কিন্তু লাশ পাওয়া যায়নি। আসলে, তখন এখানে প্রচুর ডোবা ছিল আর শেয়াল, কুকুরেরও অভাব ছিল না। মানুষজন তো ছিল সামান্যই। তাই লাশ গায়ের করে দেওয়া কোনো ব‍্যাপারই ছিল না। যাই হোক, তারপর থেকে শুরু হল এক উৎপাত। রোজ রাতে ওই বাড়িতে কঙ্কাল দেখা যেতে লাগল। বাড়ির ছাদে অনেকেই এক কঙ্কালকে চলতে-ফিরতে দেখেছেন। বাড়ির মালি একদিন সেই কঙ্কাল দেখে আতঙ্কে বাগানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। গৃহকর্ত্রীও একদিন বাথরুম থেকে বেরিয়ে কঙ্কাল দেখে অজ্ঞান হয়ে যান,জ্ঞান ফিরলে স্বামীকে ভয় ভয় বলেন, “চলো এখান থেকে চলে যাই। এখানে কঙ্কালের উৎপাত শুরু হয়েছে। আজ আমিও দেখলাম, মনে হল তোমার সেই কলকাতার বন্ধু।” গৃহস্বামীও স্থির করেন বাড়ি ছাড়ার। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। পরদিন দেখা গেল বাড়ির সামনে দুটো লাশ পড়ে, ওই স্বামী-স্ত্রীর, তাঁদের জিভ বার করা ও চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। গলার দাগ দেখে মনে হল কেউ যেন গলা টিপে তাঁদের হত্যা করেছে। মনে হয়, ওই কঙ্কালই তার প্রতিশোধ নিয়েছে। কিন্তু এরপরেও কঙ্কালের উৎপাত থামেনি। রোজ রাতেই দেখা যায় সেই নর-কঙ্কাল এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, আলো জ্বালিয়ে কিছু একটা যেন খুঁজছে। ছাদে উঠে ঘুরতে দেখা যায়। আমাদের মনে হয়, সেই মৃত ব‍্যক্তিটিই আজও কঙ্কাল হয়ে খুঁজে চলেছেন তাঁর সেই হারানো আংটিটা। ওই কঙ্কাল এছাড়া কোনো অসুবিধা আজ পর্যন্ত কাউকে করেনি। আমরা ওই ভদ্রলোকের নাম জানতাম না। তবুও লোকাল তান্ত্রিক, ওঝা ও পুরোহিত ডেকে আমরা শান্তি স্বস্ত্যয়নের ব‍্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।তো, এই হচ্ছে গিয়ে ব্যাপার বুঝলেন দাদারা।”

ওনারা চলে যাবার পর, সেদিন রাতে আর ঘুমোতে পারিনি। বারবার মনে হতে লাগল মনে হতে লাগল ওই কঙ্কালটা আমাদের এই দরজায় এসে হয়তো ঠক্‌ঠক্ করবে। তাই, যে ভাবেই হোক এখান থেকে ছেড়ে চলে যেতেই হবে। পরদিন রবিবার ভয়ে ভয়ে কাটালাম। সোমবার আমরা বদলির চিঠি দিলাম এবং তা মঞ্জুরও হয়ে গেল। দুজনেই বদলি হয়ে গেলাম অন্য জায়গায়।তা এই ছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভৌতিক কাহিনী।কি মিঃ অমলেশ দে, ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?”

অমলেশবাবু শুনে কেবল বিস্মিত হয়ে হাঁ হয়ে রইলেন। আর ওদিকে বৃষ্টিও গেছে থেমে, কারেন্টও এসেছে চলে। অমলেশবাবু এবার কোনোরকমে স্বভয়ে বললেন, “আপনি এরপরে ওই জায়গাটায় গিয়েছিলেন?”

– হ্যাঁ মশাই। তা বছর পাঁচেক আগে ওই গ্রামের পাশের একটি গ্রামে একটি বিয়ে ছিল। সেই উপলক্ষ্যে একটা ফাঁকে ওই মেস ও ওই ভয়ঙ্কর বাড়িটা দেখার আগ্রহ দমন করতে পারিনি। কিন্তু হায় কপাল, গ্রাম তো একেবারে বদলে গেছে। লোকজন, গাড়ি-বাড়ি প্রচুর বেড়ে গেছে। দুঃখের বিষয় সরকারের কোনও প্রজেক্ট না থাকার দরুন ওই মেস দশ বছরের বেশি হয়ে গেল বন্ধই হয়ে আছে। ওখানে বিকেলে স্থানীয় বাচ্ছারা খেলা করে।”

অমলেশবাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আ-আ-আর ওই ভূতুরে বাড়ি? ওই কঙ্কাল?”

মানিকবাবু হেসে বললেন, “ওই বাড়ি? ওই বাড়ি এখন ভেঙে একটা হোটেল উঠেছে। আর বিপনবাবুদের কাউকেই খুঁজে পেলাম না। স্থানীয় ক্লাব এখন অন্য রকমের। পুরো ঝাঁ-চকচকে বিল্ডিং হয়ে গেছে। ক্লাবের ছেলেরাও একেবারে অন্যরকম। তা, সেই ক্লাবের যিনি সেক্রেটারি তাঁকে ওই অভিশপ্ত বাড়ি ও কঙ্কালের ব‍্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! বুঝলাম কঙ্কালের কথা কারোর আর মনে নেই কিংবা তার উপদ্রব আর নেই। তাহলে, অমলেশবাবু, আমার কথাটি ফুরোলো, বৃষ্টির দিনে ভুতুড়ে গল্পটি ভালোই জুড়ালো। কি বলেন?

অমলেশবাবু বেশ হেসেই বললেন, “তা তো বটেই, তা তো বটেই। আপনার গল্প বলে কথা ভয়েতে রোম খাঁড়া হয়ে গিয়েছিল মশাই।”

-আজ তবে উঠি। আবার গল্প হবে অন‍্য একদিন।

Exit mobile version