
গল্প- বিবাহ বার্ষিকী
বিবাহ বার্ষিকী
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙের আলোতে সেজে উঠেছে ‘প্রেমালয়’। দূর পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে সানাইয়ের সুমধুর সুর। লোকজনের সমাগমে গমগম করছে। বাড়ীর বাগানের একপ্রান্তে বুফে সিস্টেমের ব্যবস্থা। বাগানের দোলনাটা সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। তবে সেই দোলনাতে কচিকাঁচাদের ভীড় উপচে পড়ছে। হঠাৎ একটা সুরেলা কন্ঠের আওয়াজ মুহুর্তের মধ্যে সকলকে এক জায়গায় হাজির করলো। মাইক্রোফোন হাতে লং ফ্রক পরিহিতা, ফর্সা, সুন্দরী, লম্বা এক আকর্ষক তরুণী গেয়ে উঠলো, ‘এই তো হেথায়, কুজ্ঞছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে, এই জীবনে যে কটি দিন পাবো……’ গানখানি শেষ হতেই অনির্বাণ মুখার্জি ধুতির কোঁচা তুলে দ্রুত গতিতে এসে জড়িয়ে ধরে তার একমাত্র মেয়ে অহনাকে। হ্যাঁ, অহনা অনির্বাণ ও ইলার একমাত্র সন্তান। দেখতে হয়েছে একদম ইলার মতো। অহনার ইচ্ছাতেই এই পঁচিশ বছরে এই প্রথমবার এত ঘটা করে বিবাহ বার্ষিকী পালন করছে অনির্বাণ মুখার্জি।
বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের একজন নিষ্ক্রিয় সদস্য হলেন অনির্বাণ বাবু। ইলার ইচ্ছা শিরোধার্য করে এতগুলো বছর বেশ কাটিয়ে ফেললেন তিনি। ইলার ধারণা সে সুন্দরী বলেই বোধহয় অনির্বাণ বাবু তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের পর থেকে বাক্যহারা হয়ে গেছে। বিয়ের আগে ইলা অনির্বাণ বাবুকে স্পষ্টই বলেছিল যে সে একজন ছেলেকে ভালোবাসে। এই বিয়েতে তার মত নেই। একপ্রকার জোর করেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হচ্ছে। এই কথা শুনেও অনির্বাণ বাবু অম্লান বদনে ইলার সাথে সাতপাকে ঘুরলেন। শুধু কি ঘুরলেন এই পঁচিশ বছরেও সেই ঘোর এতটুকু কমলো না।
অনির্বাণ বাবুর মতো বেঁটে, কালো, ভুঁড়িওয়ালা মানুষ যদি ডানাকাটা পরীকে বিয়ে করতে পারে তাহলে তা তার কাছে লটারি জেতার মতো অবস্থা। বিয়ের পর যখন দু’ একবার নতুন বউকে নিয়ে বের হয়েছে তখন পাড়ার ছেলেদের টিটকারিও শুনতে হয়েছে প্রচুর। একবার তো শপিং মলে ইলার এক বান্ধবীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা ইলার। অনির্বাণের দু’হাত ভর্তি প্যাকেট আর ইলার হাতে একটা দামী ক্লাচ আর একটি দামী মোবাইল। বান্ধবীটি তো ইলাকে বলেই ফেললো ‘কী রে জিজুকে বাড়িতে রেখে কাজের লোক নিয়ে এসেছিস?’ অনির্বাণের মুখটা পাংশু বর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইলা তার বান্ধবীর কথার কোনো উত্তর না করে তাকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসে। কত হাসি, ঠাট্টা, কলেজের কথা হলো দুজনের মধ্যে। ইলা বারবার দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো যে তার থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষাটা দেওয়া হলো না। কিন্তু একবারের জন্য অনির্বাণের জন্য ইলার খারাপ লাগলো না। শুধু কি তাই এই ঘটনার গল্প সময়ে অসময়ে বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে পরিবেশন করে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের কাছে।এই রকম আরো কত ঘটনাই আছে যেটা প্রমাণ করে অনির্বাণ ইলার যোগ্য নয়।
এই পঁচিশটা বছরে অনির্বাণ বাবু এইটুকু বুঝেছেন যে ইলা বাহ্যিক আড়ম্বর নিয়ে বড্ড বেশী মেতে থাকতে ভালোবাসে। অনির্বাণ বাবু তাই নিজের ব্যবসা, লেখালেখি এইসব নিয়ে দিব্য থাকেন। কারণ তিনি জানেন ইলার মন পাওয়া তার কোন দিনই হবে না। তবুও সে মনে মনে আনন্দিত হয় যে সে তো ইলাকে ভালোবাসতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তো লিখেছিলেন ‘কাউকে ভালোবাসতে পারাটাই দূর্লভ’। তবে আজকে যে ঘটনাটা ঘটল যা অনির্বাণ বাবু স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। অতিথিদের হাত থেকে উপহার প্যাকেটগুলো নিতে নিতে ইলার বৌদি ইলাকে জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যাঁ রে, ঠাকুর জামাই তোকে কি উপহার দিলো?’ ইলা মুখ বেঁকিয়ে বলে ‘কী আর দেবে, প্রতি বছরের মতো খামে ভরে একটি করে কবিতা। তবে আজ এখনও খামটা আমার খুলে দেখা হয় নি।’
রাতে সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেলে ইলা ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বড্ড ভালোবাসা মাখা দৃষ্টি দিয়ে নিজের মুখে ময়েশ্চারাইজার লাগাতে লাগাতে ড্রয়ার থেকে টেনে বের করলো অনির্বাণের দেওয়া খামটা। অন্যবারের চেয়ে খামটা একটু ভারী লাগলো। খামটা ছিঁড়তেই বেরিয়ে এলো অষ্টাদশী ইলার লেখা বেশ কিছু প্রেমপত্র। ইলার ভিতরটা যেন শুকিয়ে এলো। তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে রুমের দরজাটা লক করে আসে। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ইলা যে চিঠি গুলো আব্বাসকে লিখেছিল সেই সব কটি চিঠি এই খামের মধ্যে আছে।কী সাংঘাতিক ভালোইবাসতো সে আব্বাসকে। কিন্তু এই চিঠিগুলো অনির্বাণ পেলো কী করে? নিজের মনকে বারবার প্রশ্ন করতে থাকে ইলা। তাহলে কী আব্বাস অনির্বাণকে এই চিঠিগুলো দিয়েছে? ইলার এই প্রথম নিজের ওপর ধিক্কার জন্মালো। সে ভাবতো আব্বাস তাকে নিখাদ ভালোবাসে। কিন্তু তাহলে এই চিঠিগুলো ইলার স্বামীর হাতে তুলে দিল কেন? আব্বাস তো একপ্রকার প্রতিশোধই নিতে চেয়েছিল ইলার সাথে। যাতে ইলার বিবাহিত জীবন ছারখার হয়ে যায়। অনেকগুলো চিঠির মধ্যে আব্বাসের হাতে লেখা একটি চিঠিও পেল ইলা। যাতে পরিষ্কার লেখা আছে ‘ইলা একটা দাম্ভিক মূর্খ মেয়ে। বহু পুরুষের মন নিয়ে খেলা করাই তার কাজ। আপনি অতি সজ্জন ব্যক্তি তাই বলছি এখনও সময় আছে আপনি ইলাকে পরিত্যাগ করলেই ভালো করবেন। ওর মতো মেয়েরা কখনও কাউকে সুখ দিতে পারে না।’ শেষের লাইনটা পড়তে পড়তে ইলার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। যে আব্বাসের জন্য অনির্বাণকে সে কোনোদিনই মনে স্থান দেয় নি সেই আব্বাস …….
কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপর ইলা।
দরজায় এসে টোকা মারতে লাগে অহনা। হাতে তার আইসক্রিমের বাটি। মা মা করে গলা ফাটানো সত্ত্বেও ইলা আজ দরজা খুললো না। একে একে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এসে হাঁক ডাক শুরু করে এবং সবশেষে অনির্বাণ বাবু এসে ডাকতেই ইলা দরজা খুলে দেয়। সকলের সামনেই ইলা হাতজোড় করে অনির্বাণের সামনে বসে পড়ে বলে ‘আমায় আপনি ক্ষমা করে দিন। এতো বছর ধরে আপনি যেভাবে আমায় আগলে রেখেছেন তার যোগ্য আমি নই। আমি আপনার বাইরেটাই শুধু দেখেছিলাম। আপনার মহৎ হৃদয়ের নাগালটুকুও কোনোদিন পাই নি। আপনার মতো মানুষের অর্ধাঙ্গিনী হবার কোন যোগ্যতা আমার নেই।’উপস্থিত বাড়ির লোকজন সব হতম্ভব। অহংকার,তেজ সবকিছুই আজ ইলার সাথে ভূলুণ্ঠিত। অনির্বাণ দুই বাহু দিয়ে ইলাকে তোলার চেষ্টা করে এবং বলে, ‘চেহারা, অর্থ দিয়ে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা আসে অন্তরের শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস থেকে। যেটা তুমি এতো বছর পর রপ্ত করতে পেরেছো।’ অহনা এসে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘তাহলে আজি পুরী যাওয়ার টিকিট বুক করি?’ ইলা লাজুক মুখে নববধূর মতো বলে ‘কী যে বলিস!’


5 Comments
Puja das bose
অসাধারণ লেখা, আমার বেশ লাগলো গো,এমন ভালোবাসা বড়ো বিরলতম,,,
জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী
বাহঃ ভালো লাগলো
Anonymous
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
Anonymous
অসাধারণ
Anonymous
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে