মৃত্যুর ওপারে
-অমল দাস
কোলকাতার চেনা ছকে রোজকার মতো যদি একটু রোড জ্যাম থাকতো, যদি ঘণ্টা খানেক অন্য কোথাও সময় কেটে যেত বা পিঠপিছে কেউ ছুরিকাঘাত করার জন্য তৈরি না থাকতো, তাহলে মোহিত উপাধ্যায়ের জীবনে হয়তো এমন অভিশাপের কালো দিন নেমে আসতো না, যা চিরতরে যন্ত্রণার কোটরে বদ্ধ করে তিল তিল করে অবক্ষয়ের পর্যায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল।
রাজ্য সরকারের বদান্যতায় অর্ধ-দিবস ছুটি পেয়ে বেলা একটার সময় সরকারী অফিস থেকে বেরিয়ে ধর্মতলার ‘ক্যাথে বার কাম রেস্টুরেন্ট’ থেকে বাটার নান্ ও চিকেন তন্দুর নেয় এবং ওয়াইন সপ্ থেকে দুটি বিয়ার ক্যান নিয়ে বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মোহিত। ইচ্ছে ছিল স্ত্রী সানন্দাকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। কিন্তু সারপ্রাইজ যে তার জন্যই অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছে, তা হয়তো মোহিত কস্মিনকালেও ভাবেনি।
কোনোরকম আওয়াজ না করেই পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খোলে সে। আস্তে আস্তে বেডরুমের দরজায় দাঁড়াতেই চক্ষু চরকগাছ! সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। স্ত্রী সানন্দা এক যুবকের সঙ্গে যৌন জ্বালায় নগ্ন হয়ে আষ্টে পৃষ্টে একাকার তারই ঘরে তারই বিছানায়। মোহিত নিমেষে জ্ঞান শূন্য ভাবলেশহীন নির্বাক হয়ে বসে পড়ে। তার নিজে হাতে সাজানো সোনার সংসার এক অকল্পিত আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। চোখের সামনে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। সমস্ত শরীর জুড়ে যে রানীর বসবাস, তার বাসর ঘরে অন্য ভ্রমরের আনাগোনা ।
মোহিতের হাতের থেকে খাবার পড়ে যায় মেঝেতে। সেই শব্দে নজর ঘোরাতেই সানন্দার মাথায় অকাল বজ্রপাত। সারা শরীর হতে আকস্মাৎ উত্তেজনার উত্তাপ উধাও হয়ে মেরুদেশীয় শীতলতা ছেয়ে যায়। বিছানা ছেড়ে একলাফে দাঁড়িয়ে পড়ে নির্বোধ ভাবে। সে যে উলঙ্গ, কাপড়টি টেনে জড়াবে সেই হুঁশও নেই। শান্ত সমুদ্রে ছিদ্র পথে জল ঢুকে নৌকা ডুবির মতো হারিয়ে গেছে। সে সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যুবকটি কোনমতে পোশাক পরতে পরতে মোহিতকে ডিঙিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। তাকে আটক করার কেউ নেই, তাকে প্রশ্নে জড়ানোরও কেউ নেই, মোহিতের এতই দুরাবস্থা!
জ্ঞান ফিরলে মোহিত বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে তার তলায় চুপ করে বসে থাকে। পড়ন্ত বেলায় এক বিধ্বংসী কাল বৈশাখী ঝড় যেন তার সমস্ত অস্তিত্ব চুরমার করে ধুলোয় মিশিয়ে গেছে। বুকের ত্বক ছিঁড়ে যেন হৃদয়ের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ছে। এই দগ্ধ যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে, মস্তিস্ক শান্ত করতেই হয়তো সে জলের তলায় বসেছে। সেই সুযোগে খোলা দরজা দিয়ে পথের কুকুর ঘরে ঢুকে খাবারের প্যাকেট মুখে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কোথাও সর্বনাশ তো কোথাও পৌষমাস।
গত দুবছরের বিবাহিত জীবনে বিনোদন থেকে আভিজাত্য, কেনাকাটা থেকে ঘুরতে যাওয়া, ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে ভালোবাসা দেওয়া কোন কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি, কোন অভিযোগেরও সুযোগ দেয় নি। তবু মোহিতের হৃদয়ে সুনন্দা বিশ্বাসঘাতকতার শাণিত ছুরি কি ভাবে পুঁতে দিলো তা ভাবাই দুষ্কর।
মোহিত এ বিষয়ে আর একটি কথাও বলেনি। এমন কি কিছু জানতেও চায়নি। সানন্দা অন্তঃস্বত্বা তাই তার কাজের সুবিধার জন্য একজন মহিলা রাখা হয়েছে। মোহিত পূর্বের মত সানন্দার সমস্ত প্রয়োজনীয়তা মেটাতে থাকে। সন্তান গর্ভে তার কোন সমস্যা না হয় সে বিষয়ে মোহিত যথেষ্ট যত্নবান। কেবল তার নিত্যনিয়মে কিছু বদল হয়েছে। সে রাতের বিছানাটি আলাদা করে নিয়েছে , খাবার বাইরেই খেয়ে আসে, প্রায় প্রতি রাতেই মদ্যপান করে। সে আর প্রয়োজন ব্যাতীত কথা বলেনা। অফিস ফিরে কখনো চপ, কখনো চাউমিন আর ঠাণ্ডা পানীয়তে ডুবে দুজনার হাসি ঠাট্টায় মসগুল হয়ে সান্ধ্য-আসর জমানো দিনগুলি আজ প্রায় ইতিহাস। ইতিহাস রবীন্দ্র সুরে সুর মিলিয়ে একই সুরে তাদের গেয়ে ওঠার সোহাগী মুহূর্তেরা। কল্পকাহিনীর চাদরে মুড়ে অযত্নে তুলে রাখা হয়েছে তাদের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের বিগত দিনের ইতিবৃত্ত।
সানন্দা অনুতপ্ত! অপরিচিত যুবকের সাথে পথের আলাপে ক্ষণিকের মোহে সে যে ঘৃণ্য অপরাধ করেছে তার কোন মাফ নেই ক্ষমা নেই। তবু সে চায় মোহিত তাকে শাসন করুক, তার সমস্ত ক্ষোভ উগড়ে দিক সম্মুখে। সে অন্তরে ক্ষতের দাগ আরও দৃঢ় না করে, যেন মানসিক ভাবে একটু হালকা হয়। দিনদিন মোহিতের শারীরিক অবক্ষয় সে ভালোই উপলব্ধি করছে। তাই সে অনুশোচনায় মর্মাহত। সানন্দা বহু চেষ্টা করে ক্ষমা প্রার্থী হয়ে এই যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেতে। কিন্তু মোহিত যে পাষাণ। তাকে কোন ভাবে তুলে এনে আর সমান্তরাল পথে বসানো গেলো না। একই ছাদের তলায় থেকেও দুটি মানুষ একে অপরের যদি উপস্থিতি অনুভব না করতে পারে, তার থেকে কঠিন যন্ত্রণা যে আর কিছু নেই তা ভুক্তভোগীরাই জানে।
সানন্দা মোহিতের জীবনে আর অভিশপ্ত হয়ে থাকতে চায় না। সে চলে যেতে চায় সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূরে। কিন্তু তার গর্ভের সন্তান বাধ সাধে। যে আগন্তুক, তার তো কোন দোষ নেই? তার উপর তো মোহিতেরই অধিকার। তাই মোহিতকে এই উপহার দিয়ে তার জীবন আঁধারে একটু আলোর সঞ্চার করে দিয়ে সে চলে যেতে চায় চিরতরে চির বিলীনের পথে।
সানন্দার গর্ভধারণ আজ প্রায় ন’মাসে পড়েছে সকাল থেকেই একটু হালকা ব্যথা ছিল। বেলা বাড়তেই তা বেড়ে যায়। অফিসে মোহিতের ফোন বেজে ওঠে, ওপ্রান্ত থেকে সানন্দার যন্ত্রণাদায়ক কণ্ঠস্বর “তুমি একটু তাড়াতাড়ি আসো, আমি আর পারছিনা কষ্ট হচ্ছে”।
মোহিত দেরি না করে তৎক্ষণাৎ একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।বাড়ি থেকে সানন্দাকে নিয়ে সোজা শিশুমঙ্গল মাতৃসদন হাসপাতালে পৌঁছে যায়। আজ মোহিতের জীবনে এক কাঙ্ক্ষিত প্রতীক্ষার অবসানের দিন। সে যেন এই দিনটার জন্যই অপেক্ষারত। তার চোখে মুখে পিতৃ স্নেহের উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠছে। সমস্ত আঁধার কেটে যেন এক আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে হৃদয়ে জুড়ে। কখন সেই শুভ সংবাদ এসে পৌঁছবে তার কানে… কখন..
নার্স এসে বলে গেল “আপনার পুত্র সন্তান হয়েছে, সানন্দার জ্ঞান ফেরেনি তবে চিন্তার নেই ভালো আছে”।নিমেষে এক আত্ম উৎফুল্লের প্রবাহ বইতে লাগলো মোহিতের সমস্ত শরীর জুড়ে। সে আনন্দের জোয়ারে ভেসে যেতে থাকে আপনার মনে। কখন সে পুত্রের কোমল হাতের স্পর্শ নেবে, কখন সে দুধের শিশুকে কোলে নেবে, কখন সে তাকে সোহাগ দিয়ে ভরিয়ে দেবে…
গত কয়েক মাসের ক্ষোভ বিক্ষোভ যেন আজ মলিন হয়ে গেছ। সমস্ত অনুরাগ ভুলে যেন আজ সে সানন্দাকে নিজের করে নিতে চাইছে। কিন্তু বিধাতা কি চায়, সে খবর কেই-বা জানে। দীর্ঘ দিনের জমে থাকা যন্ত্রণা আগ্নেয়শিলার মতন স্তরে স্তরে চাদর বিছিয়ে রেখেছিল হৃদয়ে। সে আবরণ ভেদ করে খুশির আনন্দে আপ্লুত হয়ে উজ্জীবিত হওয়ার ক্ষমতা হয়তো তার আর অবশিষ্ট ছিল না। সে হৃদাক্রান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তড়িঘড়ি লোকজন ডাক্তার ডেকে আনলেও শেষ রক্ষা হল না। যে বিরহের কালি সে আজ মুছে ফেলতে চেয়েছিল তার ঔরসজাতের আগমনে, তা আর পূর্ণতা পেলো না বিদায়ী দিনের আঙিনায়। কালের দোষের কাছে পরিণতি পরাজিত! সে আজ দৃশ্যের বাইরে।
সানন্দার যখন জ্ঞান ফেরে পাশে শুধু তার ফুটফুটে সদ্যজাত শিশু। সানন্দার চোখ মোহিতকে খুঁজে চলে এদিক সেদিক চাতকের মতো। না! কোথাও নেই…
“সেকি তবে আজও বিরহ ত্যাগ করতে পারেনি। পারবে না আমায় ক্ষমা করতে? সে কি একটিবারও তার সন্তানকে স্নেহ দেবে না?” এই ভাবনারা যখন তাকে ঘিরে ধরেছিল তখন সেই বিদীর্ণ দুঃসংবাদটিও কানে পৌঁছাতে আর দেরি সইল না। বেডেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সানন্দা গভীর ভাবে। সে যে আজও শাপ মুক্ত হল না। এই সন্তান মোহিতের হাতে তুলে সে যে মুক্তি কামনা করেছিল তা অধরাই রয়ে গেল। নবজাতক বুকে সানন্দা একা, অপরাধী মেঘে ঢাকা।মোহিতও যেন তাকে এ-জীবনের মত দায়ী রেখে চলে গেল অলিখিত দেশে।