Site icon আলাপী মন

গল্প- হারিয়ে খুঁজি

হারিয়ে খুঁজি
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

ভুলে যাবো বললেই কি আর ভুলে থাকা যায়? দূরে থাকা মানেই কি আর সত্যিই দূরে থাকা? লক্ষ যোজন দূরে থেকেও তো মনে মনে কাছাকাছি থাকা যায়…রাখা যায় তাকে মনের ভিতর ঘরে। মনে হয়, এই তো সে…তাকে লুকিয়ে রেখেছি মনের সিন্দুকে।

তোমাকে ভুলে যাবো মুখে বললেও, রাতুল তোমাকে একটা দিনের জন্যও ভুলতে পারেনি তোমার মল্লিকা। তোমাকে ভুলতে গেলে তো আমার নিজেকেই ভুলতে হ’তো…ভুলতে হতো আমার সবকিছু… তোমার খুনসুটি, আদর, ভাব –স-অ-ব সবকিছু। আসলে এগুলোই তো আমি বাঁচিয়ে রেখেছি প্রতিদিন, মনের ভিতর অতিযত্নে।

ছুটির দিনে ট্রামে পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে আর বাদামভাজা চিবোতে চিবোতে পার করেছি কত সুখের দিন! লেকের জলে বোটিং, পুজো শপিং, পাল্লা দিয়ে ফুচকা খাওয়া–আমাকে হারাতে কখন যেন চোখের ইশারায় ফুচকাওয়ালাকে ঝাল দিয়ে দিতে বলতে! তুমি জানতে আমি বেশী ঝাল খেতে পারি না। বাপরে কী ঝাল!! আমি তখন একেবারে চোখের জলে নাকের জলে… পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিতে আবার পরক্ষণেই রুমাল নোংরা করে দিয়েছি বলে চেঁচাতে! অফিস ফেরত চায়ের স্টলে চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। তুমি বলতে প্রজাপতি গায়ে বসলে বিয়ের ফুল ফোটে আর প্রজাপতি বিস্কুট খেলে কি হয়? সত্যি কত কথাই না বলতে তুমি! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে… আমার বড় বড় চোখের পাতা খুললে না’কি তোমার মনে হয় পদ্মফুল পাপড়ি মেলছে! আমিও তোমার দুষ্টুমি ভরা চোখে নিজেকে খুঁজে পেতাম।

অবশ্য তোমার এসব মনে পড়বে কেনো?এসব শুধুই আমার একার অনুভব…শুধুই আমার একার।

তোমার সাথে বিয়ে হবার পরেই সবকিছু যেন কেমন পাল্টে গেলো। তুমি তো জানতে বাবা মারা যাবার পর বাবার চাকরীটাই আমি পেয়েছিলাম। সংসারের হালও তো ধরতে হবে। বোন তখন পড়াশোনা করছে। বাবার অফিসে লিখিত দস্তখতে অঙ্গীকার করেছিলাম যে মা আর বোনকে দেখবো।ওদের আমি না’ দেখলে কে দেখতো বলো?

তোমার বাড়ির কারোর আমাকে পছন্দ হয়নি…একে রঙ কালো…তারপর কন্যাপণ দিতে পারিনি আমরা। তোমার হয়তো আরো অনেক ভালো বিয়ে হতো! আমি চুপচাপ নিজের মনে থাকতাম বলে আমার নিন্দে হতো-আমি না’কি একাচোরা, মিশুকে নই…স্বার্থপর। তুমিও আমাকে বুঝতে না। তুমি তখন কাজের চাপ,অফিসের ঝামেলা, সাংসারিক দায়িত্ব কর্তব্য সামলে সংসারের নানা কূটকচালিতে বিপর্যস্ত হতে.. নানা মিথ্যে বানানো গল্পে উত্তেজিত হতে।আমাকে একবারও কিছু জিজ্ঞাসা না করেই মেজাজ দেখাতে! আমার খুব অভিমান হতো।
সংসারে দেখতাম দখলদারির গেলো গেলো ভাব। আমি বুঝতাম একটা ছেলের বিয়ের পরে দু’দিক সামলে চলাটা কত্ত মুশকিলের।নানা কথা শুনেও কখনো তুমি প্রতিবাদ করতে না…উলটে আমাকেই কথা শোনাতে।তোমাকে কিছু বললেই শাশুড়ীমা তোমার পক্ষ নিয়েই আমাকে দোষারোপ করতেন… বলতেন আমার ছেলেটাকে একটু শান্তি দিতে পারোনা?

আমিই তোমার জীবনে অশান্তির মূল ছিলাম…তাই না? এখন তুমি নিশ্চয়ই খুব শান্তিতে আছো? বাড়ির পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছো?

আমি তো মিলে থাকার চেষ্টা কম করিনি।অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরেই রান্নাঘরে চা, জলখাবার, রাতের রান্না, পরের দিনের অফিসের টিফিন সব রেডী করতাম। অফিস থেকে ফেরার পথে দোকান বাজার, টুকিটাকি…তাও করতাম। সংসারে টাকাও দিতাম। তাও আমার বাড়ি যাওয়া…বাড়িতে টাকা দেওয়া নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে।

আমি তো কখনো কোনদিন তোমাদের কাছে কিচ্ছু চাইনি। একটু মানসিক শান্তি… সেটাও কী দিতে পেরেছো তোমরা? শুধু চোখের জল ফেলেছি। একটু প্রাণ খুলে হাসতে, আনন্দ করতেও পারি নি। পিসতুতো দেওর এসে মাঝেমাঝে গল্প করতো…ওর মজার মজার কথায় একটু হাসতাম…তা নিয়েও কত কথা!

রোজ রোজ ঝগড়া অশান্তিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। তুমি একদিন বললে, আমার সংসারে না’কি মন নেই…আমরা আলাদা থাকলেই না’কি ভালো থাকবো। তাই এই সমঝোতা–এই বিচ্ছেদ।

কিন্তু এই ভাইরাস ছড়ানো পৃথিবীতে বড্ড চিন্তা হচ্ছে তোমার জন্য। কে জানে কেমন আছো তুমি!
প্রথম দিকে ভাবতাম তুমি ফোন করবে।তারপর একদিন আমার সিমটাই ফেলে দিলাম। এখন আমার অন্য নাম্বার। তুমি নিশ্চয়ই পাল্টাও নি তোমার নম্বর। তোমাকে আমি ফোন করবোই…কথা বলবে তো তুমি?জানিনা হয়তো আমার মুখটাই আজ ঝাপসা তোমার কাছে।

জানো অনেক আঘাত, অপমান সহ্য করে, বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে আজ বুঝেছি… সম্পর্ক নেই, যোগাযোগ নেই কিন্তু প্রেম আছে লুকিয়ে কোথাও।

Exit mobile version