Site icon আলাপী মন

গল্প- স্বপ্নপূরণ

স্বপ্নপূরণ

-অর্পিতা ঘোষ 

 

 

 

অস্মি রায় খাতুন, সরকারি স্কুলের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষিকা। তবে এই যাত্রা পথটা একটুও মসৃন ছিল না অস্মির।যৌথপরিবারে জন্মসূত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে ওকে । বাবা ছিল সরকারি অফিসের সামান্য কেরাণী আর মা গৃহবধূ। বাড়িতে ওরা তিনজন ছাড়াও জ্যাঠা,জ্যাঠিমা, দাদা, কাকা,কাকিমা, দাদু, ঠাকুমা, ভাই মিলে প্রায় এগারো জন সদস্য। এতো জনের মধ্যে বাবা মা আলাদা করে ওর জন্য কিছুই করতে পারেনি। অবশ্য করতে পারেনি ঠিক তা নয় বরং বলা যায় করতে দেয়নি। এমনকি ওর জন্মদিন পর্যন্ত কখনো হয়নি। ঠাকুমা বারণ করতেন যে, মেয়ে মানুষের জন্মদিনের জন্য কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করার কোনো দরকার নেই। ওতে নাকি মেয়ে চিরকাল দুঃখী হয় । ওর মা মানে সুনন্দাদেবী কিছুই বলতে পারতো না শুধু আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতো আড়ালে । আসলে অস্মিকে ঠাকুমা মোটেও  পছন্দ করতো না সেটা সবাই জানতো । যখন অস্মি জন্মেছিলো তখন নাকি উনি দেখতেও যাননি । ওনার নাকি ছেলে সন্তান বেশি প্ৰিয়।  নিজে মেয়ে হয়ে বিয়ের আগে বা পরে কোনোদিন সুখ পাননি বলে নিজের বৌমা বা নাতনির সুখও কোনোভাবেই সহ্য করতে পারতেন না।  আর ঠাকুমার দোসর ছিল বড়বৌ মানে অস্মির জেঠিমা। তিনি তো যাচ্ছেতাই ভাবে অপমানও করতো অস্মির মাকে।সবটাই মুখ বুজে মেনে নিতো সুনন্দাদেবী আর নিখিলবাবু। কারণ তিনি তার দাদা বা ভাইয়ের থেকে কম রোজগার করতেন । অস্মি নিজেও জানে সবাই দাদাকে ভীষণ স্নেহ করে, বাড়ির বড়ো ছেলে বলে কথা ! অস্মির প্রথম প্রথম খুব কষ্ট লাগত বিশেষ করে যখন দেখতো দাদা, ভাই এর জন্মদিন পালন হচ্ছে অথচ ওর হচ্ছে না তখন । এখন অবশ্য ওসব সয়ে গেছে।  এখন ওর ধ্যান জ্ঞান সব লেখাপড়া, ওর স্বপ্ন শিক্ষিকা হওয়ার। কিন্তু ওই ব্যাপারেও তথৈবচ অবস্থা। বাবা মা চাইলেও বাকি সকলের এক কথা, বেশি পড়লে বিয়ে হবে না তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বড়োরা। বাবা ও কিছু বলতে পারছিলো না পাছে পরে যদি বিয়ে না হয় কারণ তার মেয়ে মোটেও ডানাকাটা পরী নয় আবার তার পকেটের ও কোনো জোর নেই।  ওদিকে অস্মি তো কিছুতেই বিয়ে করবে না। সে একরকম জোর করেই কলেজে পড়া শুরু করে। এই নিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো অশান্তি লেগেই থাকতো।  নিখিলবাবু তার মেয়েকে কিছু না বললেও সুনন্দাদেবী রোজই মেয়েকে বলতেন এই অশান্তি সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।তিনি আরো বলতেন যে অস্মি চাইলে বাবা মা কে একটু শান্তি দিতে পারতো বিয়েটা করে, কিন্তু তা তো সে করবে না বরং জ্বালিয়ে মারবে।  অস্মি নিজেও প্রতিদিনের একঘেয়ে ঝামেলায় অতিষ্ট হয়ে যখন পড়াশুনা ছেড়ে বিয়ের কথা ভাবছিলো ঠিক তখনই পরিচয় হয় ইতিহাস বিভাগের নতুন অধ্যাপক শাহিদ খানের সাথে। কি সুন্দর তার পড়ানোর ধরণ।  দেখতে মোটামুটি হলেও ব্যবহার অমায়িক।  অস্মি ধীরে ধীরে যেন ওনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। পড়ার ছুতোয় ওরা একে ওপরের কাছে চলে আসে নিজেদের অজান্তেই।
হঠাৎ একদিন বাড়িতে জানাজানি হলে অস্মির বাড়ির লোকজন ওর বাবা মাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে। অপমানের এরম সুবর্ণ সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চায়নি তখন । সে রাতেই অস্মি শাহিদের সাথে বাড়ি ছাড়ে।শাহিদ ও সবকিছু শুনে অস্মিকেই সাপোর্ট করে । ওরা বিয়ে করার কথা ভেবে দুবাড়ির লোকজনকে জানায় তবে অস্মির বাড়ির কেউ আসেনি।  এমনকি মা বাবাও তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে।
ওদিকে শাহিদের সাথে বিয়ের পরও অস্মি পড়াশুনাটা চালিয়ে যায়। শাহিদ নিজে একজন প্রফেসর হওয়ায় অস্মিকে উৎসাহ দিতে একটুও কার্পণ্য করেনি।  বাবা মায়ের জন্য মন খারাপ করতো ঠিকই তবে নিজেকে সকলের সামনে প্রতিষ্ঠিত করার অদম্য জেদ তাকে সব দুঃখ, কষ্ট ভুলতে সাহায্য করেছিল।  স্বামীর তত্ত্বাবধানে থেকে ধীরে ধীরে কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটি, তারপর বি.এড করে অস্মি। এরপর অস্মি আর শাহিদের জীবনে নতুন অতিথি আসে, ওদের ছোট্ট রাজকন্যা অনুস্কা। নতুন অতিথির আগমনে ঘর জুড়ে খুশি ছলকে পড়তে থাকে । অস্মি অনুষ্কাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে সবকিছুর চাপে পড়াশুনাটা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় বছর তিনেক পর শাহিদের জন্মদিনের দিন শাহিদ ওর কাছে এক বিশেষ উপহার চায়।

-তুমি আবার পড়াশুনা শুরু করো অস্মি আর নিজের স্বপ্নটা পূরণ করো।  এবার তো মেয়ে একটু বড়ো হয়েছে তুমি নিজের জন্য সময় বার করতে পারবে চেষ্টা করলে। প্রয়োজনে আমি কাজের জন্য আরেকজনকে রাখছি ।

– আমি আর স্বপ্ন দেখি না শাহিদ কারণ স্বপ্ন কখনো সত্যি হয়না, দেখোনা মা বাবাও আজ আমাদের পাশে নেই। আর স্বপ্ন দেখে কি হবে বলো?

– তুমি নিজে এতো পড়াশোনা করে এই কথা বলছো? তুমি আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি কালাম স্যারের কথা জানোনা? উনি বলেছেন, “স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে।” অস্মি সব বাধা তোমাকে পেরোতেই হবে। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি ।

হ্যা অস্মি আবার শুরু করে নতুন পথচলা। এরপর প্রায় তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে সার্থক হয়। এর মাঝে শাহিদের চেষ্টায় অস্মির মা বাবার সাথেও সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায়। ওনারাও ছোট্ট নাতনিকে দেখে আর অভিমান করে থাকতে পারেননি । শাহিদ কে মেনে নেয়। স্বামীর ভালোবাসা, মনের জোর আর সবসময় ওর পাশে থাকা অস্মির জীবন পাল্টে দেয়। এরপর ওদের সাথে ওর মা বাবা ও থাকতে শুরু করে।  এখন ওদের ফ্ল্যাটে জন্মদিন পালিত হয়, বেলুন লাগানো হয়, কেক কাটা হয়। অস্মি তার সকল অপূর্ণ সাধ তার মেয়েকে দিয়ে পূর্ণ করতে চায়।  এখন এই পাঁচজনের সংসারে কেবল আনন্দ, ভালোবাসা বিরাজ করে সর্বদা।

Exit mobile version