মায়ের লেখা শেষ চিঠি,
– পূজা দাস বোস
মায়ের হাতে লেখা সেই আধখানা চিঠি, হয়তো মৃত্যুর কয়েকটা দিন আগের হবে।তাই তো লেখাগুলো অসম্পূর্ণ আধখানা গল্প হয়ে আছে। চিঠির পাতায় মায়ের একমাত্র কন্যা সন্তানটির স্থান বেশী ছিল। মায়ের যতো ভালো লাগা, খারাপ লাগা, কষ্ট পাওয়া সবই ছিল তার মেয়েকে ঘিরে। মায়ের সেই প্রথম সন্তান প্রসব যন্ত্রণার আনন্দ, তার বেড়ে ওঠা, তার ছোট্ট ছোট্ট হাতে জড়িয়ে ধরা, কদিন পরে সেই মেয়েকে ভাষা জ্ঞান দেওয়া, তারপর সেই অক্ষর চেনানো, উফ সেই সময়টা সেসব নিয়ে কী ঝক্কি না ছিল।মায়ের রাতের ঘুম কামাই হতো, তার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, তার মেয়ে বড়ো হবে, জজ ব্যারিস্টার হবে, এক রাজপুত্রের মতো বর হবে, যে তার মেয়েকে অনেক ভালোবাসবে সুখে রাখবে। চিঠি পড়তে গিয়ে মেয়ের চোখ তখন ক্লান্ত হয়ে আসে, মনে মনে ভাবে একি মায়ের শেষ সময়টা মা কেন এসব লিখে গেছেন, মায়ের তো কথা বলার কতো কিছু ছিল, এতো কোন ছোটবেলাকার কথা, তবে কি মা আমার জন্য কি করেছেন তাই বলতে চাইলেন, না না তা কেন মা’তো ভালোবাসার কথাই লিখে গেছেন। মেয়ে তখন মনস্থির করে পরেরটুকু পড়তে লাগে।এবার দেখে অন্য রকম কিছু লেখা আছে, আজ তোর কথা খুব মনে পড়ে, নিজেকে বড়ো একা একা লাগে, শরীরটা আর আগের মতো দেয়না, খাবারটুকুও খেতে পারিনা হাত কাঁপে। সারাদিন শুয়ে থাকি আর তোর কথা ভাবি, তুই আবার কবে দেখতে আসবি, জানি তুই এখন অনেক ব্যস্ত, তোর মেয়ে, তোর বর, তারপর তোর নিজের চাকরি, তোর তো নিজেরই এখন কতো বড়ো একটা জগৎ। আমি তো সারা জীবন এই চেয়েছিলাম। কিন্তু কি করি মন যে মানে না, মনে হয় মৃত্যুর শেষ কটা দিন যদি তোকে কাছে পাই, মাঝে মাঝে হলেই হতো। কোনো একটা দিনের একটা বেলা, মা মেয়ে দু’জনে মিলে একসাথে হারিয়ে যেতাম ওই পুরোনো দিনগুলিতে, সেই দিনটা যখন আমাদের না কোনো দূরত্ব ছিল, না কোনো শর্ত।
শুধু আমি তুই দুজন দুজনের জন্য বাঁচতাম। তুই ডাক্তার পাঠিয়েছিলিস দেখে গেছে, জানিস মা কতোগুলো কি সব পরীক্ষাও করলো, তার দুদিন বাদে তোর পাঠানো ডাক্তার, মুখ কালো করে এসে বলে কিছু বলার আছে, তোমার মেয়েকে ফোনে পাচ্ছি না। আমি বললাম আমাকে বলো আমি ফোনে পেলে বলে দেবো। ডাক্তার লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, মাসিমা তুমি আর কয়েকটা মাস আছো আমাদের মাঝে, তোমার আয়ু ফুরিয়েছে তোমার যে মারণ রোগ ক্যান্সার হয়েছে। আমি বললাম, ওহ্.. তাই বুঝি তা বেশ করেছো একথা আমাকে বলে। আমার মেয়েকে বলোনা কিন্তু, তুমি তো বললে কটা দিন আছি, এ- কদিন আর ওকে জ্বালাবো না ওকে ডেকে, শুধু শুধু দৌড়ঝাঁপ হবে, তুমি বরং এসো এখন পরে কথা হবে। বুঝলাম ডাক্তারও খানিকটা অবাক হলো আমাকে দেখে। ডাক্তার গেলে শেষে দরজা দিয়ে ঘরে ফিরে, সেই তোর আমার তোর বাবার বাঁধানো ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম খানিকটা স্থির হয়ে, কয়েক ফোঁটা জল পড়লো চোখের পাতা ফেলার পরে। মনে পড়লো আমার এই শরীরের একদিন কতো যত্ন ছিল, একটু কিছু হলে আগে তোর বাবা ডাক্তার বাড়িতে আনতো।শেষ যেদিন চোখ বুঝলো তোর বাবা, তার কিছু দিন আগে হবে, তরকারি কাটতে গিয়ে আঙুল একটু কেটেছিল, উফ কি চিৎকার কতো বকা, তারপর ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে, সেদিন জানিস নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিল আমাকে। আর আজ আমার সেই শরীরে এতোবড়ো রোগের বাসা হলো, আমি জানতেও পারলাম খানিক আগে। আমি জানি তুই এখন কাঁদছিস অঝোরে, কি করবি আর চোখের জল ফেলে..আমি এখন ভালোই আছি তোর বাবার সঙ্গে।
চিঠির অনেকগুলো অক্ষর অস্পষ্ট হলো, মেয়েটার চোখের জলে, মেয়েটা ধপ করে বসে পড়লো। রজনীগন্ধা মালা আর চন্দনে খুব সুন্দর করে সাজানো মায়ের ছবির সামনে, মেয়েটির হাত থেকে চিঠিটা মেঝেতে পড়ে গেলো। দু’চোখের জল আর কান্না ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলতে লাগলো, মা শুনতে পাচ্ছো আমি এসেছি, চলো না আমরা দুজনেই হারিয়ে যাই সেই ফেলে আসা পুরোনো দিনগুলিতে।