Site icon আলাপী মন

গল্প- থাপ্পড়

থাপ্পড়
– জয়ন্ত সাহা

দুর্গা মাসি আমার চেনা। বলতে গেলে সাত কূলে কেউ নেই। চাকদা স্টেশনে বিকেলের দিকে সবজি বেচে। সকালের দিকটা পোস্ট অফিস মোড়ে ফুল নিয়ে বসে। আসে সেই কাকভোরে বিষ্ণুপুর গ্রাম থেকে। বেচাকেনা সেরে রাত আটটার মধ্যে বাড়ি ফেরে। আমি ডেলি পাষণ্ড। মানে ডেলি প্যাসেঞ্জার ।সকালে বের হই আর গলদঘর্ম হয়ে ওই সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরি।
ট্রেন থেকে নেমে হালকা কিছু বাজার করার থাকে। বেশ মনে আছে কোনো একদিন মাসি প্রথম আমায় “এই ছেলে” বলে ডেকে একগোছা শাকপাতা ধরিয়ে দেয়। “বাড়ি নিয়ে যা একদম টাটকা। সিংহের হাট থেকে বিকেলেই কেনা। বৌমাকে ভালো করে রাঁধতে বলিস। খেয়ে তৃপ্তি পাবি।” এভাবেই শাক সবজি কিনতে কিনতে মাসির সঙ্গে একটা পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। তাকে বরাবরই আমার অন্য রকম লাগতো। চটুল কথাবার্তা নেই, পরিপাটি বেশ গোছানো আচরণ। গভীর আত্মসম্মানবোধ।কোনোদিন কারোর কাছে কিছু চাইতে দেখি নি। নিজের রোজগারটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত। মাঝেমধ্যে সকালের ফুলটাও দুর্গা মাসির কাছ থেকে নিয়ে আসতাম।
একদিন তুমুল বৃষ্টিতে দেখি মাসি একটা প্লাস্টিক মাথায় দিয়ে সবজি সামলে বসে আছে। সবে ট্রেন থেকে নামছি। ওই দৃশ্য দেখে ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। কোনোক্রমে আমি আর মাসি ছাতির তলায় দাঁড়াই। অনেকদিন বাড়ির কথা পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করেছি। “তোকে একদিন বুঝিয়ে বলব” বলে এড়িয়ে গেছে কতদিন।শুধু বলতো,”লিখবি আমার জীবনকথা !দেখবি কত মানুষ তোর বই কিনবে” বলে হো হো করে সে কি হাসি। বুঝতাম দুর্গা মাসির সেই হাসির আড়ালে অনেক আর্তনাদ, রহস্য লুকিয়ে আছে।
বিশ্বাস করুন, এক কাপ চা পর্যন্ত কখনো মাসিকে খাওয়াতে পারিনি। বরং দু’টো টোস্ট বিস্কুটের স্মৃতি আমার এখনো মনে আছে।প্রায় জোর করে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল মাসি। আমার সঙ্গে দেখা হলেই একগাল হাসি। সেই হাসি আমার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিত। এতো সংগ্রাম, এতো লড়াই তবু হাসি মুখে লেগেই থাকত। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসতো আমার। এভাবেই দিন সপ্তাহ মাস কাটছিল দুর্গা মাসির। আমারও।লক ডাউন সেই ছন্দ এক লহমায় ভেঙে দিলো। ট্রেন বন্ধ। সবজি নিয়ে পুলিশ কোথাও বসতে দিচ্ছে না। সকালে ফুল নিয়ে বসতে গেলে হাজার বাহানা। মাসির পেটে দানাপানি বন্ধ হবার যোগাড়। এখন তো ঘুরে ঘুরে ফুল বেলপাতা বিক্রি করে।
সে দিন দুপুরের খাওয়ার পর পেল্লায় একটা ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি। লক ডাউনের বাজার।সারাদিন গৃহবন্দি। সময় আর কাটতেই চাইছে না। সকালে তারাপদ রায়ের “কাণ্ডজ্ঞান” খোশমেজাজে পড়েছি। নিম্নচাপের দৌলতে ভরা বৈশাখেও ঠাণ্ডা অনুভূতি। শুতে যাব হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ। ভাবলাম ফেরিওলা অথবা কেউ সাহায্য চাইতে এসেছে। দরজা খুলে দেখি পুলিশ। একটু চমকে গেছি। ঘাবড়াই নি। থানার সামনেই বাড়ি। পুলিশের বড় বাবু, ছোট বাবু আমায় সবাই চেনে। ওই একটু সোশ্যাল ওয়ার্ক করি তো! বইমেলা, রক্তদান শিবির, সামাজিক অনুষ্ঠানে যাই, কবিতা পড়ি আমাকে সবাই চেনে।
” আপনি সুকান্ত বাবু?”
” হ্যাঁ, কেন বলুনতো?”
“দূর্গা মাসি বলে কাউকে চেনেন?”
“দুর্গা মাসি!” একটু থমকে বলি,”ঐ ফুল বিক্রি করে, তার কথা বলছেন!”
” হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওনার কথাই বলছি। উনি আজ সকালে মারা গেছেন।
সকাল দশটা নাগাদ ফুল বিক্রির সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে ওখানকার ছেলেরাই হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, হার্ট অ্যাটাক।”
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে গেছি।গতকাল তার সঙ্গে কথা হলো। আজই মাসি বাড়িতে আসতে চেয়েছিল। বলেছিলাম, লকডাউন মিটে গেলে আমি তোমাকে নিয়ে আসব।
এক পুলিশ অফিসার বললেন, “আপনার নাম ঠিকানা লেখা একটা খাম মাসি রেখে গেছে। আপনাকে আমরা তো চিনি তাই দিতে আসলাম।”
“আমার নামে খাম! কই দেখি?”
পুলিশের সামনেই খামটা খুললাম। দেখি পাঁচশ টাকার দু’টো নোট। আর কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা ছোট্ট একটা চিঠি।
“বাবা সুকান্ত, তোমাকে বিরক্তই করছি। কষ্ট করে এই সামান্য টাকা জমিয়েছি। মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা আমি নিজের চোখে দেখেছি।তোমার পছন্দের দুর্গা মাসিদের জন্য এই টাকাটা খরচ করো। জানি এতে কিছু হয়না, কিন্তু আমার মনটা তো শান্ত হবে ! দু’দিন দু’টো করে খেতে পারবে। আমার শরীর তো ভালো নয়, কখন কি হয়ে যায়, তাই টাকাটা যত্ন করে সরিয়ে রেখেছি। তোমরা ভালো থেকো বাবা।”
ইতি, দুর্গা মাসি
এত বড় থাপ্পড় জীবনে কখনো খাইনি। খুব লেগেছিল তখন। কয়েক মুহূর্ত চিনতে দেরী হবার অপরাধ আমাকে ক্ষতবিক্ষত করলো।

Exit mobile version