পথের শেষে….
– রাখী চক্রবর্তী
চারদিক অন্ধকার, গুমোট গন্ধতে গরাদের ভেতরটা ভরে গেছে। রুমু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে গরাদের ওপারে। পরপর তিনটে বিশাল বড় তালা ঝুলছে গরাদের গ্রিলে। লোহার রডগুলো এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে যে মাছি পর্যন্ত গলতে পারবে না। বিশেষ অতিথির জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা ।সামনের গরাদ থেকে কয়েদিরা বলছে। কয়েদি রুমুকে আলাদা ভাবে রাখা হয়েছে তাই। মা বাবা ভাই এই নিয়েই ওর পরিবার ছিল। বড়লোকের বিটি বলতো রুমুকে, ওর বন্ধুরা।
ও মা, মা! কাল রাতের ঘটনা মামা মাসিদের ফোন করে বললে না তো?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ বলবো,
– এখুনি বলো, এই নাও ফোন।
রুমুর মা ফোন নিয়ে ওর মাসিকে ফোন করে বললো, ‘জানিস তো রুমু ঘুমের ঘোরে রাতের বেলায় কি সব কাণ্ড করছে। কখনও রান্না ঘরে কুটনো কুটছে কখনও ঘর মুছছে অদ্ভুত সব কাণ্ড করছে। আবার বিড়বিড় করে কি সব বকছে, কখনও আবার ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।’
ফোনের ওপার থেকে রুমুর মাসি বললো,’সে কি রে!’
– হ্যাঁ রে কি মুশকিলে পড়লাম বলতো? রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারছি না ওর জন্য। ভোর বেলায় চোখ ধরে আসে। সকাল বেলায় আবার তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হয় আমাদের। দু’দিন অফিসে যাইনি।সবচেয়ে বড় কথা রুমু নাকি কিছুই জানে না। আমি বললেই ও বলে রাতে ঘুমের ঘোরে কি করে চলি মা? আমি সবটা বললে তখন বলে জানে ও কি কি করেছে ঘুমের ঘোরে।’
– চিন্তা করিস না। নজরে রাখিস রুমুকে।
রুনুর মা ফোন কেটে দিল।
রুমু এবার ওর মামার বাড়িতে ফোন করে ফোন মার হাতে ধরিয়ে দিল।
যথারীতি একই কথা ওর মামাকে বলল রুমুর মা।
রুমু কলেজে পড়ে। ফাস্ট ইয়ার। বাংলাতে হর্ন। মানে বাংলাতে অনার্স। ও অনার্সকে হর্ন বলতে অভ্যস্ত।বড়লোক বাবা মার অবাধ্য মেয়ে রুমু। পড়া কম সাজগোজের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়।রবিবার বা ছুটির দিন ওর খুব অসুবিধা হয়।মা বাবা সারাক্ষণ নজরদারি করে ওর ওপর। ডিসগাসটিং বলে খাটের ওপর শুয়ে পড়ে। রুমুর ভাই অর্ক খুব ভালো স্টুডেন্ট ক্লাস টেনে পড়ে। দিদির জন্য খুব চিন্তা হয় ওর। দিদির লাইফস্টাইলটা যদি এখন না বদলানো যায় তাহলে দিদি ভালভাবে বাঁচতে পারবে না। অর্ক নীলের ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে রুমু ভাইকে ধমকে চুপ করিয়ে দেয়। নীল রুমুর বেস্ট ফ্রেন্ড।
নীলকে ওদের পরিবারের কেউ পছন্দ করে না। তবুও নীল আসবেই। রুমুর মা বাবা রুমুকে অনেক বুঝিয়ে নীলের এ বাড়িতে আসা বন্ধ করেছে ।
রুমু এক মাস হল খুব ভালো মেয়ে হয়ে গেছে। মা বাবা ভাই পরিবারকে নিয়ে বেশ ভালো আছে। বেরাতে যাচ্ছে একসঙ্গে।হোটেলে যাচ্ছে একসঙ্গে। অর্ক খুব খুশি দিদির এই পরিবর্তনে। রুমুকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলো। পছন্দও হলো। দু’ পরিবার মিলে বিয়ের দিন ঠিক করলো। রুমুকে বেশ খুশি দেখাচ্ছিল সেদিন।
রুমুর মা বললো, দেখো সোনা দু’দিন পর এই পরিবার ছেড়ে তুমি অন্য পরিবারে যাবে তোমাকে দু’টো পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে হবে। তুমি যেমন আমাদের পরিবারের রাণী তেমনি ওই পরিবারের কুলবধু হয়ে ঐ সংসারে পা রাখবে তুমি।
রুমু মুচকি হেসে বললো,জী হাঁ মামমি জী,
বিয়ের এক সপ্তাহ বাকি। রুমুদের বাড়িতে পুলিশ এলো। রুমুদের সোসাইটির সবাই অবাক হয়ে গেল। পরপর তিনটে খুন। এক রাতে। রুমু অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে, হাত ভর্তি রক্ত। রুমুর মামা, মাসি সবাই এলো। ডাক্তার রুমুকে পরীক্ষা করে বললো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিল রুমু। এখন ও পুরো সুস্থ আছে।
ছুরিটার ফিংগার প্রিন্ট নেওয়া হলো। রুমুর ফিংগার প্রিন্ট নেওয়া হলো। খুনের কিনারা একনিমেষে হয়ে গেল নিজের অজান্তে রুমু ঘুমের ঘোরে তিনটে মার্ডার করেছে।
ডাক্তারি ভাষায় যাকে প্যারাসমনিয়া বলে।সমনামবুলিজম বলা হয় কোন কোন ক্ষেত্রে, আক্রান্ত পেশেন্ট ঘুমের ঘোরেই সব কিছু করে অথচ কি করছে পরে সেটা মনে করতে পারে না।
রুমুর মামা মাসিরা বলল, কিছুদিন আগে দিদি ফোনে সবটাই বলেছিল। রুমু ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত সব কাণ্ড করে। আদালত কি এসব কথা শুনবে?
ডাক্তার বললেন, আদালত কড়া সাজা ঘোষণা করেন না এক্ষেত্রে। দেখা যাক কি হয়।
রুমুকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হলো।
সারা রাত রুমু এই গরাদেই থাকবে তারপর কাল সকালে জামিন হলে তবে বাড়ি যেতে পারবে রুমু।
নীল এসেছে রুমুর সাথে দেখা করতে। রুমুকে গরাদের অন্য গ্রিলে আনা হলো। নীল রুমুকে আস্তে আস্তে বললো, এই সমস্ত কেস ধোপে টেকে না। তুমি জামিন পাবে কাল।তারপর বিয়ে করবো। হ্যাঁ.. হ্যাঁ কালই। সব তৈরি আছে।
রুমু বললো, সাক্ষী দেবে কে কে?
– কেন তোমার মামা মাসী এরা আছে তো।বেওকুপের দল। হা হা হা..
রুমুর মুখটা চিকচিক করে উঠলো।নীল দেখলো রুমু লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলছে, নীল চলো ছাদে গিয়ে একটু বসি। কতোদিন তুমি আর আমি এক সাথে বসিনি। বিয়ার চাট সব আছে তো।
রুমু ফিসফিস করে বললো, নীল হাতটা ছাড়ো। চোখ খোলো।
নীল চোখ খুলে মিষ্টি হেসে বাই ডার্লিং বলে চলে গেল ।
পরদিন সকাল দশটায় আদালতে কারবাহি শুরু হলো। সাওয়াল, জবাব সাক্ষী। রুমুর মামা মাসিরা বললো, হুজুর রুমু ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত সব কাণ্ড করতো, দিদি আমাদের বলেছিল। ওকে শাস্তি দেবেন না হুজুর। স্বেচ্ছায় ও এই খুনগুলো করেনি।
না রুমুর জামিন হল না। একটা ভিডিও ক্লিপিং দেখে আদালতে সবার চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে গেল।
নীল বলছে, জান জানো তো টিভিতে যেদিন এই খবরটা দেখে ছিলাম সেদিনই আমি ছক কষে ছিলাম,
– ঐ ঘটনা তো, ঘুমের মধ্যে বন্দুক দিয়ে ছেলেটা ভাই বোন, মাকে হত্যা করেছিল, হুম সাজা হয়নি কিন্তু ছেলেটার ..
– তোমরাও হবে না, আর শোনো সব ঠিক আছে তো, ব্যাংকের বই, দলিল…
-হ্যাঁ, সব আমার নামে হয়ে যাবে, আর কোনো অংশীদার নেই তো। কেমন নাটক করে মামা মাসিদের ফোন করতে বলেছিলাম, হুম, বুদ্ধি কেমন বলো,
– আস্তে বলো
- কেউ নেই এখানে ওরা বুঝে গেছে কতো ধনী পরিবারের মেয়ে আমি। ভোলীভালী লড়কী। হা হা হা
– আহ্! আস্তে?
নীলের চোখমুখ লাল হয়ে গেল ভিডিওটি দেখে। আদালত কক্ষ গুঞ্জনে ভরে উঠলো, রুমু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
পুলিশ ইনসপেক্টর বললেন, সরকারী উকিল বাবুর নির্দেশ মতো ভিডিওটা করা হয়েছে,
তিন তিনটে খুন সন্দেহ তো ছিল প্রথম থেকেই..
নীল বলছে, মাই লর্ড আমাকে রুমু এ কাজ করাতে বাধ্য করেছে। আমি নির্দোষ। রুমুর ফাঁসির দিন ধার্য্য হলো, নীলের চোদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হলো।
রুমু কারাগারে বন্দি হয়ে আছে, রাত দিনের তফাতটা রুমু ভুলে গেছে। একটু তন্দ্রা এসেছে ওর,
“আয় সোনা আমার পরিবারের রাণী তুই, তোকে ছেড়ে থাকতে একদম ভালো লাগছে না আমাদের।”
“দিভাই আমার পিয়ানোটা ঠিক আছে তো?”
“রুম বেটা একটু জল দিবি না বাবাকে”
– কেন এসেছো তোমরা? যাও, এখানে আমি শান্তিতে থাকতে চাই।
“আর তো সাত দিন, পরিবারকে ছেড়ে তুই থাকবি মা, তারপর তো আমাদের সাথে তোর বাস হবে, পথের শেষ প্রান্তে এসে গেছিস মা”
,
রুমু ধড়মড় করে উঠে দেখলো কৈ কেউ নেই তো! চুপ করে বসে রইলো রুমু কিছুক্ষণ। তারপর বিড়বিড় করে বললো, পথের শেষ কোথায়, কে জানে, হা হা হা..আমি তো পথে নেই জেলে আছি জেলে।
দু’দিন ধরে রুমু ভুল বকছে গায়ে ধুম জ্বর, ডাক্তার বাবুকে রুমু বলছে, আমার সাথে আছে ঔ আমার মা, বাবা, ভাই।
রুমুর ফাঁসি মুলতবি করা হলো, রুমু এখন পাগলাগারদে আছে ওখানে ও সবার মধ্যে ওর মা বাবা ভাইকে দেখে। ভালো মেয়ে হয়ে আছে ও, কোনও নালিশ না কোনো দুষ্টুমি না, একদম ভোলীভালী লড়কী।