চেতনার ফুল
– রীণা চ্যাটার্জী
-ছোটো মা ও ছোটো মা দেখো আমাদের গাছেও এই ফুলগুলো হয়েছে। তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। তুমি পুজো করবে বলে..
-এই.. এইই কি হয়েছে? এই সক্কাল বেলা চেঁচাচ্ছিস কেন? কি চাই এখন?
– ছোটো মা কোথায় গো বড়ো মা? আমি ফুলগুলো নিয়ে এসেছি ঠাকুর পুজোর জন্য.. বলতে বলতে এগিয়ে আসে বছর পনেরোর জহুরা।
– থাক.. থাক ওখানেই দাঁড়া আর এগিয়ে আসতে হবে না। সবে সব ধোয়া মোছা পরিস্কার হয়েছে। যা.. এখন এখান থেকে যা.. এখনো ঠাকুর ঘরের সৃষ্টির কাজ বাকি। ধূপ জ্বলে নি। গঙ্গাজল পড়ে নি। উনি এসে হাজির সক্কাল সক্কাল! ছোটোর যত আদিখ্যেতা! সেলাই শেখাবে, স্বনির্ভর করবে। লিখতে শেখাবে..জগৎ উদ্ধার হবে.. যত্তসব। এই সবের ঠেলায় ছোঁয়াছুঁয়ি করে জাতধম্ম নষ্ট করে ধনে প্রাণে মারবে। রাগে গজগজ করতে করতে রায় বাড়ির বড়ো গিন্নী জহুরাকে ওখানেই থামিয়ে দিয়ে দাওয়া থেকে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। ফিরেও দেখলেন না ফুলের মতো তাজা কোমল মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। ফুলগুলো বুকে করে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল জহুরা।
ছোটো গিন্নী দীপ্তি স্নান সেরে বেরিয়ে বড়ো জায়ের গম্ভীর মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলেন- কি হয়েছে বড়দি! মুখখানা সকাল বেলায় অমন গম্ভীর কেন?
– কিছু না.. শিক্ষিত, স্বাধীনচেতা ছোটো বৌকে মনে মনে একটু ভয় পান। তাই কিছুক্ষণ আগের ঘটনা চুপচাপ চেপে রেখে ঠাকুর ঘরে ঢুকে যান।
দিন দুই হয়ে গেল। জহুরা আসে নি। মনে মনে ভাবেন দীপ্তি। কি হলো মেয়েটার? সেদিন বিকেলে পড়তে এসে বললো, ‘আমাদের গাছেও কুঁড়ি এসেছে। ফুল ফুটলেই তোমার কাছে সবার আগে নিয়ে আসবো ছোটো মা।’ তারপর থেকে আসছে না কেন? শরীর খারাপ? ভাবলেন ওর বন্ধু নিক্তির কাছে জিজ্ঞেস করবেন বিকেলে এলে।
বিকেল হওয়ার কিছু আগেই বড়ো গিন্নী সৌরভী জখম হয়ে জনা চারেক লোকের প্রায় কোলে চড়েই বাড়ি ফিরলেন। হৈ হৈ শব্দ। কৌতূহল নিয়ে দাওয়ায় বেরিয়ে এলো বাড়ির সবাই।
যারা নিয়ে এসেছিল তারা বাইরের দাওয়ায় বসিয়ে দিয়েছে। উনি কোনোরকমে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন স্পষ্ট। দীপ্তি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি হলো বড়দি?’
যারা নিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যে একজন বললো, মন্দির থেকে ফিরছিলেন, পা হড়কে পড়ে যান। কেউ ছিলো না তখন আশেপাশে। জহুরা গিয়ে আমাদের বললো, বড়ো মা এক্ষুনি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। শুনেই আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি, এই অবস্থা।
– জহুরা! কোথায় জহুরা? দীপ্তি জিজ্ঞেস করেন। পেছন ফিরে হাত দেখায় একটি ছেলে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে দূরে জহুরা- ‘কি রে কি হয়েছিল রে বড়ো মা’র? আর তুই আসিস না কেন দু’দিন ধরে?’ জহুরা কিছু বলার আগেই সৌরভী বলেন, ‘আয়, জহুরা আমার কাছে আয়..’ এগোয় না দাঁড়িয়ে জহুরা থাকে মাথা নিচু করে।
– কি রে বড়ো মা ডাকছে, আয়..আসছিস না কেন! কোনো কথা বলছিস না! কি হয়েছে তোর? বলতে বলতে এগিয়ে যান জহুরার দিকে দীপ্তি। দীপ্তির কাছ থেকেও তফাতে সরে দাঁড়ায় মেয়েটি। অবাক দীপ্তি- কি হয়েছে রে?
– আমাকে ছুঁয়ো না ছোটো মা, আমাকে ছুঁলে তোমাদের যদি কিছু হয়! ওইজন্য তো বড়ো মা পড়ে যাচ্ছে দেখেও আমি না ধরে দাদাদের ডেকে আনলাম। আমি ধরলে বড়ো মা হয়তো পড়ে যেত না তখন। এতো লাগতোও না। কিন্তু ভয় লাগলো ছুঁতে.. ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে জহুরা।
– কি বলছিস এসব? কে বলেছে তোকে এই কথা?
– আমি বলেছি ছোটো, আমি। সব ভুল আজ ভেঙে গেছে রে, ক্ষমা করে দে আমাকে। আয় জহুরা কাছে আয় মা- সৌরভী বলেন যন্ত্রণা কিষ্ট মুখে।
দীপ্তি জানেন সৌরভীর জাত- ধর্মের বাতিক। আজ সে বাঁধন ভেঙে যেতে খুশী হয়ে ওঠেন। জহুরাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে আসেন সৌরভীর কাছে। জড়িয়ে ধরেন সৌরভী। দু’জনের চোখেই জল।
চোখের জলের কোনো রঙ হয় না। ধুয়ে গেল নিমিষেই অন্ধ জাত ধর্মের প্রাচীর। কাঁদতে কাঁদতেই জহুরা বলে, বড়ো মা আমি চুন-হলুদ গরম করে লাগিয়ে দেবো তোমার পায়ে। ব্যথা কাল সকালেই সেরে যাবে দেখো।
– পাগলী মেয়ে আমার। আর কাল সকালে তুই ফুল নিয়ে এলে তবেই আমি পুজো করবো। তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবি কিন্তু আর পুজোর পর প্রসাদ নিয়ে তবে বাড়ি যাবি।
খুশীতে ঘাড় হেলিয়ে দেয় মেয়েটি।
দীপ্তির কাছে জহুরার এই দু’দিন না আসার কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়। হাসি ফুটে ওঠে মুখে। মনে হয় জিতে গেছে আজ মন, হেরে গেছে মিথ্যা অহঙ্কার।
Bah, khub sundor.
বাহঃ খুব সুন্দর একটা গল্প.. খুব ভালো লাগলো..
জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী
🙏🙏❤️
ধন্যবাদ 🙏
অহংকার যত হারবে তা সমাজের জন্য মঙ্গল ।
সহমত 🙏🙏❤️
অনবদ্য প্রকাশ দিদিভাই। মন ছুঁয়ে গেল।
প্রাণীত হলাম 🙏🙏