Site icon আলাপী মন

গল্প- চেনা অচেনার গন্ডি

চেনা অচেনার গন্ডি
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 


বিবেক বললো চল তাহলে আমাদের বাড়িতে। মা একা-একা পেরে ওঠে না। তুই মা’কে হাতেহাতে একটু সাহায্য করবি। কিরে, পারবি তো?
বারো বছরের অনাথ ভবঘুরে অসহায় গরীব কিশোরী শুকনো ঠোঁটে মৃদু হাসির প্রলেপ বুলিয়ে, ঝাঁকড়া চুলের মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো।
বিবেক বললো, এখানে এই ব্রীজের নিচের আস্তানায় আর কিন্তু আসতে পারবি না। এইসব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারবি না কোনও দিনও। পারবি?
কিশোরী, চারপাশের দিশাহারা অজানা অন্ধকার দুনিয়ায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে , মাথা নিচু করে, মাটিতে চোখ রেখে আবার মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো।
ব্রীজের নিচে রতনদার চায়ের দোকানে বিবেক গুটিকয়েক বন্ধুর সঙ্গে প্রায়ই আসে গুলতানি করতে। তখন থেকেই মেয়েটাকে চেনে। ওকে ভালো লাগে। ও ঠিক অন্যদের মতো নয়। কোথায় যেন একটা প্রভেদ আছে। চেহারায়, ভাবভঙ্গিতে, কথায়। একটা অদ্ভুত সরলতা যেন সবসময় মেয়েটিকে ঘিরে রাখে।
বেশ চল তাহলে। কিন্তু একটা কথা। মা নিশ্চয়ই তোর নাম জিজ্ঞেস করবে,, কী বলবি ?
মেয়েটি এক ঝটকায় উত্তর দেয়, কেন.. মিনু। ওটাই তো আমার নাম। সব্বাই তো ওই নামেই আমাকে ডাকে। ওটাই বলবো।
বিবেক মিনুর নরম শ্যামলা গালে হালকা আঙুল ছুঁইয়ে হাসি হাসি মুখে বললো,
গুড , চল।
মধ্য দুপুরের তীব্র কিরণে, নিজেদের ছায়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে এগিয়ে চললো দুটি প্রাণ।
বিবেকের সঙ্গে মিনু চলতে থাকলো ঠিকই, কিন্তু দাদাটা কেন মিনু নামটাই বলতে বললো তার হদিশ করে উঠতে পারলো না তার কিশোরী সবুজ নিষ্পাপ সরল মন।
মা, দ্যাখো কাকে নিয়ে এসেছি। এই মিনু এদিকে আয়। নাও তোমার সমস্যার সমাধান। একা হাতে পেরে ওঠো না। এই মিনু তোমাকে অনেক সাহায্য করবে। তাইতো মিনু?
দরজার পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা মিনুকে হাত ধরে টেনে এনে মায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো বিবেক।
শ্রদ্ধা দেবী কিছুক্ষণ মিনুর মুখের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। ঘরে তখন পিন পতনের নিস্তব্ধতা।তারপর বিস্ময়কর উচ্চারণে বললো, মিনু? না না… ওতো আমিনা, নূরের মেয়ে। ওর বাবা আলম সবজি বিক্রি করতো।
বিবেকের চোখ গোলগোল ফ্যাকাসে মেরে গেছে। মনে মনে বললো, দুরছাই! যে ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। মেয়েটারই মন্দ কপাল, নইলে…
শ্রদ্ধা দেবী বলে চলেছে, জানিস বিবেক! আমার বাপের বাড়ি, মানে তোর মামার বাড়ির পাশেই যে বিরাট ফ্ল্যাট বাড়িটা তৈরি হয়েছে, ওটা তো একটা বড় বস্তি ছিল। নানান কায়দায় সেই বস্তির লোকজনগুলোকে তাড়িয়ে , ওই ফ্ল্যাট হলো। কে কোথায় ছিটকে এদিক ওদিক হয়ে গেল, কে জানে!
হঠাৎ মিনুকে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ রে.. তোর মা বাবা কোথায় ?
মিনু জামার খুঁট আঙুলে জড়াতে জড়াতে মুখ নিচু করে মাথা নাড়লো।
শ্রদ্ধা দেবী এবার ছেলের দিকে তাকালো, বিবেক মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো, ও অনাথ, গো মা।
শ্রদ্ধা দেবী হঠাৎ গলার স্বর উচ্চগ্রামে তুলে প্রত্যয়ের সঙ্গে বললো, কে বলেছে? ওসব বাজে কথা? ওরা ফিরে আসবে। মা বাবা কখনও দায়িত্ব এড়িয়ে পালায় না। ওরা আসবে। আর যতদিন না আসে ও আমার কাছে থাকবে। আমার মেয়ে হয়ে।
শ্রদ্ধা দেবীর শাড়ির আঁচলে মিনুর মুঠো শক্ত করে ধরা।
বিবেক মিনুর চোখের কোণে চিকচিকে জল দেখতে পেল। এই প্রথম। বিবেক কখনও মিনুর চোখে জল দেখেনি।
শ্রদ্ধা দেবী মিনুর কাঁধে হাত রেখে ভিতরের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে পায়ে পায়ে। সেখান থেকে মায়ের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, মিনু.. ভারী মিষ্টি নাম। আমি তোকে এই নামেই ডাকবো। এখন ভালো করে স্নান করে ভাত খেয়ে নে। তোর জন্যে কয়েকটা জামা কিনতে হবে। দেখি বিকেলে যদি যাওয়া যায়…
বিবেক সোফায় বসে ভাবছে… সন্তান হয়ে মাকে চিনতে পারলাম না।
চেনা অচেনার গন্ডিটা বড়োই সুক্ষ্ম। তার নাগাল পাওয়া বোধকরি মানুষের অসাধ্য।
এই সত্য। মায়ের মমত্ব সব ধারনার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, অনেক অনেক বাইরে….

Exit mobile version