
গল্প- নাটকের ঝামেলা
নাটকের ঝামেলা
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
অমিতদের ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’এর তখন রমরমা বাজার। গোটা গ্রামের দায়িত্ব মোটামুটিভাবে তারাই কাঁধে তুলে নিয়েছে। রাত পাহারা থেকে মড়া পোড়ানো, মানুষের বিপদ আপদ থেকে বিয়ে বাড়ির পরিবেশন। যেখানেই লোকের দরকার সেখানেই ‘ভবতারিনী আলু আশ্রম’। তার মধ্যে অবশ্য বরকতের ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’ একই ভাবে বেজে চলেছে। তার সঙ্গে চলেছে অমিতদের নাটকের রিহার্সাল, আর নাটকের জন্য চাঁদা তোলা। এবারের নাটক ‘কানাগলি’। (নাটকটা অবশ্য অন্য নামে হতো)। নাটকটা আমাদের গ্রামের বহু পুরোনো সংস্কৃতি। তবে আজকের দিনের সঙ্গে তখনকার নাটকে একটু তফাৎ ছিল। তখনকার নাটকে বৈদ্যুতিক আলোর বদলে পাম্প দেওয়া হ্যাজাকের মতো আলো ব্যবহার করা হতো, তার নাম ছিল ডে লাইট, আর মহিলা চরিত্রগুলোতে গ্রামের ছেলেরাই অভিনয় করতো। অবাক হলে, না? না না অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই সত্যি। আমাদের গ্রামে এমন অনেক ছেলে ছিল যারা মহিলা চরিত্রে অভিনয় করে খুব নাম করেছিল। যেমন ধরো মুখুজ্যে বাড়ির অন্তু, চন্দ্রগুপ্ত নাটকে সেলুকাসের মেয়ে হেলেনের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য শুধু অন্তু কেন, এরকম আরও অনেকেই ছিল, যারা নাটকে মেয়ে সাজলে দর্শক হাঁ করে তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকতো। যাই হোক, নাটক আর এসে গেছে চাঁদা তোলাও চলছে জোর কদমে। সে বছর ছেলেদের মধ্যে নাটক নিয়ে একটা বিশেষ উদ্দীপনা রয়েছে। তার দু’টো কারণ ছিল। প্রথমত, সে বছর প্রথম ডে লাইটের পরিবর্তে জেনারেটরের বৈদ্যুতিক আলোয় নাটক হবে, আর দ্বিতীয় ও প্রধান কারণটি হলো গ্রামের নাটকে সেই প্রথম বাইরে থেকে পেশাদারী অভিনেত্রী আসছেন মহিলা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। ছেলেরা ব্যাপারটা জানাজানি হতে দেয়নি। তারা চেয়েছিল নাটক দেখতে এসে সবাই বিষয়টা জানুক। কেননা তাদের মনে সন্দেহ ছিল যে ঘটনাটা গ্রামের লোকজন কি ভাবে নেবে। (কেননা তখনকার দিনে অনেক মানুষের ধারণা ছিল, যে সব মেয়েরা নাটক করে তারা সব লাল বাতি এলাকার মেয়ে)। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। নাটকের দিন পনেরো আগে পেশাদারী অভিনেত্রীর ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। গ্রামের মধ্যে প্রথমে ফিসফিস, গুনগুন, তারপরে ঝড় শুরু হলো। প্রথম প্রকাশ পেল সিধু বোসের কথায়। একদিন সন্ধ্যাবেলা উদ্দিন আর গোপাল এসে জানালো যে সিধু বোস নাটকের চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছে। তার বক্তব্য, ‘তোমরা মেয়েছেলে নিয়ে ফূর্তি করবে, আর আমরা চাঁদা দেব? এক পয়সাও দেব না’। ব্যাস আর যায় কোথায়? ছেলেদের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। অমিতদের দলে সবচেয়ে বিচ্ছু ছিল টিলু। সে বললো, ‘দাঁড়া, ওর মজা আমি দেখাচ্ছি’। সিধু বোস রোজ সন্ধ্যাবেলায় ষষ্ঠীতলার রোয়াকে বসে তাস খেলে। ঘটনার ঠিক দু’দিন বাদে টিলু তার খেলাটা খেলে দিলো। সেদিন সন্ধ্যাবেলা সিধু বোস যখন মশগুল হয়ে তাস খেলতে ব্যস্ত, টিলু তার পিছন দিকে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে তার ধুতির কাছায় একটি মড়া, পচা ইঁদুর বেঁধে দিয়ে চলে এলো। লম্পর আলোয় তাস খেলা, চারিদিকে অন্ধকার, তাসুরেদের মধ্যে কেউ খেয়ালই করলো না টিলুর কীর্তি। সিধু বোস যতক্ষণ তাসে মশগুল ছিল ততক্ষণ কিছু বুঝতে পারলো না। ঘটনাটা ঘটলো তার বাড়ি ফেরার পরে। কিছুটা রাস্তা হেঁটে আসার ফলে পচা ইঁদুর নাড়াচাড়া পেয়ে তার সুগন্ধ ছড়াতে আরম্ভ করলো। সিধু বোস এসে যেই ঘরে ঢুকলো, তার বৌ রে রে করে উঠলো, ‘ইস্, কিছু মাড়িয়ে এসেছে না কি গো? কি পচা গন্ধ’! সিধু বোস অস্বীকার করে বললো, ‘আমি মাড়াতে যাবো কেন? নিশ্চয়ই ঘরে ইঁদুর পচেছে, দাঁড়াও বড়ো আলোটা নিয়ে আসি’। এই বলে সে যেই পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলো, ওমনি সেখানে তার ছেলে মেয়েরা হৈচৈ করে উঠলো, পচা ইঁদুরের গন্ধে। সিধু বোস তো অবাক, ‘বাবা, সব ঘরেই ইঁদুর পচেছে নাকি’! সে তার ছেলে মেয়ে বৌ সবাই মিলে সারাবাড়ি ছুটে বেরাতে লাগল পচা ইঁদুরের সন্ধানে, কেননা গন্ধটা সব ঘর থেকেই বেরোচ্ছে। এইভাবে খোঁজাখুঁজি করতে করতে একবার সিধু বোস হেঁট হয়ে খাটের নিচে উঁকি দিচ্ছে, হঠাৎ তার ছেলে বলে উঠলো, ‘বাবা তোমার কাছায় ওটা কি গো’? ছেলের কথার রেশ ধরে মেয়েরা আর বৌ ও সেটা দেখতে পেয়ে চেঁচাতে লাগলো। আর সেই চিৎকারে সিধু বোস ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করতে করতে, লাফাতে লাফাতে গিয়ে ঝাঁপ মারলো বাড়ির পিছনের পুকুরে। যেন তার কাছায় ইঁদুর নয়, আস্ত একটা কেউটে সাপ বাঁধা আছে। সিধু বোস তো জব্দ হলো, কিন্তু পেশাদারী অভিনেত্রীর ব্যাপারটা গ্রামে মহামারী আকার ধারণ করলো। গ্রামের অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ নিজের নিজের বাড়িতে নিদান দিলেন যে ওই নাটক দেখতে যাওয়া যাবে না। খবরটা জানাজানি হতে অনেক অভিনেতার বাড়ি থেকেও নাটকে অভিনয় করা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। অমিতের বাবা অবশ্য আধুনিক মনস্ক মানুষ ছিলেন। শুধু অমিতের মাকে বললেন, ‘গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে যাওয়ার কি দরকার?’ কিন্তু অমিত ছিল জেদী, গ্রামবাসীদের ভয়ে পিছিয়ে আসার ছেলে সে নয়। আর তার পিছনে ছিল টিলু, উদ্দিন, গোপাল, ছঙ্কুরা। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি এমন তৈরি হলো যে নাটকের দিন তাদের উপর আক্রমণ না হয়। অবশেষে নাটকের দিন চলে এলো। কাছেই মফঃস্বল শহর থেকে অমিতের অন্য বন্ধুরা, শৈল, অভয়, রাধিকা, অনিরা এলো অমিতদের সমর্থনে। ঠিক সময়ে নাটক শুরু হলো। দর্শক আসনে তখন জনা কুড়ি লোক। নাটক যত গড়াতে লাগলো আস্তে আস্তে দর্শকও বাড়তে লাগলো। নাটকের শেষে দর্শক আসন ভর্তি এক হাজার লোকে। গ্রামের প্রাচীন পন্থীরা সংস্কৃতির নতুন আলোকে সেদিন ঘরে আটকে রাখতে পারেননি। অমিতদের নাটক গ্রান্ড সাকসেস। আর আমাদের গ্রামে সেই শুরু হলো মহিলা চরিত্রে মেয়েদের অভিনয়, যা আজও অব্যাহত।


4 Comments
Payel Sahu
বাহ্ খুব সুন্দর
Mahamaya
ভালো লাগলো।
Anonymous
Besh valo hoyechhe.
Anonymous
Bahh..valo laglo.. 🤗sei somoi kar natok er itihass sune..