বেনারসি চুরি
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
-‘ও বড়দি কি কান্ড বলতো? সত্যি বাবা কস্মিনকালেও এমন ঘটনা শুনি নি। সোনাদানা চুরি হয়েছে শোনা যায় তা বলে বেনারসি!’
-‘কি জানি বাবা। সবই তো ঠিকঠাক চলছিল। বিয়ের আগের দিন কি বিপত্তি! তাও রানু পিসিমা ভাগ্যিস বেনারসিটা দেখতে চেয়েছিল তাই তো খোঁজ পড়লো। স্বর্গীয় রমেন বাবুর দুই বোন হিমানী ও শিবানী। স্বর্গীয় রমেনবাবুর নাতনি রিয়ার বিয়ে উপলক্ষে এসেছে বাপের বাড়ি।
শিবানী বলে উঠলো,’শিপ্রা জানলে যে কী করবে কে জানে? ও বড়দি তোমার মনে আছে শিপ্রার আইবুড়ো ভাতের দিনটা।’
হিমানী বলে ‘সে কি ভুলা যায় রে? আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে সেই দিনটার কথা। কি আনন্দেই ছিল দাদা মেয়ের বিয়ের জন্য। মা মরা ছেলে আর মেয়েটাকে নিয়ে সারা জীবনটা কাটিয়ে দিলো দাদা। কত অল্প বয়সে বিপত্নীক হয়েছিল। সবাই কত অনুরোধ করেছিল তবু দাদা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। দাদার কপালটাই আসলে দুঃখে ভরা ছিল। একমাত্র ছেলে তাও আবার প্রতিবন্ধী। তাই শিপ্রাই ছিল দাদার আশা-ভরসা।
কিন্তু সেই মেয়ের বিয়ের আগের দিন দাদার সেরিব্রাল অ্যাটাক হলো। নার্সিংহোমে ভর্তি করার পর জানা যায় দাদার লোয়ার পোরশনটা একেবারে অবশ হয়ে গেছে।
-‘ছোট, তোর মনে আছে সেদিন শিপ্রা কিন্তু এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে নি। বরং নার্সিংহোম থেকে রাতে ফিরে এসে কি ধীর-স্থিরভাবে সবাইকে জানালো ‘আমি এই মুহূর্তে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারবো না।’
অর্ঘ্য কিন্তু মন্দিরে গিয়ে বিয়েটা সেরে নিতে চেয়েছিল। শিপ্রা প্রথমে রাজিও হয়েছিল। তবে ও একটা শর্ত রেখেছিল। পঙ্গু বাবা আর প্রতিবন্ধী দাদাকে ফেলে কিছুতেই সে এ বাড়ি থেকে যেতে পারবে না। সুতরাং বিয়ের পর থেকে অর্ঘ্যকেই শিপ্রার বাড়িতে এসে থাকতে হবে। অর্ঘ্য অনেক বুঝিয়েছিল শিপ্রাকে। যে তারা প্রায়ই আসবে, দেখে যাবে। বাবা আর দাদার জন্য ফুলটাইম দুজন দেখাশোনার লোক রেখে দেবে। কিন্তু শিপ্রার এক গোঁ। বাইরের লোক অর্থের বিনিময় কর্তব্য করবে কিন্তু ভালোবাসা দিতে পারবে কি? সেই থেকে আজ অবধি শুধু কর্তব্য আর ভালোবাসার মায়া জালে বেঁধে নিজের সব সুখ, ইচ্ছা, ভালোলাগা ত্যাগ করেই চলেছে শিপ্রা।
অরুণের মত প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করা কি মুখের কথা ছিলো? তাও কিন্তু শিপ্রা করে দেখিয়েছে। একদম গরীব ঘরের এক উচ্চ মাধ্যমিক পাস মেয়ের সাথে অরুণের বিয়ে দেয়। রমেন বাবু বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলে ও বৌমাকে আশীর্বাদ করে গেছেন। শুধু কি বিয়ে? বিয়ের সাথে সাথেই অর্ধেক সম্পত্তি অরুণের স্ত্রীর নামে করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় শিপ্রা, রমেন বাবুকে দিয়েই।
‘তুই কিন্তু আপত্তি করেছিলি বড়দি। মনে আছে তোর?’
‘থাকবে না। দাদা উইল করার আগে আমাদের সাথে কথা তো বলেছিল।’ ছেলের জায়গায় বৌমার নামে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দেবে। ‘আমি আপত্তি করায় শিপ্রা বলেছিল বড় পিসি তুমি কেন চিন্তা করছো? বাকি অর্ধেক সম্পত্তি তো রইলো আমার দাদার। বৌদি যদি বেইমানি করে দাদার কিন্তু কোন অসুবিধা হবে না। আমার যা কিছু সবই তো দাদার। তাছাড়া আমার কলেজে চাকরি তো রইলো।’
শিবানী একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি আজও শিপ্রাকে বুঝে উঠতে পারি না। কোন মেয়ে এইভাবে শুধু কর্তব্যের খাতিরে নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎকে গলা টিপে মেরে দিতে পারে। জানো বড়দি আজ যে বেনারসিটা চুরি গেল তা কিন্তু শিপ্রার বিয়ের জন্য দাদা নিজে পছন্দ করে কিনে ছিল। লাল কালারের উপর সোনালী জরি। কি অপূর্ব কলকাগুলো! আর আঁচলটাতে তো পুরো মিনা করা সোনার কাজ। দাদার আমাদের চয়েস ছিল কিন্তু। কি জানি বাপু বেনারসিটা গেল কোথায়?’
অরুণের বউ তাপসী তো এ আলমারি, ও আলমারি, বক্স খাট সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছে। বিয়ের গয়না, শাড়ি, কাপড় সবই তো শিপ্রার ঘরের আলমারিতে তুলে রেখেছিল তাপসী। ভিতরে ভিতরে ভয়েতে তো তাপসীর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ননদ শিপ্রাকে সে যথেষ্ট ভয় পায়। আসলে শিপ্রার ব্যক্তিত্বের কাছে কেউ সহজে দাঁড়াতে পারে না।
সবাই যখন এদিক-ওদিক বেনারসি খুঁজতে ব্যস্ত তখন কিন্তু রিয়া তার পিসি শিপ্রাকে খুঁজে চলেছে। এত বড় কান্ড হয়ে গেল শিপ্রা গেল কোথায়? দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর থেকেই রিয়া অনেকক্ষণ শিপ্রাকে দেখতে পায় নি। রিয়া কাউকে কিছু না বলে তাই তিন তলা ছাদের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। হ্যাঁ ঠিক। রিয়া যা ভেবেছিল তাই। রিয়া ছিল শিপ্রার প্রাণাধিক প্রিয় ভাইঝি। পিসির প্রতিটি পদক্ষেপ রিয়া খুব ভালো বুঝতে পারতো। তিনতলার ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ঘরে কেউ আছে। কেউ আর কে হবে? নিশ্চয়ই শিপ্রাই আছে। কারণ এই তিনতলার ঘরটা শিপ্রার একান্ত আপন। দশ বাই চোদ্দ ঘরটার তিন দিকে জানালা। প্রচুর আলো আর বাতাসের আনাগোনা। এক কোণে একটা আয়না লাগানো কাঠের পুরনো আলমারি আর অন্য কোন ঠাকুরের সিংহাসন। তাতে মা সরস্বতীর মূর্তি ও শ্রী রামকৃষ্ণ, সারদা মা ও বিবেকানন্দের ছবি। মেঝেতে বিছানো আছে লাল কার্পেট। সকালে নিজে হাতে ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পুজো-পাঠ করে শিপ্রা কলেজে যায়। আবার ফিরে এসে সন্ধ্যা থেকে ঘন্টাখানেক পুজো পাঠের জন্য এই ঘরটিতে কাটায়। তাছাড়া কখনো-সখনো মন খারাপ হলে শিপ্রা এই ঘরটিতে নিজেকে আটকে রাখে।
রিয়া আস্তে আস্তে ছাদের পাশের জানালাটা দিয়ে উকি মারে ঘরের ভিতরে। জানালাটা বন্ধ থাকলেও কাঁচের মধ্যে দিয়ে ভিতরটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লাল রঙের একটা আভা বোঝা যাচ্ছে বেশ। রিয়া খুব আস্তে আস্তে বলে ‘পিসিমণি দরজাটা খোলো না প্লিজ।’ মিনিট পাঁচেক পর দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসতেই রিয়া ছুটে এসে ঘরে ঢোকে। কি অপূর্ব লাগছে রিয়া অবাক নয়নে চেয়ে আছে তার প্রিয় পিসিমণির দিকে।
শিপ্রা ছোট্ট একটু হাসি দিয়ে বলে ‘দরজাটা বন্ধ কর। কেমন লাগছে আমাকে? জানিস এই বেনারসিটা পড়ে বউ সাজার আমার খুব শখ ছিল রে। অর্ঘ্য বলতো আমি নাকি ওর স্বপ্নে আসি লাল রঙের বেনারসি পড়ে। আর বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁতিদের দিয়ে আমার জন্য এই লাল জরি ও সোনার মিনা করা ডিজাইনগুলো তৈরি করিয়েছিলেন। কিন্তু আমার বিয়ের আগেই সব স্বপ্ন ওলট-পালট হয়ে গেল। তাই আজ তুই এই শাড়িটা পড়বার আগে আমি একবার হলেও এই বেনারসিটা পড়ে বাবার, অর্ঘ্যর আর আমারও সুখস্বপ্নের অনুভুতিগুলোর পরশ গায়ে মাখার চেষ্টা করছিলাম।’ এই কথাগুলো বলতে বলতে পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের অধ্যাপিকা শিপ্রা রায় অঝোরে কেঁদে চলেছে। রিয়া ও তার পিসিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। শিপ্রার দু’ চোখের অশ্রুধারার ফোঁটা ফোঁটা জল এসে পড়ছে রিয়ার হাতের ওপর। পিসি আর ভাইঝি দুজনেই কেঁদে চলেছে। কিছুক্ষণ পর রিয়া বলে ওঠে ‘সবাই যখন বলছিলো বেনারসি চুরি হয়েছে। আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আমি জানতাম এই বেনারসির খোঁজ কেউ না জানুক তুমি জানবেই। পিসিমণি পার্লারের মেয়েকে আমি বারণ করে দিচ্ছি। আগামীকাল তুমি তোমার ছোট রিয়াকে নিজের হাতে সাজাবে কেমন।’
শিপ্রা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, ‘নিচে গিয়ে সকলকে বল বেনারসি পাওয়া গেছে।’