সংসারের মহিমা
রীণা চ্যাটার্জী
ইঁদারায় জল তোলার বালতির সাথে কোনও তফাত নেই জীবনের। ডোবাচ্ছে আর তুলছে, ভরছে আর খালি করছে। সংসারে যেমন প্রয়োজন তেমন, যখন প্রয়োজন তখন। সকালে ঘুম চোখ খুললেই শুরু, চা দিয়ে..শুধু একবার হাঁক দেওয়া মানে কিন্তু খুব সোজা দিনের প্রথমবার ডুবনো, চা হাজির। ‘এক টানেতে যেমন তেমন…’ শুরু হলো তারপর একে একে ফরমাস কোথায় তেল? কোথায় বেল? বলার সাথে সাথেই জোগান চাই, এইটাই আসল খেল। একবার সংসার ইঁদারায় ডোবাবে, তুলবে, খালি করবে আবার ডোবানোর পালা। জীবন তোমার, দড়ি সংসারের হাতে। ক্লান্ত হয়ে গেলেও আসুবিধা নেই কোনো, লাট খাওয়াতে খাওয়াতে সংসার ঠিক নামিয়ে দেবে ইঁদারায়, পাক দিতে দিতে তুলে আনবে। বেলা বাড়বে ক্রমশঃ দীর্ঘনিঃশ্বাসে, জীবন এগোবে ধীরে ধীরে। লাট খাওয়া বালতি ঘষা খেয়ে ফুটো হবে, তুবড়ে যাবে। মন বলবে, “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি..” সংসার বিস্ময়ে বলবে, “সে কি! দুই টানেতে রোগী?’
বলবে না! ইনভেস্টমেন্ট তো উশুল হয় নি। কতবার টেনেছে সে হিসাব কেউ কি রাখে? সবার প্রয়োজন আলাদা, সেইমত ডোবানো আর তোলা। কে কতোবার ডোবালো, ভেবে কি লাভ?
অবশ্যই এর মধ্যে আছে সমবেদনা, বালতি ফুটো হয়েছে দেখতে পেলেই আহা আহা করে দৌড়ে এসে সারিয়ে তুলবে। ফুটো বালতি হলে যে আর সুবিধা মত ডোবাতে পারবে না সংসার ইঁদারায়। তাই সমবেদনার মলম তো লাগাতেই হবে। পাঁঠা মন ভাবে, বাহ্ বেশ– আর বোধহয় টান দেবে না। আনন্দে গেয়ে ওঠে, ‘তিন টানেতে রাজা উজির.. চার টানেতে সুখী.. সবাই সুখী..’ জীবন সুখী, সম্পর্ক খুশী। আরে বাবা! সুখী হতেও তো জানা চাই।
সুখী! ভুলের স্বর্গ ভাঙতে দেরী হয় না, যখন আবার ডুবিয়ে দিয়ে ক্লান্ত বালতিটাকে টেনে হিঁচড়ে তোলে আর ডোবায়। রাতের অবসরে ক্লান্ত, জীর্ণ অবয়ব জিরোয় আর ভাবে, আর কতো? আর কেন?
ডোবানো আর তোলা- তোলা আর ডোবানোর মাঝে কেউ খেয়াল করে না, দড়িটা ক্রমশঃ আলগা হয়ে গেছে। অবহেলার অলেখ্য ছিঁড়ে যায় একসময়। লাট খেয়ে লুটিয়ে পড়ে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে অতল জলে। দৌড়ে আসে পরিচিত কিছু মুখ। মন তখন বলে, ‘পাঁচ টানেতে মাটি ছেড়ে শূণ্যে ওঠা যায়..’ হাত বাড়ালে, চোখের সামনে শুধুই অসহায় শূণ্যতা!
পঞ্চত্ব প্রাপ্তির অবশেষে আকাশে বাতাসে কালো ধোঁয়ায় পঞ্চভূতে মিলিয়ে যেতে যেতে কানে আসে, ‘ ছয় টানেতে আকাশেতে ভেসে থাকা যায়..’ ভেসে যায় ইচ্ছে, স্বপ্ন, সুখ, আকাক্ষা, ভালোবাসা সব!
সারাজীবনের অবহেলার শেষে, ঘরে ফটোর ফ্রেমে ফুলের মালা, ভালো ভালো কথায় স্মৃতি রোমন্থন, চোখের জল! নিজের অবস্থান না বুঝতে পেরে মহান, দেবতা এইসব অনুভূতি আসে মনে। কানে আসে, ‘সাত টানেতে তুমিই হবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, কালী…’ কিছু দিন পর ফটোর মালা বাসি হবে, মাছি উড়বে, সব রস–গন্ধ শুকিয়ে গেলে মাছিও উড়ে যাবে। শুকনো মালা ফটোয় ঝুল মেখে দুলতে থাকবে।
তারপর আর কোনো ব্যস্ততা নেই, হাঁক নেই- ডাক নেই। ভুলে যাওয়ার সংসারে নিস্তরঙ্গ অবসর, সব ফাঁকা, সব খালি, ‘আট টানেতে স্বর্গ- নরক সবই পাবে খালি..’ আর দম নেই, আর কোনও টান নেই। সংসারের কি মহিমা বাবা! কারিগরিটা ভাবো দিকি একবার..