Site icon আলাপী মন

গল্প – পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

-অমল দাস

 

মেডিকেলের দোকানে যাবো। তাই সাত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছি সকালেই। বাড়িতে বাবা মা অসুস্থ, আমারও একটা ওষুধ লাগবে। বাড়ির কাছে যে দোকানটি আছে, সে জানিয়ে দিল সাপ্লাইচেন নষ্ট হয়ে গেছে। তাই অর্ডারের মাল আসছে না। সব দিতে পারবে না। কিন্তু আমার সবধরনের ওষুধই লাগবে, জীবনদায়ী কিনা তাই। অগত্যা সাইকেল নিয়ে মেইন রোড ধরে একটু দূরে চললাম। শুনশান রাস্তার পাশে একটু ফাঁকা ফাঁকা দু’একটা ঝুপড়ি আছে। কিছুটা যেতেই দেখি দু’টি ছেলে মেয়ে খালি গায়ে রাস্তার উপর খেলা করছে নিশ্চিন্তে। ওদের ঠাকুমা দরজার পাশে বসে সব্জি কাটছে। ছেলেটি এই পনেরো আর মেয়েটি বছর আটেক হবে। ওদের বাবা মা নেই। বাপ মারা যাওয়ার পর মা উধাও। ঠাকুমার কাছেই মানুষ। বুড়ির চিন্তা হয় ওদের নিয়ে, ‘আমি কতদিনই বা থাহুম কি জানি! এই পোলা মাইডারে দ্যাকপে কেডা হেই চিন্তা মাতাডায়। বাড়ি ঘরও নাই যে থুইয়া যামু! এই চালাকুডা কবে ঝড়ে উড়াইয়া লইয়া যায় হেয়াওবা কেডা জানে’!  

বুড়ির একমাত্র ছেলের মারণ রোগের চিকিৎসায় ভিটে বাড়ি বেচতে হয়। ছেলে বাঁচেনি কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছে। আমি ওদের জানি এই পথে যাওয়া আসার সুত্রে। তাই যাওয়ার সময় হাঁক দিয়ে গেলাম ‘এই, তোরা রাস্তা থেকে নেমে খেলা কর, গাড়ি এসে পড়তে পারে’।

ছেলেটি বলল- ও কাকু লক ডাউন, লক ডাউন গাড়ি নাই রাস্তায়।

খুব আনন্দ মনে, বুঝলাম। হাঁক দিয়ে বুড়িকে বললাম, ও মাসি খেয়াল রেখো কিন্তু…

-আর কি রাখুম বাপু? পোয়া মাইয়া দুইডা কতাই হোনে না।

আমি সাড়া না দিয়ে চলে গেলাম। ওষুধ নিয়ে ফেরার পথে দেখি, ঝুপড়ির সামনে কয়েক জন লোকের জটলা। একটু কাছে আসতেই দেখি একটি পুলিশ সমানে ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে মারছে। বুড়ি মাসি পুলিশের পায়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে- ওরে ছাইড়া দাও সার, তোমার পায়ে পড়ি, পোলাডা মইরা যাবে।

বলে হাউ হাউ করে কান্না করছে। ছোট বোনটাও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। পুলিশ ছেলেটিকে মেরেই যাচ্ছে অবিরাম। দু’এক জন দাঁড়িয়ে দেখছে! কেউ কিছুই বলছে না। আমি সাইকেল থেকে নেমে, ভয়ে ভয়ে, স্যার ওভাবে মারবেন না স্যার, বাচ্চা ছেলে হিতে বিপরীত হয়ে পারে! ছেড়ে দিন না…

আমাকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে বললো –এই সরে যা! দরদ দেখাতে হবে না! যা হবে বুঝে নেবো। এমন ইতর ছেলেকে দু’চার ঘা না দিলে শুধরাবে না।

আমি তাও এগিয়ে অনুনয় করলাম, স্যার প্লিজ ছেড়ে দিন! বাচ্চা তো অন্যায় করে ফেলেছে।

আমাকে রক্তচোখ দেখিয়ে সরে যেতে বলল। আমিও ভয় পেলাম। শালা আমাকে না দু’চার ঘা লাগিয়ে দেয়। পাশের একজনকে জানতে ছেয়েছিলাম কি ব্যাপার? সে যা সংক্ষেপে বলল তা এইরকম, পুলিশটি যাওয়ার সময় ওদের ঘরে ঢুকতে বলেছে। আসার সময় আবার রাস্তায় খেলতে দেখে বাইক থেকে নেমে কষিয়ে এক চর। ছেলেটি গালি দিয়ে ফেলেছে। ব্যাস, তারপর শুরু অকথ্য অত্যাচার।

এরই মধ্যে পুলিশটি ছেলেটিকে জোরে লাথি মেরে পাশের নয়ানজুলিতে ফেলে দেয়। ছেলেটির সারা গায়ে লাল দাগ জেগে উঠেছে। কয়েক জায়গা থেকে রক্তও ঝরছে। জলে পড়ে কোঁকড়াচ্ছে।

পুলিশটি হাঁফিয়ে উঠেছে। বাইকে স্টার্ট দিতে যাবে ঠিক সেই সময়। ছেলেটি নয়ানজুলি থেকে একদলা কাদা ছুঁড়ে মারে পুলিশের গায়ে। কতকটা ছিটে আমার প্যান্টেও পড়ে। পুলিশটি তেড়ে গিয়ে জলের মধ্যে নেমে ছেলেটিকে চেপে ধরে। আমরা সবাই উপর থেকে চেঁচাতে লাগলাম, স্যার ছেড়ে দিন মরে যাবে, মরে যাবে ছেলেটি… ছেড়ে দিন স্যার…

কে কার কথা শোনে? বিপদ হয়ে যাবে বুঝে বুড়ি আর আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কিন্তু ওই কাদার ভিতর থেকে পুলিশটিকে টেনে তুলতে পারলাম না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখি জলের থেকে বুদবুদ ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। বুড়ির কান্না আর রাখা যায় না! সে উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগলো, শেষ হইয়া গেলো রে… আমার নাতিডারে ওই শুয়ারডা শেষ কইরা দিল রে… শেষ হইয়া গেল রে…

পুলিশটি প্রচণ্ড ক্লান্তে হয়ে ওই জলের মধ্যেই মাথা নিচু করে বসে আছে। ওঠার শক্তি নেই, না অনুশোচনায় ডুবে গেল বোঝা গেল না। বুড়ি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। মেয়েটির গলা বসে গেল, তবু কান্না আর থামে না। আমি জবুথবু কাঁপছি। কি করব দিশাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।

এমন সময় দেখি নয়ানজুলির একপাশ থেকে ছেলেটির মাথা ভেসে উঠেছে। তারপর আস্তে আস্তে দেহও উঠেছে। বাউন্ডুলে ছেলে তো, মনে হয় দম আছে! ঘাপটি মেরেছিল। আমরা উপরে যারা দাঁড়িয়ে, কেউ বুড়িকে সামলাতে, তো কেউ মেয়েটিকে সামলাতে ব্যস্ত।

আমি বলতে যাবো ওরে.. ও মরে নি বেঁচে আছে কাঁদিস না..! হঠাৎ দেখি জলের মধ্যে বসে থাকা পুলিশের ঘাড়ের দিক থেকে গলাটা দু’হাতে জড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে মাথা জলের মধ্যে চেপে ধরেছে। পা দুটি কাদায় গেঁথে থাকায় পুলিশ জোর খাটাতে কেমন যেন অপারগ। হাত দিয়ে ছাড়াবার জন্য ছটপট করছে।  এতো দ্রুত ঘটনা ঘটতে লাগলো কি করবো দিশে পাচ্ছিলাম না। একলাফে এবার কাদার মধ্যে নেমে গেলাম। পিছন দিক থেকে পুলিশটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু সেই শক্তি পাচ্ছিলাম না। ভয়ে কেমন যেন সিধিয়ে গেছি। কাঁপছে থরথর করে শরীর। যতক্ষণে উপর থেকে এক জন নেমে আসছে ততক্ষণে সব শেষ। শেষ বুদবুদটা ছেড়ে কেমন নিথর হয়ে গেল। ছেলেটি সর্বশক্তি দিয়ে এভাবে চেপে ধরবে আর সে নড়তেও পারবে না স্বপ্নেও ভাবিনি। কাদার মধ্যে আমি যেন কেমন জ্ঞান হারনোর মত অবস্থায়, চোখে সামনে অসংখ্য কালো কালো তারা। উপরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের হৈ হট্টগোলে সম্বিৎ ফিরে পাই। কাদা থেকে কোন মতে উঠেই আমার দৌড় শুরু। পাছে খুনের দায় কিনা আমাকেই নিতে হয়। ওষুধ, সাইকেলের কথা মনেই পড়ল না। আমি আজও দৌড় কালও দৌড়। হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়লাম মুখ থুবড়ে। মাথা ফাটলো, দাঁত দু’খান পড়ল। ঝা চকচকে মেইন রোড আছাড় খেলেম কীভাবে ভেবেই সার। কোন মতে পিছনে ঘুরে দেখি বিরাট এক গর্ত। যাওয়ার সময় ছিল না। এখন কোথা থেকে এলো, অবাক! আবার দৌড়াবো ভেবে একবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম! না.. পা ভেঙেছে, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আঁতকে উঠলাম। বুকের ভিতর যেন ডঙ্কা বাজছে! কি হলো ভেবে অনেকক্ষণ থ মেরে বসে রইলাম। তারপর বোতলটা কাছে নিয়ে ঘটঘট করে গিলে নিলাম জল। একটু জল হাতে নিয়ে ঘাড়টা ভিজিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। তারপর সকাল।          

Exit mobile version