Site icon আলাপী মন

অণু গল্প- ফুলমনি সরেন

ফুলমনি সরেন
– শান্তনু ব্যানার্জি

 

 

ফুলমনির জন্ম কোলকাতায়। ধীরেন বাবুর হাত ধরে ফুলমনির বাবা- মার কোলকাতায় আসা। নিজের মশলা তৈরীর কারখানা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। শুধু প্রয়োজন ছিল বিশ্বস্ত লোকের। সাঁওতাল পরিবারের স্বামী স্ত্রী দুজনকেই চাকরি দেন। থাকার ব্যবস্থা করেন। সেই দুয়ারসিনির সাঁওতাল গ্রাম থেকে ওদের নিয়ে আসেন। ভুল কিছু করেন নি। ওরা ধীরেন বাবুর মান রেখেছেন। ফুলমনির বড় হওয়ার সাথে স্কুলেও ভর্তি করেছেন। উপরন্তু ওর মা বাবার কাজের গুরুত্বও বাড়িয়ে দিলেন। একটু বড় হতেই দেখা গেল যে মেয়েটির মধ্যে এমন একটা শক্তি আছে যা সহপাঠীরা সহজেই মেনে নেয়। তা ওইটুকু মেয়ে হলে কি হবে? স্বভাবে সুন্দর, বক্তব্যে স্পষ্ট।
ধীরেন বাবুর বাবা ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করতেন। নিজে দর্শনে MA পাশ করেও ব্যাবসা শুরু করেন। মেয়েটিকে যত দেখেন তত বেশী ভালো লাগে। মনে এসে যায় বিতর্কিত হলেও আর্য -অনার্যদের সংঘাতের কথা। মনে পড়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীল কর আদায়ের কালে অত্যাচারে জর্জরিত সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা। তাছাড়া যেটুকু গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডাসের বিবরণ থেকে জানা যায় সিন্ধু ও বালুচিস্তানের কুটির শিল্পীদের বলা হতো সান্তাল। নিজেদের বিভিন্ন সময়ের গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে এরা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ও পূর্ব ভারতে। তারপর বসবাস শুরু করে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে। দীর্ঘ দিন ধরে নগর সভ্যতার সাথে সম্পর্কহীন থাকায় এরা অরণ্যচারী আদিবাসীতে পরিণত হয়। এখনকার সাঁওতালরা তাদেরই উত্তরপুরুষ। এক সময় সিন্ধু প্রদেশের নাম ছিল চাম্পা। এই অঞ্চলে ছিল সান্তালদের চোদ্দটি গোষ্ঠীর চোদ্দটি কেল্লা বা গড়। চায়গড়ে থাকতো সরেন গোষ্ঠী।
এর মধ্যে কলকাতার নব্য কালচারে প্রাইমারি ক্লাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে যোগাযোগ শুরু করে। দেদার খরচ, ডোনেশন, টেনশন, নিজের বাচ্চাদের মগজ ধোলাই, একে ধরা ওকে ধরা এবং সর্বোপরি অনিশ্চয়তা ।
ফুলমনির অন্য স্কুলে যাবার প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া বাংলা ভাষাকেও খুব ভালোবেসে ফেলেছে। চারজন ছেলে আর ফুলমনি একই বেঞ্চে বসে। যেমন অসিত, তারক, বরুণ আর রঞ্জন। সকলের মন খারাপ। সবাই যে ওকে খুব ভালোবাসে আর ওর কথা মেনে চলে। বাড়িতে বললেও বকুনি খাবে। এখন ফুলমনির বুদ্ধিই ভরসা। ফুলমনি বললো, একটু ভাবতে হবে।
পরদিন সোজা হেডমাষ্টার মশাই-এর কাছে একা একাই কিছু বলে এল। এরপর উনি বাকি চার অভিভাবককে ডেকে পাঠালেন। বললেন, পঞ্চাশ মিটার দৌড়ে যে প্রথম হবে তাকেই একমাত্র এই স্কুলে রাখা হবে। বাকিরা অন্য স্কুলে যাবার ট্রান্সফার সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। ফুলমনি এত জোরে দৌড়তে পারে যে কেউ ওর সাথে পেরে উঠত না। কাজেই অভিভাবকরা খুব খুশি। ফুলমনি ফার্স্ট হবে। আর বাকিরা অন্য স্কুলে চলে যাবে।
কিন্তু অন্তিম সময়ে দেখা গেল সকলে একই সময়ে পৌঁছেছে। পাঁচ জনেরই একই সময় লেগেছে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রথম। সবাই চেঁচিয়ে উঠল হিপ হিপ হুররে। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব। জয় বন্ধুত্বের জয়। জয় বাংলা ভাষার জয়।
ফুলমনির মুখে একটা তৃপ্তির হাসি।

Exit mobile version