গল্প- মৎসশিকার

মৎসশিকার
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

নাটকের পাশাপাশি অমিতের আর একটা নেশাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো, সেটা হলো মাছধরা। আর সেই মাছ ধরতে গিয়েই দু’বার দু’টো সাংঘাতিক ঘটনা ঘটলো অমিতের জীবনে। উদ্দিনদের পাড়ার সাত্তার চাচার মৎস্য শিকারী হিসাবে খুব নাম ডাক ছিল। অমিত তারই সঙ্গ নিলো। ছিপ কেনা হলো, হুইল কেনা হলো, সুতো কেনা হলো, বঁড়শি কেনা হলো, আর তার সঙ্গে তৈরী হলো বিভিন্ন রকমের চারের সরঞ্জাম। মাছ ধরার জায়গার অভাব নেই। তখনকার গাঁ গঞ্জের সব পুকুরই মাছে ভর্তি। আর মাছ মানে যে সে মাছ নয় তিন চার কিলো থেকে চোদ্দো পনেরো কিলো রুই কাতলা। সে সব মাছ ধরতেও মজা খেতেও মজা। মাছধরা চলতে লাগলো আর অমিতও আস্তে আস্তে পাকা মেছুরে হয়ে উঠলো। আশপাশের দু’ একটা গ্রামে অমিতের একটু আধটু নামও ছড়িয়ে পড়লো পাকা মেছুরে হিসাবে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ একদিন অমিতের বাবার পাশের গ্রামের এক বন্ধু গোস্বামী বাবু অমিতদের বাড়িতে এসে হাজির। তিনি অমিতকে দেখে বললেন, ‘কি রে ব্যাটা, শুনলাম তুই নাকি খুব মেছুরে হয়ছিস, তবে যা আমার বালির খাদে মাছ ধরে আয় দেখি তাহলে বুঝবো তোর মাছ ধরার দৌড়’। তোমরা হয়তো জানো না, আমাদের এদিকে মাটির নিচে প্রচুর বালি পাওয়া যায়। তাই আগে ব্যবসাদাররা জায়গায় জায়গায় বড়ো বড়ো পুকুরের মতো কেটে তার থেকে বালি তুলে বিক্রি করতো ইমারতি কাজের জন্য। সেই সব খাদ যেমন বড়ো তেমনি গভীর। এখন অবশ্য খাদ থেকে বালি তোলা বন্ধ হয়ে গেছে। যাইহোক অমিতের তো হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। সাত্তার চাচা অনেক দিন ধরেই বলছে, ‘গোস্বামী বাবু তো তোর বাবার বন্ধু, তাঁকে বলে তাঁর খাদে একদিন মাছ ধরার ব্যবস্থা কর দেখি, ওনার খাদে চোদ্দো পনেরো কিলো কাতলা আছে। একটা লাগাতে পারলেই কেল্লা ফতে’। তো আজ মেঘ না চাইতেই জল। সেই খাদেই মাছ ধরার আমন্ত্রণ! গোস্বামী বাবু একটা চিরকুট লিখে দিয়ে বললেন, ‘এটা পাহারাদারকে দেখিও, তাহলেই সে তোমাকে মাছ ধরতে দেবে’। চিরকুট হাতে অমিত তো লাফাতে লাফাতে চললো সাত্তার চাচার বাড়ী। সাত্তার চাচা সব শুনে বললো, ‘হুঁ ব্যাপারটা সহজ নয়। ওই খাদে যা মাছ, একবার যদি ছিপে লাগে, তাকে ডাঙায় তুলতে আচ্ছা আচ্ছা মেছুরের ও কপালে ঘাম ফুটে যাবে, তাই ওই খাদে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে ঠিকঠাক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। সরঞ্জাম মানে সুতো, বঁড়শি। তিন কিলো মাছের সুতো বঁড়শিতে তো আর পনেরো কিলো মাছ উঠবে না। মাছের টানে সুতো ছিঁড়ে যাবে, বঁড়শি সোজা হয়ে যাবে। একে একে সব সরঞ্জাম জোগাড় করে অবশেষে একদিন অমিত আর সাত্তার চাচা চললো গোস্বামী বাবুর খাদে মৎসশিকার করতে, আর তাদের সঙ্গ নিলো আরেকজন, উদ্দিন। আগেই বলেছি বালির খাদগুলো হতো খুব গভীর। গ্রীষ্মকালে খাদের জল পাড় থেকে পনেরো কুড়ি ফুট নিচে নেমে যেত। তাই মাছ ধরতে গেলে, শ্রমিক ওঠানামার জন্য যে পাড়টা ঢালু করে কাটা হতো সেই পাড় দিয়ে নেমে গিয়ে জলের কাছাকাছি বসতে হতো। তার মানে কেউ যখন খাদে মাছ ধরতে বসতো, খাদের পাড় থাকতো মেছুরের মাথার পনেরো ফুট ওপরে। যাক, অমিতরা জায়গায় পৌঁছে চার টার করে পরিপাটি করে বসলো মাছ ধরতে। সারাদিনের ব্যাপার। বাড়ি থেকে সবাই ভাত খেয়ে গেছে, আর উদ্দিন, সিমুই বানিয়ে নিয়ে গেছে দুপুরে খাওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে সকালটা গড়িয়ে গেল। মাছ যে ওঠেনি তা নয়, দু তিন কিলো ওজনের রুই মৃগেল। তবে যার জন্য আসা, সেই চোদ্দো পনেরো কিলোর কাতলার দেখা নেই তখনও। সাত্তার চাচার কথা অনুযায়ী, ওই সব কাতলা আসবে বিকেলের দিকে। যেন বিকেলের হাওয়া খেতে বেড়িয়ে সাত্তার চাচার টোপ গিলবে। অমিত আর উদ্দিন তো অসীম ধৈর্য নিয়ে বসে আছে, এই বুঝি ফাতনা ডুব মারলো। এদিকে তারা খেয়ালই করেনি কখন আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে। হঠাৎই অমিত সেটা খেয়াল করে সাত্তার চাচাকে বললো, ‘চাচা আকাশ দেখেছো? এক্ষুনি তো তুমুল বৃষ্টি নামবে গো’। উত্তরে সাত্তার চাচা বললো, ‘তবেই তো জমবে মজাটা, বড়ো বড়ো মাছ তো বৃষ্টির মধ্যেই টোপ ধরে’। সাত্তার চাচার কথা শেষ হতে না হতেই নামলো তুমুল বৃষ্টি। মুহুর্তের মধ্যে তিনজনে ভিজে চান করে গেল। মাছ ধরা মাথায় উঠলো অমিত আর উদ্দিন তখন জিনিসপত্র সামলাতেই ব্যস্ত। সাত্তার চাচার কিন্তু কোন হেলদোল নেই। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফাতনার দিকে। অমিত তাড়া লাগিয়ে বললো, ‘চাচা ছিপ গোটাও, না হলে এরপর ওই ঢালু পাড় দিয়ে ওঠা যাবে না’। চাচা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ওই জন্যই তোদের মতো চ্যাংড়া ছেলেদের নিয়ে মাছ ধরতে যেতে নেই, এইটুকু বৃষ্টিতেই ভয় পেয়ে গেল’। অবশ্য সাত্তার চাচার বীরত্ব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বৃষ্টির বেগ ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো, সাত্তার চাচা প্রমাদ গুনলো। ছিপের সুতো গুটোতে গুটোতে অমিতদের বললো, ‘নাঃ, আর বসে থাকাটা ঠিক হবেনা বুঝলি, তোরা মালপত্রগুলো পাড়ে তোল আমি আসছি’ অমিত আর উদ্দিন ওই বৃষ্টির মধ্যে মাছ ধরার সরঞ্জামগুলো যাহোক করে টেনে তুললো খাদের পাড়ে। তারপর আনতে গেল সাত্তার চাচাকে। আর ঠিক তখনই শুরু হলো আসল বিরম্বনা। খাদের ঢালু পাড়ের এঁটেল মাটি বৃষ্টির জলে তেল পড়ার মতো পিছল হয়ে আছে। ভারী চেহারার সাত্তার চাচা একহাত ওঠে তো হড়কে দু’হাত নেমে যায়। এদিকে সেই ঢাল দিয়ে নদীর মতো জল নামছে খাদের মধ্যে। একে পিছল তার উপর সেই জলের স্রোত সাত্তার চাচাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে খাদের দিকে। একবার খাদের জলে পড়লেই একশো দেড়শো ফুট গভীর। সাত্তার চাচা সাঁতার জানে, কিন্তু একে বয়স হয়েছে তার উপর ওঠানামার লড়াইএ দম শেষ। একবার খাদে পড়ে গেলে তলিয়ে যেতে সময় লাগবে না। অমিত আর উদ্দিন দুজনে মিলেও টেনে তুলতে পারছে না সাত্তার চাচাকে। অবশেষে বুদ্ধি লাগালো উদ্দিন। তিনজনের মাছধরা জালের তিনটে লাঠি পরপর পুঁতে দিলো সেই ঢালে, আর তার সঙ্গে বেঁধে দিলো তিনটে মাছ রাখার জাল। সাত্তার চাচাকে বললো সেই জাল গুলো ধরে ওঠার চেষ্টা করতে আর তারা দুজনে চাচাকে পিছন থেকে ঠেলতে লাগলো। চাচার হলো মহা মুশকিল, চিরকাল লুঙ্গি ছাড়া কিছু পড়া অভ্যাস নেই। একে দম শেষ, তার উপর জাল ধরে ওঠার চেষ্টা করে তো লুঙ্গি খুলে যায় আবার লুঙ্গি ধরে তো হাত থেকে জাল ছেড়ে যায়। চাচার তখন পরিত্রাহি অবস্থা। মাছ ধরার বীরত্ব সব শেষ, মুখে শুধু আল্লা, আল্লা ছাড়া আর কোন কথা নেই। যাই হোক অনেক পরিশ্রমের পর অবশেষে অমিত আর উদ্দিন সাত্তার চাচাকে টেনে তুললো খাদের পাড়ে। চাচা পাড়ে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘বাপেরা, আজ তোরা ছিলি বলে আমার জান বাঁচলো’। তারপর বৃষ্টি ছাড়লে সেদিনকার মতো তারা বাড়ি ফিরে এলো। কিন্তু ওই কথায় বলে না ‘মাতালের মন শুঁড়িখানায়’। দু’দিন যেতে না যেতেই সেই ভয়াবহ ঘটনা সাত্তার চাচার মন থেকে একরকম মুছেই গেল, বরং তার মনে বারবার ঘাই মারতে লাগলো গোস্বামী বাবুর খাদের পনেরো কিলো কাতলা। সে আবার অমিতকে ধরলো গোস্বামী বাবুর থেকে চিরকুট লিখিয়ে আনার জন্য। অমিতের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কি আর করে, সাত্তার চাচার তাড়ায় একদিন গোস্বামী বাবুর বাড়ি গিয়ে আবার একটা চিরকুট লিখিয়ে নিয়ে এলো। আবার একদিন দুজনে চললো সেই একই খাদে মাছ ধরতে। এবার অবশ্য অমিত সাত্তার চাচার কাছে কথা আদায় করেছে যে বৃষ্টি শুরু হলেই তারা উঠে আসবে। চাচা কথা দেওয়ার পর বলেছে, ‘কুছ পরোয়া নেহি, এবার এমন ব্যবস্থা করবো যে কোন সমস্যাই হবে না’। ব্যবস্থাটা হলো, সাত্তার চাচা সঙ্গে করে একজন লোক নিয়ে গেছে। সে গিয়ে কোদাল দিয়ে ওই ঢালটার ওপর সিঁড়ির মতো ধাপ কেটে দিয়েছে, আর একটা বড়ো দড়ি পাড়ের ওপরে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে সেই সিঁড়ির পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ব্যাস সব ব্যবস্থা করে সাত্তার চাচা মনোনিবেশ করলো সেই পনেরো কিলো কাতলার প্রতি। অমিতের কিন্তু মাছ ধরায় আজ ঠিক মন নেই। বারবার মনটা উসখুস করছে, যেন বসে থাকতেই ইচ্ছা করছে না। সেদিন কিন্তু একেবারেই মাছ ধরা হলো না। সকল থেকে একটা চুনোপুটিও টোপ ধরলো না। আর ঠিক দুপুর হতেই শুরু হলো সেই তুমুল বৃষ্টি। সেদিন বৃষ্টির রূপ যেন আরও ভয়ঙ্কর। অমিত জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলে তাড়া লাগালো সাত্তার চাচাকে। আজ আবার উদ্দিনও নেই। আগের দিনের মতো অবস্থা হলে অমিত একা কিছুই করতে পারবে না। সাত্তার চাচার ওঠার নাম নেই। তার মাথায় তখন জেদ চেপে গেছে। অমিতের হঠাৎই ভীষণ ভয় করতে লাগলো। সে সাত্তার চাচার হাত থেকে ছিপটা কেড়ে নিয়ে একরকম তার হাত ধরে টানতে টানতে উঠিয়ে নিয়ে এলো মাছ ধরার জায়গা থেকে। অমিত চাচাকে নিয়ে দশ পা গেছে কি যায়নি হঠাৎই খাদের পাড়ের একটা বিরাট অংশ ধস নামার মতো হুড়মুড় করে নেমে এসে অমিতদের বসার জায়গাটার ওপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লো খাদের জলে, আর তার ধাক্কায় খাদের জলটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দু’পাড়ে আছড়ে পরতে লাগলো। আর সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আতঙ্কে সাত্তার চাচা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো। তারপর অমিত ওই বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে গ্রামের লোকজন ডেকে এনে সাত্তার চাচাকে উদ্ধার করেছিল সেটা আর নাই বললাম। মানুষের জীবনে মাঝেমাঝে এমন কিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। সেদিন যদি অমিতদের উঠতে আর এক মিনিট দেরি হতো তাহলে হয়তো আজ আমার সুযোগ হতো না তাকে নিয়ে গল্প লেখার।

Loading

One thought on “গল্প- মৎসশিকার

Leave A Comment