Site icon আলাপী মন

গল্প- পর্ক বেঞ্জামিন

পর্ক বেঞ্জামিন
– বিশ্বদীপ মুখার্জী

এমন বহু মানুষ আছেন যারা নিজের মনের কোনও না কোনও সুপ্ত ইচ্ছেকে হৃদয়ের এক কোণায় তালাবন্দি করে চিরকালের মত ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কেউ সেই ইচ্ছেকে পূরণ করার চেষ্টা করেছেন, আবার কেউ সেই সুযোগটুকুও পাননি। এমন অগুনতি লোকেদের ভিড়ে নিজের নাম লেখাতে চাইতো না প্রহ্লাদ বিশ্বাস, যাকে আমরা ভালোবেসে পোলু বলে ডেকে থাকি। এখানে আমাদের আর পোলুর বন্ধুত্বে গল্প বলে সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি তার মনের সুপ্ত ইচ্ছের বিষয় বলাই ভালো। আমার চাকরি পাওয়ার পর প্ৰথম ছুটি। বন্ধুদের সাথে প্ল্যান করা হলো কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। অবশেষে জায়গা ঠিক হলো দার্জিলিং। আমরা মোট ছ’জন ছিলাম, তাদের মধ্যে একজন ছিল প্রহ্লাদ বিশ্বাস ওরফে পোলু। পোলু আমার থেকে বয়সে এক- দেড় বছরের ছোটই হবে। স্বভাবে বেশ শান্ত। কথা বেশি বলে না। বাবা মায়ের একটিমাত্র সন্তান সে। পোলুও সরকারি চাকরি খুঁজছে। পড়াশোনায় চিরকালই ভালো ছিলো সে। আমার বিশ্বাস তাকে সরকারি চাকরি পেতে বেশি বেগ পেতে হবে না।

শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেলে করে জলপাইগুড়ি স্টেশন, সেখান থেকে দার্জিলিং। আমাদের দার্জিলিং পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল। দার্জিলিং ম্যালের কাছে একটা হোটেল। ডাবল বেডের তিনটে রুম নেওয়া ছিল আমাদের। একটা রুমে আমি আর সুজল, দ্বিতীয় রুমে কল্যাণ আর পোলু এবং তৃতীয় রুমে অভিজিৎ আর শুভ্র। লাঞ্চ সেরে আমরা অল্প বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্ল্যান ছিল সন্ধ্যের দিকে আশেপাশের জায়গা গুলো ঘুরতে যাবো। লাঞ্চের পর বিছানায় শরীরটা এলাতেই কেমন যেন দু’ চোখ আপনি বন্ধ হয়ে গেল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি না। ঘুম ভাঙলো দরজা ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে। আমি আর সুজল দুজনেই ধড়ফড় করে উঠলাম। বুঝতে পারলাম যে সুজলও বেশ নিদ্রার দেশেই ছিল। দরজার ওপার থেকে কল্যাণের গলার আওয়াজ পাচ্ছি।
‘দীপ দরজা খোল।’
‘কী হলো রে আবার?’ আমি বিছানা থেকে উঠে দরজা খুললাম। দেখি সামনে কল্যাণের সাথে অভিজিৎ এবং শুভ্র দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।
‘কী হয়েছে?’ আমি আবার প্রশ্ন করলাম।
একটু বিরতি নিয়ে কল্যাণ বলতে শুরু করলো – ‘লাঞ্চ করার পর আমার ঘুম পাচ্ছিল। হয়তো ট্রেনের জার্নি করার ফলে। এমনিতে দুপুরে ঘুমোবার আমার অভ্যাস নেই। কিন্তু এই ঘাটের মরা ঘুমটা আজকেই আসার ছিল।’
‘উফফ! এত ভূমিকা দেওয়ার কী আছে? ভূমিকা না দিয়ে কি কোনও কথা বলতে পারিস না? পরীক্ষার খাতায় যদি এত সুন্দর ভূমিকা লিখতে পারতিস তাহলে ভালো নাম্বার পেয়ে পাস করতিস। এবার ভূমিকা না দিয়ে ডাইরেক্ট সাবজেক্টে আয়।’
কথাটা বেশ বিরক্ত হয়েই আমি বললাম। কল্যাণের এটা চিরকালের অভ্যাস। বিনা ভূমিকা দিয়ে কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব না।
এবার অভিজিৎ বলল – ‘পোলুকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে হারিয়ে গেছে।’
‘হোয়াট! হারিয়ে গেছে? সে কি কচি বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবে?’ আমি বললাম।
‘সেটা তো আমিও বলছি। এই ঘাটের মরা ঘুম যদি না আসতো তাহলে হয়তো সে আমাকে বলেই যেত যে কোথায় যাচ্ছে সে। আমাকে মরার মত ঘুমোতে দেখে সে হয়তো আমায় কিছু বলেনি। ঘুম ভাঙার পর দেখি দরজা খোলা। ভাবলাম তোদের রুমে হবে। কিন্তু সে তো এখন কোথাও নেই। তার মানে এটা মেনে নেওয়া যেতেই পারে যে পোলু হারিয়ে গেছে।’
কল্যাণের এই ব্যাখ্যাতে অল্প হলেও মাথাটা গরম হলো আমার। যথা সম্ভব মাথা ঠান্ডা করে বললাম- ‘আশেপাশে কোথাও ঘুরতে গেছে হয়তো। চলে আসবে এক্ষুনি।’
‘তুই বুঝবি না দীপ আমার টেনশন। রওনা হওয়ার আগে পোলুর মা আমায় বারবার বলে দিয়েছিল যে ওর বিশেষ খেয়াল রাখতে। আজকাল বড্ড অন্যমনস্ক থাকে। এবার আমি তার মাকে কী জবাব দেবো?’ কল্যাণের গলা শুনে মনে হলো সে বেশ টেনশনে আছে।
‘ব্যাপারটা এত হাল্কা ভাবে নিলে চলবে না দীপদা।’ আমার পিছন থেকে সুজল বললো- ‘কল্যাণদা বলছে যে পোলু নাকি আজকাল অন্যমনস্ক থাকে। তার মানে হলো সে এই জগতে কম এবং অন্য জগতে বেশি থাকে আজকাল। ক্রনিক সাইক্রিয়াটিক ডিসিস। কল্যাণদা, তুমি আগে বললে না কেন? আমরা আগে থেকে সাবধান হতে পারতাম।’
‘তোদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আজেবাজে কথা বলছিস কেন?’ আমার কন্ঠস্বর একটু উচ্চ হলো।
‘একটু আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলে হয় না?’ একটা প্রস্তাব দিলো সুজল।
‘হোটেলের চারিপাশে দেখে নিয়েছি। কোত্থাও নেই সে। লাস্ট এই ঘরে এলাম।’ শুভ্র বললো।
‘আরও একবার দেখতে ক্ষতি কী? চলো না, গিয়ে দেখাই যাক একবার।’
সুজলের কথায় আমরা আরও একবার তল্লাশি শুরু করলাম। হোটেলের চত্বর ঘুরে দেখে নেওয়া হলো। হোটেলের চারিপাশে সুন্দর বাগান। সুজল এবং শুভ্র বাগানের দিকে এগলো।
‘বাগানে দেখে কী করবি? পোলু কি ওখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে নাকি অকারণ?’ প্রায় চিৎকার করেই আমি বললাম।
সুজলের গোয়েন্দা গল্প পড়ার খুব শখ। কোথাও রহস্যের গন্ধ পেলেই তার মস্তিষ্কে ডিটেকটিভ বুদ্ধির আলোটা জ্বলে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। বাগানে বেশ কিছু সুন্দর ডিজাইনের আলো জ্বলে গেল। সুজল ও শুভ্র নিজের নিজের মোবাইলের টর্চ অন করে এগিয়ে গেল বাগানের দিকে। গাছগাছালির ভিতর টর্চ নিয়ে তারা এমন করে খুঁজতে লাগলো যেন পোলু কোনও জলজ্যান্ত মানুষ না, সে যেন কোনও ছোট্ট বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে যেটা বাগানের কোনও এক কোণায় পড়ে আছে।
আমি আর ওদিকে তাকালাম না। কল্যাণ, অভিজিৎকে সাথে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিছুটা হাঁটার পরেই আবছা আলোতে বেশ খুশি মনেই পোলুকে আমাদের দিকে আসতে দেখলাম। আমরাও এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
‘কী রে! কোথায় চলে গিয়েছিলিস তুই?’ কল্যাণের কন্ঠে বেশ উদ্বিগ্নতার ছাপ।
‘একটা জিনিস খুঁজতে গিয়েছিলাম ভাই।’ বললো পোলু।
‘কী জিনিস?’
‘জিনিসটা আসলে একটা খাবার। ওটা নাকি এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে খুব ভালো বানায়। সেটাই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। একদিন নিয়ে যাবো তোদের সবাইকে।’
‘ডিশটার নাম কী?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘পর্ক বেঞ্জামিন। বেঞ্জামিন নামের কোনও এক ইংরেজ এখানে থাকতেন। তিনিই নাকি এই ডিশটা প্রথম বানিয়ে খাওয়ান। কোলকাতায় থাকতে পর্ক বেঞ্জামিন একজনের হাতে খেয়েছিলাম, কিন্তু খুব একটা ভালো লাগেনি। শুনেছিলাম দার্জিলিংয়ের এক রেস্তরাঁতে পর্ক বেঞ্জামিন নাকি খুব ভালো বানানো হয়। সেটাই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।’
‘ধুর গাধা। খোঁজ নিতে গিয়েছিলিস ভালো কথা। কিন্তু বলে যাবি তো। এটুকু আক্কেল নেই?’ বেশ বিরক্তির স্বরে বলল কল্যাণ।
‘ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে ঘুম থেকে ওঠাতে নেই।’
আমরা হোটেলে ফেরত এলাম। মুখ্য দরজার সামনে মুখ চুন করে দাঁড়িয়েছিল সুজল আর শুভ্র। পোলুকে দেখতে পেয়েই তারা এগিয়ে এলো তার দিকে। আমি সুজলের পিঠে এক চাপড় মেরে বললাম- ‘কী গোয়েন্দা? খুঁজে পেলে অপরাধীকে?’

আশেপাশের চারিদিক ঘুরেফিরে আমরা হোটেলে ফিরলাম রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ। হোটেলে ফিরেই শুভ্র বলল – ‘কিছু খাওয়া হলো না যে। খিদে তো পেয়েছে।’
আমরা সবাই একে অপরের দিকে তাকালাম। ঠিকই তো। আমরা কি তাহলে এবার খেতেও ভুলে যাচ্ছি? এহেন অবস্থায় কী করা যায় সেটা চিন্তা করা হলো। হোটেলে এত রাতে আর খাবার পাবো না, সুতরাং বাইরে থেকেই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। হোটেলের পাশেই একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে সেটা আমি আগেই দেখেছি। আজকের ডিনারের ব্যবস্থা না হয় সেখানেই করা যাক। তবে সেখানে গিয়ে ডিনার করতে কেউ রাজি হলো না। বলতে গেলে প্রায় প্রত্যেকেই ক্লান্ত। আমি আর কল্যাণ গিয়ে সেখান থেকে ডিনার প্যাক করে নিয়ে এলাম।
ডিনারের অর্ধেকটাও শেষ হয়নি, কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। ক্ষণেকের জন্য মনে হলো যেন আমরা হোটেলে না, কোনও দোলনায় দুলছি। এই অদ্ভুত অনুভূতি কি শুধু আমার হলো? আমি খাবার থেকে চোখ তুলে সবার দিকে তাকালাম। দেখলাম প্রত্যেকেই আমার দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘এটা কী হলো?’ প্রশ্ন করলো সুজল।
তার প্রশ্ন করার সাথে সাথেই মাটিটা যেন আবার দুলে গেল। বেশ হইহল্লার আওয়াজ পাচ্ছিলাম বাইরে থেকে। বুঝতে দেরি হলো না যে আমরা ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছি। ভূমিকম্পটা বেশ ভালোই জোরে এসেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। ডিনার অর্ধেক ফেলে আমরা ছুটলাম বাইরের দিকে। আমাদের রুমগুলো ছিল দু’তলায়। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখি ইতিমধ্যেই সিঁড়িতে লোকেদের প্রাচুর্য। কোনও রকমে হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা রাস্তায় এলাম। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। বেশ কিছু সেকেন্ড ভালো রকম ধাক্কা দেওয়ার পর ভূমির কম্পনটা এখন যেন একটু স্থির হয়েছে। আশেপাশের বেশ কিছু হোটেল, বাড়ি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। আমাদের হোটেলের ক্ষতির পরিমাণটা বোঝার উপায় তখন ছিল না আমাদের। এর মধ্যেই কল্যাণকে বলতে শুনলাম – ‘হে ভগবান! আমার দামি ক্যামেরাটার যেন কিছু না হয়।’
‘কী উন্মাদের মত বকছিস? নিজে বাঁচবো কি না তার ঠিক নেই, তোর ক্যামেরার চিন্তা।’ কল্যাণের কথা শুনে শুভ্র বলল।
হঠাৎ পোলুর গলার আওয়াজ পেলাম। বিড়বিড় করে কিছু যেন বলছে সে। আমি ভালো করে কান লাগিয়ে শুনলাম।
‘এবার মনে হয় মরেই যাবো। পর্ক বেঞ্জামিন আর খাওয়া হলো না। না, ওটা আমায় খেতেই হবে। ওটা না খেয়ে আমি মরতে চাই না।’
পোলুর কথাটা শুনেও ইগনোর করে যাওয়াটা হয়তো আমার ভুল ছিল, কারণ খানিক পরেই আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রাস্তায় লোকেদের ভালো ভিড়। এই ভিড়ে তাকে খুঁজবো কোথায়?
‘পোলুটা আবার কোথায় মরে গেলে। ভালো লাগে না সত্যি। কেন যে ও মাঝে মাঝে গায়েব হয়ে যায়?’ কথাগুলো বেশ বিরক্তির সুরেই কল্যাণ বলল।
‘পোলু নিশ্চয়ই পর্ক বেঞ্জামিন খেতে গেছে। বিড়বিড় করে বলছিল শুনলাম।’ বললাম আমি।
‘তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি। এই অবস্থায় ও পর্ক বেঞ্জামিন খেতে যাবে?’ আমার উপর প্রায় ঝেঁঝিয়ে উঠলো অভিজিৎ।
আমিও মাথা গরম করে চিৎকার করে ফেললাম – ‘তাহলে খোঁজ পাগলের মত এদিক ওদিক। পেয়ে গেলে আমাকে জানিয়ে দিস।’
‘ধুর বাবা! তোরা ঝগড়া করছিস কেন? একে তো এমন বিপত্তি আমাদের সামনে, তার উপর পোলু নেই। টেনশনের অভাব নেই। তার উপর তোরা ঝগড়া করিস না দয়া করে।’ আমাকে আর অভিজিৎকে শান্ত করার জন্য কল্যাণ বলল।
ইতিমধ্যেই বেজে উঠলো কল্যাণের মোবাইল। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে গেল।
‘প….পোলুর ম….ম….মা ফোন করেছে। মরে গেলাম রে। কী বলি এবার?’ দু – চারটে ঢোঁক গেলার পর কল্যাণ বলল।
‘ফোনটা তোল। তার মাকে বল যে পোলু এখন বাথরুমে। একটু পর ফোন করতে না তো নিজের ছেলের নাম্বারে কল করতে।’ অভিজিৎ বললো।
‘নিশ্চই পোলুর নাম্বার লাগছে না। তবেই তো আমার নাম্বারে কল করেছে। এখন যদি বলে দিই একটু পরে কল করতে, তাহলে একটু পরে কল করলে কী বলবো তাকে? এটাই যে তার ছেলে হারিয়ে গেছে?’
‘উফফ! এতো ভারী সমস্যা। ফোন কাট, চল আগে পোলুকে খুঁজে বের করি।’ অভিজিৎ বললো।
তার কথার মত ফোন ডিসকানেক্ট করে দিলো কল্যাণ।
‘কিন্তু তাকে খুঁজবো কোথায়?’ কল্যাণ জিজ্ঞাসা করলো।
‘আরে দীপদাই তো বলল যে সে হয়তো পর্ক খেতে গেছে। কোনও রেস্তরাঁতে গিয়ে খুঁজলেই হলো।’ বললো সুজল।
‘শুধু পর্ক নয় ভাই, ওটা পর্ক বেঞ্জামিন। এখন খুঁজতে হবে এখানে কোন হোটেলে পর্ক বেঞ্জামিন নামের ডিশ পাওয়া যায়। পোলু যদি হোটেলের নামটা বলে রাখতো তাহলে চট করে খুঁজে নেওয়া যেত তাকে।’ হতাশার স্বরে শুভ্র বলল।
‘আরে প্রবলেম কী? কোনও লোকাল লোককে জিজ্ঞাসা করলেই সে বলে দেবে।’ মন্তব্য করলো সুজল।
‘ধরে মারবে লোকেরা। ভূমিকম্পে প্রত্যেকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, এখন তোকে হোটেলের নাম বলতে বয়ে গেছে তাদের।’ বললো অভিজিৎ।
খানিক এদিক ওদিক খোঁজার পর যখন কোনও লাভ হলো না, তখন অবশেষে লোকাল লোককে জিজ্ঞাসা করতেই হলো। কোনও অচেনা লোককে জিজ্ঞাসা করার থেকে ভালো নিজের হোটেলের কোনও কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করা। আমি তাই করলাম। কর্মচারী রেস্তোরাঁর নাম বলল। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম – ‘এখান থেকে কত দূর?’
‘খুব বেশি দূর না সাহেব। হোটেলের বাঁ দিকে দিয়ে সোজা চলে যান, সামনে একটা মোড় পাবেন। সেখান থেকে বাঁ দিকে ঘুরে একটু এগোলেই ডান হাতে পড়বে। চড়াই পথ তো, তাই প্রায় দশ মিনিট লাগবে যেতে।’ সে পথ বলে দিলো।
আর কী! আমরা এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা সে দিকেই হাঁটা দিলাম। সারা রাস্তা অভিজিৎ গজগজ করতে লাগলো।
‘এ তো দেখছি একেবারে উন্মাদ। একে তো নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। একে যদি আজ রাতে খুঁজে পেয়েও যাই, তাও শিওর থাক যে এর জন্য আমাদের এই ট্রিপটা জলাঞ্জলি যাবে।’
কল্যাণ এতক্ষণে নিজের মোবাইল সুইচ অফ করে দিয়েছে। বারবার পোলুর মায়ের কল কাটতে খারাপ লাগছিল তার। আমরা যখন সেই রেস্তরাঁতে পৌঁছলাম, দেখি পোলু বেশ মনোযোগ দিয়ে কিছু খেয়ে চলেছে। নিঃসন্দেহে সে পর্ক বেঞ্জামিন খাচ্ছে। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই সে বললো- ‘ওহো! তোরা এসে গেলি? ওয়েটার, আরও পাঁচ প্লেট লাগিয়ে দাও। বসে পর তোরা। কিছু মনে করিস না। তোদের না বলেই চলে এলাম।’
আমরা হাঁ হয়ে একে অপরের দিকে দেখলাম। কী বলবো কিছুই বুঝতে পারলাম না। পর্ক বেঞ্জামিনের প্রথম টুকরোটা মুখে দিতেই মনে হলো- ‘চুলোয় যাক ভূমিকম্প। এখন খাবারে মনোনিবেশ করা যাক।’

সমাপ্ত।

Exit mobile version