Site icon আলাপী মন

গল্প- সূর্যোদয়

সূর্যোদয়
– অঞ্জনা গোড়িয়া

ঠিক রাত বারোটা। বিছানায় শুয়ে ছটপট করছে সুজয়। প্রতি রাতেই সে এমন করে। কিছুতেই ঘুম আসে না। হাইপার টেনশনের জন্য প্রতিদিন একটা করে ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হয়। মাথার ওপর ঘুরছে পাখা। তবু সারা মুখ বিন্দু বিন্দু জলকণাতে ভরে গেছে।
ট্যাবলেটগুলো হাতের মুঠোতে শক্ত করে ধরে রেখেছে। পাশে শুয়ে ঘুমন্ত ছেলে। আর স্ত্রী সাথী।
একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে ওদের মায়াবী মুখখানা। নিজেকে শক্ত করলো। দুর্বল হলে চলবে না। বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। কেউ কোথাও জেগে নেই। সুজয় আজ একা। তাকে চলে যেতে হবে। এ পৃথিবী থেকে। জীবন থেকে। মুক্তি চায়। মুক্তির একমাত্র উপায় চিরন্তন ঘুম।
সকাল হলেই ছুটে আসবে ওরা। দলে দলে ঘিরে ধরবে সুজয়কে। একরাশ দাবী নিয়ে।
কোথায় তাদের সঞ্চিত অর্থ? সবাই ঠকবাজ বলবে। মান সম্মান মিশে যাবে ধূলায়। কি উত্তর দেবে? এমনটা হবে, সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।
অনেক আশা নিয়ে সঞ্চিত অর্থ জমা দিয়ে ছিল ওরা। ভরসা করে ছিল অনেক বেশি। বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা সব শেষ হয়ে গেল।
সে আর কিছুই ফেরত দিতে পারবে না। সে আজ নিঃস্ব।
নিজের স্বর্বস্ব দিয়ে দুই বন্ধুর সাথে মিলিত হয়ে একটা ফান্ড তৈরী করে ছিল।
গ্রামবাসীরা নিজেদের উন্নয়নের জন্য এই ফান্ডে জমা দিত টাকা। বিশ্বাস করে অনেক ভরসা নিয়ে।
প্রাণের চেয়ে প্রিয় দুই বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ হয়ে গেল এত বড়ো একটা ফান্ড।
সমস্ত টাকা তুলে পালিয়ে যায় দূরে। ফোনে সুইচ অফ। তাদের কোথাও খোঁজ মিললো না। সমস্ত দায়িত্ব একা সুজয়ের ঘাড়ে। কি করে শোধ দেবে এত টাকা? মানুষকে ঠকিয়ে বিশ্বাসঘাতক নামে সে কিছুতেই বাঁচবে না। তাকে মরতেই হবে।
ছেলের মুখটা খুব মনে পড়ছে। আর দেরি নয়।
ওষুধগুলো মুখে পুরে দিল। এবার নিশ্চিন্ত ঘুম। আর ফিরবে না এ পৃথিবীতে। মনে পড়ছে ছেলের ঘুমন্ত মুখটা। আঃ কি শান্তি।

আধো আলোতে আবছা হয়ে আসছে চোখের পাতা। কেউ কি ডাকছে। চোখ খুলতে পারছি না কেন? তবে কি মরে যাচ্ছি?
সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটি আবছা মুর্তি।
চেঁচিয়ে ওঠে- আমায় নিয়ে যেতে এসেছ? এসো নিয়ে চলো। আমি মরে গেছি। যমদূত এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে। নিয়ে চলো এখুনি। ওরা এসে পড়বে।
আঃ কি অসহ্য যন্ত্রণা। আর সইতে পারছি না। কেন এমনটা হলো? মুক্তি চাই। মুক্তি।

একি! মাথায় কাছে এটা কি? স্যালাইন বোতল। প্রেসার মাপছে কে? ডাক্তারবাবু?
এখনো বেঁচে তার মানে!
কি করে সম্ভব? স্যালাইন টান মেরে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বেঁচে থাকলে হবে না। ওরা ঠিক ধরে ফেলবে। মৃত্যু চাই..মৃত্যু।
ঠিক তখনই হাতটা চেপে ধরে কচি দু’টো হাত।
মিষ্টি স্বরে বলে,”বাবা’। কি হয়েছে তোমার? এটা টানছো কেন? জানো না তোমার শরীর খারাপ?
– তুমি হসপিটালে কেন?
– দুদিন দেখিনি তোমায়। খুব মন কেমন করছিল। তাই তো মা আজ নিয়ে এলো তোমার কাছে। আমার পাশে ঘুমাচ্ছিলে। তারপর কোথায় চলে গেলে? বলো না বাবা, কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার?
চোখটা খোলার চেষ্টা করলো। সুজয় এখন হসপিটালের বেডে শুয়ে। মরতে পারে নি। বাঁচিয়ে দিয়েছে এরা।
ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো ছেলের মুখের দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সরল মায়াভরা মুখ। আঃ কি শান্তি। আদর করতে ইচ্ছে করছে।
পাশে দাঁড়িয়ে সাথী। বিবাহিত স্ত্রী। চোখের কোণে জল রেখা।
মৃদুস্বরে বললঝ, ‘পালিয়ে যেতে চাইছো? আমাদের ফাঁকি দিয়ে, একা করে। চলো একসাথে যাই। এই দেখো আরও এনেছি ওষুধ। আজ তিন জনে একসাথে খাবো।
সাথী ওষুধটা এগিয়ে দিল ছেলের দিকে। খেয়ে নাও সোনা। মিষ্টি ওষুধ। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়বো আমরা।
সুজয় হাত থেকে ফেলে দিল.. কি করছ সাথী? এইটুকু ছেলেকে এসব কি বলছো?
– একবার ভেবে দেখেছো,”তুমি চলে গেলে আমাদের কি হতো? এখন বলছো এসব কথা। কে দেখতো আমাদের? সমাজের বুকে বিশ্বাসঘাতকের ছেলে হয়ে বেঁচে থাকতে হতো ওকে।
– কি লাভ বেঁচে থেকে?
– জীবন থেকে পালিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। লড়াই করে একসাথে বেঁচে থাকাটাই সমাধান। একবার ভাবলে না আমাদের কথা। ছেলের কথা।
সুজয়ের চোখ ভারি হয়ে আসে।
সাথী সুজয়ের হাতটা চেপে ধরলো। আমরা আছি একসাথে। ন্যায়ের পক্ষে মাথা উঁচু করে বাঁচবো।
সুজয় নতুন করে চিনলো তাকে। নতুন এক জীবনের সূর্যোদয়।

Exit mobile version