গল্প

অণুগল্প- ভরদ্বাজ

ভরদ্বাজ
– শান্তনু ব্যানার্জী

 

 

কলকাতায় বড়ো হয়ে ওঠা রতন তেওয়ারি আমেদাবাদের হোটেলে চেক- ইন’এর সাথে সাথে রিসেপশনে মিঃ সুরেশ প্যাটেলের ফোন। কোম্পানির মালিক। ছয় মাস হলো এই কোম্পানিতে জয়েন করে কলকাতায় বসে বাংলা সহ পাশাপাশি আরও তিনটে স্টেটের কাজকর্ম দেখছে। মালিক বাড়িতে সন্ধ্যার সময় ডেকে পাঠিয়েছে কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বোধ হয় কোনো পুজো আছে। পরে আরও দু’দিন থাকা হবে ব্যাবসার আলোচনার জন্য।
গুজরাতের ব্যবসায়ীরা অনেকেই খুব বিত্তশালী। ক্ষীণ চেহারার লোকও কায়িক পরিশ্রমে ভয় পায় না । সাধারণত সব কোম্পানিই দেশের বিভিন্ন শহরে দু’ মাস অন্তর ভালো হোটেল ভাড়া নিয়ে মিটিং করে। কিন্তু কোলকাতায় আয়ুর্বেদিক ওষুধের ব্যবসার অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। অথচ আয়ুর্বেদিক ব্যাবসা প্যাটেলের প্রাণ। তাই তিন পুরুষ কলকাতায় বাস করা তেওয়ারিকে সিলেক্ট করেছে। ইউনিয়নকে ভয় করে কোনো বাঙালী রাখেনি। তাছাড়া তেওয়ারি ভালো বাংলাও জানে। কলকাতার সংস্কৃতিরও ছোঁয়া আছে ।
অধ্যাবসায় আজ সুরেশ প্যাটেলকে এই জায়গায় এনে দিয়েছে। আগে ওষুধের দোকানে কাউন্টারে কাজ করতো। তখন দেখে ছিল আয়ুর্বেদিক ওষুধের বিদেশেও চাহিদা আছে। বাইশ বছর বয়সে দোকানের চাকরি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতেই আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করা শুরু করলো । দোকানে দোকানে সাইকেলে করে নিজের তৈরী ওষুধ সাপ্লাই করতো। আজ বাষট্টি বছর বয়সে কয়েক শত কোটি টাকার মালিক। অফিস, ফ্যাক্টরি সবই ঝা চকচকে।
ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় হোটেলে গাড়ি এলো। মিনিট কুড়ির মধ্যে মালিকের বাড়ি। বাড়িতে ঠাটবাট বলতে কিছু নেই। সাধারণ ভাবে পরিবার বর্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। দেশের অন্য কোনো জায়গা থেকে কোনো ম্যানেজারকেই ডাকা হয়নি। কিন্তু সপরিবারে ফ্যাক্টরির সমস্ত শ্রমিকই উপস্থিত ছিল। প্রায় সত্তর আশি জন হবে। এরা সবাই শতরঞ্জি পেতে বসেছিল।
কথা বলতে বলতে বাড়ির সকলের সাথে সুন্দর গ্লাসে গাঢ় কালো রঙের পানীয় দিয়ে গেল। একটু হকচকিয়ে গেলেও তেওয়ারি বুঝতে পারলো যে ওটা ফলের রস। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই একটা নাম খুব শুনতে পাচ্ছিল- ভরদ্বাজ.. ভরদ্বাজ প্রায় সবার মুখেই। কিন্তু ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে মিউজিক সিস্টেম এসে গেলো। সামনে স্টেজের মতো করা আছে। মাঝখানে একটা সিংহাসনের মতো চেয়ার। তার চারপাশে অনেক জায়গা। সে জায়গায় মালিক পক্ষের পরিবার বর্গ। অন্য দিকে শ্রমিকদের পরিবার বর্গ। মিউজিক শুরু হতেই মালিক তেওয়ারির হাত ধরে টেনে নিল। তেওয়ারি নাচানাচিতে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। ঘরোয়া পরিবেশে বেঢপ শরীরে শাড়ি পরে নাচা দেখে তেওয়ারি মালিকের হাত ধরে কোমর দোলাতে শুরু করলো।
এর মধ্যে একটা গুঞ্জন ভরদ্বাজ এসে গেছে। দেখি সামনে দাঁড়িয়ে এক সাদা চুল এবং লম্বা দাড়িওলা প্রায় ছ ফুট উচ্চতার মানুষ। প্রথমেই মালিক এবং পরিবার বর্গ এক এক করে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো। তেওয়ারিও বুঝে না বুঝে একটা পেন্নাম ঠুকে দিল। এরপর সেই সিংহাসনে ভরদ্বাজকে বসানো হলো। এরপর শ্রমিকদের হুড়োহুড়ি লেগে গেল ভরদ্বাজের চরণ যুগল স্পর্শ করে আশীর্বাদ নেবার জন্য। শ্রমিকদের মতো করে এক ঘণ্টা ধরে উদাত্ত গলায় উপদেশ দিয়ে গেলেন। যার মর্মার্থ হচ্ছে ভগবানের আশীর্বাদ পেতে গেলে মালিকের ইচ্ছা মত মন দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। কারণ ভরদ্বাজ যে তাদের খুব চেনা লোক। এখন মালিকও তাকে পায়ে ধরে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। এরপর প্রসাদ খাইয়ে শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তেওয়ারিকে গাড়িতে করে হোটেলে পৌছে দিল। আর ভরদ্বাজকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল।

পরিশেষে এই আমাদের ভারতবর্ষ। অন্ধবিশ্বাসে কেউ ঠকে, কেউ ঠকায়। এরকম ভরদ্বাজ অফিসে কারখানায় বহু ছড়িয়ে আছে।

এই ভরদ্বাজের আসল পরিচয় কি? দু’ বছর আগে ঐ কোম্পানিতেই চাকরি করতো । ইউনিয়ন করার জন্য কোম্পানি বরখাস্ত করে অন্য কোনো দোষ দেখিয়ে। সাময়িক ভাবে শ্রমিকরা চুপ করে যায়। আবার আন্দোলন দানা বাঁধলে ভরদ্বাজকে অন্য ভুমিকায় ডেকে নিয়ে আসে। মালিক নিজের পরিবারের সকলকে নিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে শ্রমিকদের বিশ্বাস অর্জন করে নিজের কাজ হাসিল করে নেয়।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page