Site icon আলাপী মন

প্রতিবেদন- বিশল্যকরণী

বিশল্যকরণী
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

রণাঙ্গনে লক্ষ্মণ ধরাশায়ী। প্রাণ সংশয়। বিশল্যকরণী চাই। এক্ষুনি চাই। ইমার্জেন্সি। রামের অনুজ বলে কথা। সাধারণ বানর সেনার মধ্যে কেউ হলে, ভবিতব্য বলে চালিয়ে দেওয়া যেতেই পারতো। যা ইতিমধ্যে গেছেও।
সাধারণের কপাল, অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য দিয়েই গড়া। কিন্তু এই কেসটা তো তেমন হতে পারে না। উচ্চবর্গীয় রাজতনয় তথা স্বয়ং অবতারের অন্ধ ভক্ত ভ্রাতা, সাধারণ বানর সেনার ন্যায় বেঘোরে মরতে পারে না। আভিজাত্যের অবমাননা অসহ্য। ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
সুতরাং বিশেষ জনের বিশেষ ব্যবস্থার নিদান। বিশল্যকরণী চাই। সূর্য অস্ত যাওয়ার পুর্বেই চাই।
নতুবা,
অবতার বিবশ অসহায়। হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলেন। হায় রে ভ্রাতা মোর, ভ্রাতা মোর, চোখ খোল একটি বার…
ভার পড়ল অবতারের একনিষ্ঠ ভক্ত হনুমানের ওপরে। যেভাবে পারো, যেমন করে পারো নিয়ে এসো বিশল্যকরণী। এই একমাত্র ঔষধি। যদি ভক্ত ভ্রাতার পুনর্জীবন চাও। তাহলে এক্ষুনি ব্যবস্থা করো। যাও, কালক্ষয় করো না। যাও।
ভক্ত হনুমান আদেশ পাওয়া মাত্র, মারলো একটা বিশাল লাফ। পৌঁছে গেল গন্ধমাদন পর্বতের চূড়ায়। চারিদিকে ঘন অরণ্যের মাঝে হনুমান দিশাহারা। হায় হায়, কী আপদ। এই এতো গাছগাছালির মধ্যে কোথায় সেই প্রাণদাত্রী গাছ। কোনটি? সেটা হোয়াটসঅ্যাপের যুগ নয়, যে ঝপ করে গোটাকতক ছবি তুলে ফটাফট পাঠিয়ে কনফার্ম করে নেবে। ওদিকে সময় পালায়। টেনশন বাড়ছে। দুরছাই নিকুচি করেছে। চল, গোটা পাহাড় শুদ্ধু উবড়ে নিয়ে চল। যাবে কোথায় বাছাধন। এরমধ্যেই তো আছে নিশ্চিত সেই অভিষ্ঠ বিশল্যকরণী। চল। যে চেনে সে খুঁজে নেবে।
ব্যস, যেমন ভাবা তেমন কাজ। উড়ন্ত হনুমানের হাতে বিশাল গন্ধমাদন।
কেল্লাফতে। লক্ষণের পুনর্জীবন লাভ। অবতারের মুখে বিজয় খুশির চওড়া হাসি। হনুমানের শক্ত কাঁধে সাবাশি চপেটাঘাত। জিও হনুমান জিও বেটা।
এখন প্রশ্ন হতেই পারে, হঠাৎ এই গল্পের অবতারণা কেন? কারণ কী?
আছে। কারণ আছে।
গ্রামের যুবক ছেলে। হঠাৎ অসুস্থ। এখন মারণব্যাধির মহামারী। ডাকলেও সহজে কেউ রোগীর কাছে ঘেঁষতে চায় না।
পৃথিবী বদলে গেছে। দুরত্বই এখন দস্তুর। তাই বলে তো রোগীর চিকিৎসা থেমে থাকতে পারেনা।
ছেলেটির বাবা মা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যোগাড় করলো এম্বুলেন্স। প্রবল বিশ্বাসে ভর করে। হাসপাতালে গেলেই বাছা আমার সুস্থ হয়ে যাবে। ওখানেই আছে বিশল্যকরণী। যার পবিত্র ছোঁয়ায়, আবারও জেগে উঠবে, ভরসার প্রাণ।

মানুষ তো বিশ্বাসেই বাঁচে। বিশ্বাস ভাঙলেই নিরাশা, আতঙ্ক। দিশাহারা অজানা অনিশ্চয়তার ছোটাছুটি। এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতাল। সেই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল।
সকলেই দায়সারা স্তোকবাক্য শোনায় আর দূরে সরিয়ে দেয়।
মৃত্যু ভয়, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।

একমাত্র সন্তানের জনক জননী, ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে আসা সন্তানের মুখের পানে অসহায় নিরুপায় চাহনিতে চেয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ নিথর পাথরের মতো হয়ে উঠছিল।
পৃথিবী ঢেকে যাচ্ছিলো নিকষকালো অন্ধকারে। চোখে ছিলো মরুভূমির শুষ্কতা। মন ছিল অনন্ত সমুদ্রের মাঝে দিকহারা নৌকোর মতো দোদুল্যমান। একটুকরো ভূখণ্ডের প্রত্যাশায় চঞ্চল।
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই। ছোট এ তরী। হৃদয় আরও ছোটো।
তবুও ঠাঁই পেলো সেই যৌবন। না না । মানবিক সেবা সহানুভূতির দরবারী কোলে নয়। অযাচিত অকাল মৃত্যুর শান্ত কোলে।
বাহাত্তুরে স্বাধীনতার লাল কেল্লার লালচে পাথরের প্রাচীরে উড্ডীয়মান ত্রিরঙার প্রতি মুচকি হাসি হেসে, চিরবিদায় নিলো, ব্যর্থ মৃত্যুঞ্জয়।
বিশল্যকরণীর গর্ভস্থান গন্ধমাদন রইলো দূরে, অনেক অনেক দূরে।
হায় হতভাগ্য, তোমার জন্য অপেক্ষায় নেই কোনও ভক্ত হনুমান। তুমি সাধারণ। অতি সাধারণ দেশভক্ত ভোটার নাগরিক।

সেদিন রাতে। শ্মশানের লেলিহান শিখার অনতিদূরে প্রজ্বলিত ছিল আরও একটি যাগযজ্ঞ অগ্নিশিখা।
সেখানকার শুভশঙ্খ কাঁসর ধ্বনির সাথে পবিত্র মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে, মুখরিত হয়ে বিস্তারিত হচ্ছিল সমস্ত নির্মল আকাশ বাতাসে।
আজ একজন লক্ষ্মণ, একটি বিলাসী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হয়েছেন নির্বিঘ্নে, অনায়াসে।
লক্ষ কোটি ভক্তকুল , লক্ষণের রোগমুক্তির কাতর প্রার্থনায় রত।

ওই চেয়ে দ্যাখো…একহাতে গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে উড়ন্ত হনুমানের আগমন। ওতেই আছে বিশল্যকরণী। শুধু খুঁজে নিয়ে প্রয়োগের অপেক্ষা।
হায়রে…
ঈশ্বর কী তবে, তোয়াজের গোলাম?

Exit mobile version