গল্প- নারদ বায়স

গল্প-নারদ বায়স
লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

উচ্চ মাধ্যমিকে আশি শতাংশ নাম্বার নিয়ে পাশ করা সত্বেও অনার্স নিয়ে ভর্তি না হয়ে তিথি নর্মাল পাস কোর্সে গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হল। যদিও তার এই সিদ্ধান্তের আত্মীয়-পরিজন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে অনেক উপহাস জুটেছিল। পাঁচজনের পাঁচ কথাতেও কিন্তু তিথির কোন মানসিক পরিবর্তন হয়নি। সে অনড়। তাকে ইউ পি এস সির জন্য তৈরি হতে হবেই। তার জন্য তাকে গ্যাজুয়েট তো হতেই হবে সঙ্গে তার লাগবে স্পেশাল কোচিং। একবার যদি সে লাগাতে পারে তাহলে খুব অল্প বয়সেই সে সরাসরি গেজেটেড অফিসার হতে পারবে।

লোকে যে যাই বলুক না তিথির মা-বাবা কিন্তু তিথি সিদ্ধান্তকে সবসময় সম্মান জানিয়ে এসেছে। কলকাতার নাইডু কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন এবং তার পাশাপাশি এক নামী প্রতিষ্ঠানে থেকে ইউ পি এস সির কোচিংও নিয়েছে তিথি। এইভাবে তিনটে বছর ধরে ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য মেধা এবং মানসিক দুই দিক থেকেই প্রস্তুত হতে শুরু করে তিথি। ছোট থেকেই তিথির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল মারাত্মক। দিন দিন তা অত্যন্ত ধারলো হয়েছে। কলেজে পড়াকালীন কোন বন্ধুদের মধ্যে মনোমালিন্য হলে তার মেটানোর দায়িত্ব এসে পরতো তিথির কাছেই। আর এত সুন্দর সমস্যার সমাধান করতো যে সকলেই ভীষণ খুশি হতো।

গ্র্যাজুয়েশনের পর তিথি তার মা বাবাকে জানালো সে দিল্লি করোলবাগ যে ইউপিএসসি কোচিং সেন্টার আছে সেখানে সে ভর্তি হতে চায়। তিথির মা-বাবা সেই মতো খোঁজ খবর নিতে শুরু করলো। করোল বাগ অঞ্চলে তিথির জন্য একটা নিরিবিলি ও নিরাপদ আস্তানার। অবশেষে পাওয়া গেল একটি বাড়ি। তিন তলা ছাদের উপর একটি ঘর সঙ্গে ল্যাট্রিন বাথরুম। ঘরটির খোঁজ এনে দেয় তিথির এক দূর সম্পর্কের পিসেমশাই। সুতরাং আর কোন প্রশ্ন না করে হাওড়া রাজধানী কনফার্ম টিকিট কেটে রওনা দিল তিথি ও তার মা-বাবা।

তিথির বাবা একজন কেন্দ্রীয় সরকারের এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং মা একজন সর্বগুণসম্পন্না হোমমেকার। যে কোনো পরিস্থিতিকে কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় তা তিথি ওর মায়ের কাছ থেকে ছোটবেলা থেকে শিখে গিয়েছিল। তিথি এই প্রথম দিল্লি এলো। নিউ দিল্লি স্টেশনে পা রাখা মাত্রই বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করল তিথি। প্রিপেইড ট্যাক্সি নিয়ে করোল বাগ এর দিকে রওনা হলো। তিথি হিন্দি ভাষাটা একটু-আধটু ভালোই বলতে পারে। সে ট্যাক্সিচালকের সাথে হিন্দিতে এটা ওটা বার্তালাপ শুরু করে দিয়েছে। কর্ণাট প্লেসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝাঁক পায়রা দেখে তিথির মনটা আনন্দে ভরে গেল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, ‘ইতনে কবুতর!’ ট্যাক্সি ড্রাইভারটা হেসে বলে ‘ম্যাডাম গেঁহু ডালনে সে রোজ আতে হ্যায়।’

তিথিদের পৌছাতে পৌছাতে বেলা দশটা বেজে গেল। করোল বাগ মেট্রো টেশনের সংলগ্ন ঐ অঞ্চলটি। গফফর মার্কেটটা পাশে। তিথিরা বাড়ির মালিককে ফোন করে।মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একজন লম্বা ফর্সা বছর ষাটের মহিলা মেইন দরজা খুলে ওদেরকে ভিতরে আসতে বললো। ভদ্রমহিলাকে দেখামাত্রই নমস্কার করার সৌজন্যে তিথিদের একটু ঘাটতি পড়ে গেল। কারণ ভদ্রমহিলার পোশাক। মহিলাটি উর্ধাঙ্গে পড়ে আছেন ফুলহাতা শার্ট আর নিচে পেটিকোট। বাংলায় যাকে বলে সায়া। মাথায় বাঁধা আছে ওড়না। এই ধরনের পোশাক জীবনে দেখেনি তিথিরা। হরিয়ানা এবং উত্তরাখণ্ডের বয়স্করা আজও এই ধরনের পোশাক পড়তে অভ্যস্ত। তাই প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল ওরা। তবে সবার প্রথম তিথি হাতজোড় করে নমস্কার জানায় ভদ্রমহিলাকে। ভদ্র মহিলাটির মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। তাদেরকে নিয়ে ছাদের ঘরটাতেও আসে।

তিথি তো ছাদে এসে এক চক্কর হালকা নেচে নিল। ‘কি মুক্ত! কি মুক্ত বাতাস!’ যখনই মন চাইবে তখনই সে এসে দাঁড়াবে এই মুক্ত পরিবেশে। ঘরটাও বেশ বড়। একটি চারপাই ও কাঠের আলমারি দিয়ে রেখেছে মোকান মালিক।
ভদ্রমহিলা নিচে থেকে ওদের জন্য চা ও নমকিন নিয়ে এলেন এবং বলে গেলেন আজ দুপুরের লাঞ্চ যেন তারা ওদের সাথেই করে নেয়। যদিও তিনি হাসতে হাসতে বললেন ‘হাম লোগ শুদ্ধ শাকাহারী। চিকেন, মাটন, মাছলি এলাউ নেহি হ্যায়। বাহার হোটেল মে খা সক্তে হো পর ঘর মে নেহি।’

তিথির মা বলে ‘হামারি বেটি মাছলি খাতে নেহি হে। পর চিকেন মাটন তো বহত পসন্দ করতি হ্যায়। লাগতাহে ইসমে থোড়া দিক্বত হো জায়গা।’ তিথি তাড়াতাড়ি বলে ‘মুঝে কোই দিক্বত নেহি হ্যায়। আই ক্যান এডজাস্ট ইট।’ তিথির কথায় সকলে হেসে ওঠে। ঘন্টাখানেক পর তিথিরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নেমে আসে মোকান মালকিনের দোতলায়। সুন্দর রুচিশীল ঘরদোর। তিথির মোকান মালকিন জানায় যে, এক -জল কিন্তু খুব হিসেব করে খরচ করতে হবে।
দুই- রাত আটটার পর বাইরে থাকা চলবে না।
তিন- কোনো ছেলে বন্ধু নিয়ে আসা চলবে না।

তিথিও ঘাড় নেড়ে সম্মত হয়ে যায়। দুপুরে লাঞ্চে রুটি, ভাত, ডাল, পনির, আচার, দই ও স্যালাড। তিথি তো ভাত মোটেই পছন্দ করে না। সুতরাং তার তো ভালোই হলো। মোকান মালকিন বলে ‘বেটি কুছ ভি জরুরত পড়ে তো বিনা হিচকিচায়ে হামে বাতানা। ইস মোকান মে হাম তিনো। তু, ম্যা অর আঙ্কেল।’ আঙ্কেল বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে ব্যবসার জন্য। আর মোকান মালকিনের ছেলে বউ এখন থাকে জাপানে। সুতরাং বাড়ি পুরো খালি।

তিথিকে কোচিং সেন্টারে এডমিশন করিয়ে তার বাবা-মা কলকাতা ফিরে আসে। তিথি এখন সম্পূর্ণ একা। তার সঙ্গী বই আর ভাবনা। তিথির রুমের পাশেই একটা একতলা একটু ভাঙাচোরা গোছের বাড়ি আছে। খুব পুরোনো বাড়ি হবে। বাড়িটাতে বেশ গাছগাছালি ও আছে। তিথি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাড়ীটির দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ নানা ধরনের পাখি আসে বাড়িটির ছাদে। তবে সবচেয়ে বেশি আসে কাক। মুখে করে এটা ওটা এনে পাতার ভাঁজে লুকিয়ে রাখে। কি নিপুণভাবে খাবারের টুকরোগুলোকে শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে রাখে। তিথি ভাবে তাহলে পশুপাখিরাও কি সঞ্চয় করে! কি জানি! ওদেরও ভবিষ্যত চিন্তা আছে! নিশ্চয়ই আছে। না হলে কাকটার কি দরকার ওই ভাবে খাবার লুকিয়ে রাখা। কাকগুলোর কর্কশ আওয়াজে তিথি আজকাল বিরক্ত হয় না। বরং ওদের অ্যাক্টিভিটির দিকে নজর দেয় আর ক্যামেরা বন্দী করে রাখে।

মাস তিনেক ক্লাসের পর আগামীকাল তিথির টেস্ট আছে। তাই সে সকাল থেকে একাগ্রচিত্তে পড়াশোনা চেষ্টা করছে। আজ জানলার পর্দাটা সে ফেলেই রেখেছে। যাতে ওই বাড়িটাতে বারবার চোখ না যায়। কিন্তু চোখ না গেলেও কান যে চলে যাচ্ছে বারবার। কেউ যেন বলছে ‘বাঙালি রাখেগী তো মছলি, চিকেন খায়েগা। পর উস্কি হাড্ডিয়া হামারে ছাদ কিউ ফেকতি হে। বুলাও ধনিয়া কো। উস্কো ভি পাতা চল না চাহিয়ে।’

ইতিমধ্যে তিথির মালকিন তিথির রুমে উঠে এসেছে। তিনি এসে তিথিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বেটা তুই কি মাছ মাংস কিছু এনে খেয়েছিলি? যদি খেয়ে থাকিস সত্যি কথা বল। আমি লোক দিয়ে ওদের ছাদ পরিষ্কার করিয়ে দেব। এটা প্রথমবার তাই মাফ করে দিলাম। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।

তিথির তো ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ, হাত পা-ও কেমন যেন একটা কাঁপছে। তবুও ভিতর থেকে সাহস সঞ্চয় করে বলে ‘আন্টি, আমি এইরকম কোন কাজই করি নি। আর ওদের ছাদে হাড়গোড় কিংবা কাঁটা আমি কেন ফেলতে যাবো। ওরা কি আমাকে ফেলতে দেখেছে। তাহলে আমার নামে ব্লেম করছে কেন? চলুন আমি ওদের সাথে কথা বলবো।’

তিথির মালকিন জানায় পাশে যে বাড়িটা দেখছো সেটা ওর জেঠ জেঠানীর বাড়ি। মানে ভাসুরের বাড়ি। ওদের সাথে কথাবার্তা প্রায় বন্ধই। আজ বহুদিন বাদে ছাদে উঠেছে দেখেছে মাংসের হাড়, মাছের কাঁটা তাই কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে লেগে গেছে।
তিথি বলে, ‘আন্টি, তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি তো। মাংসের হাড় মাছের কাঁটা কে এনেছে ওদের ছাদে আমি জানি। তার প্রমাণও আছে আমার কাছে। চলুন ওদের ছাদে গিয়ে দেখে আসি।’
তিথির কথাবার্তার মধ্যে এত দৃঢ়তা ছিল যেন মনে হচ্ছিল কোন প্রশাসকই কথা বলছে। তিথি মনে মনে যে তৈরি প্রশাসক হওয়ার জন্যই। অবস্থা যতই গোলমেলে হোক ঘটনাস্থলে যাওয়া চাই। তিথিও তার মালকিন (ধনিয়া) এসে পৌঁছায় ঘটনাস্থলে। ধনিয়ার ওপর তো প্রায় আছড়ে পড়ে তার জেঠানী মিরচী। শাক, সবজি, ফল এইসব দিয়ে নাম রাখার প্রচলন আজও হরিয়ানার উত্তরাখণ্ড লোকজনের মধ্যে আছে। তিথি মোবাইলটা খুলে দুই তিনখানি ছবি এবং কিছু ভিডিও ওদেরকে দেখায়। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটি বায়স (কাক) তার ঠোঁটে করে সাদা হাড় জাতীয় কিছু জিনিস এনে ছাদে ফেলছে। তারপর শুকনো পাতা দিয়ে সযত্নে চাপা দিচ্ছে হাড়টিকে। এই ভিডিও দেখে ধনিয়া ও মিরচি দুজনেই তো হেসে ওঠে। দুজনেই একসাথে বলে ওঠে ‘কিতনা বজ্জাত কৌয়া। হামারে বিচ মে লড়াই লাগা দি।’
তারা দুজনই তিথির উপস্থিত বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রশংসা করতে থাকে এবং তাকে দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করতে থাকে যেন সে একজন যোগ্য প্রশাসক হয়ে উঠতে পারে।

সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment