চর্ম অন্তরাল রহস্য
-দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ
“….and by this way we solved our case of organ trafficking in Vizag..” —
Reporting
Mr. Anirudh Dutta
Miss. Shibani Mittro
“আহঃ” আহানের এই পরিতৃপ্তি মূলক শব্দ শুনেই হ্যালি বলে ওঠে “শেষ হলো তাহলে রিপোর্ট লেখাটা তাই তো?” আহান একটু হেসে সায় দিলো। ওরা দুই বন্ধু এখন এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাসে বসে। প্লেনটা প্রায় দু-ঘণ্টা পনেরো মিনিট হলো ছেড়ে দিয়েছে ভাইজাকের এয়ারপোর্ট থেকে। কাঁধের কাছে গুলি লাগার জায়গাটা এখনো ব্যান্ডেজ করা থাকলেও আহান গত দু’ দিনের তুলনায় আজ বেশ সুস্থ বোধই করছে। ল্যাপটপের পাশে রাখা গরম চায়ের কাপে হাল্কা করে একটা চুমুক দিয়ে বললো, “আরে পরশু অফিসে রিপোর্টটা জমা দিতে হবে না! তাই বানিয়ে নিলাম..”হ্যাঁ রে! পিংলা ও অন্যান্য লোকগুলোর কোনো খবর জানিস?” আহানের কাছ থেকে যেন এই প্রশ্নটাই আশা করছিল হ্যালি এতক্ষন ধরে, “চিকিৎসা চলছে ওদের! ওরা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে, আমি কাল বিকালেই খবর নিয়েছি আর এই সংক্রান্ত বিষয়ে আমি ওখানকার কর্মকর্তা একজন ডাক্তারের কাছ থেকে একটা রিপোর্টও কালেক্ট করে নিয়েছি। দাঁড়া তোকে নামার পর পাঠিয়ে দেবো, তুই বরং ওই ফাইনাল রিপোর্টটার সাথে এই রিপোর্টটাও যোগ করে দিস..” হ্যালি আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তখনই পাইলটের বার্তা শোনা গেলো “আমরা আমাদের গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে গেছি। এবার আমরা ল্যান্ড করবো। দয়া করে সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসে, সীটবেল্ট বেঁধে নিন..নমস্কার।”
২
টানা দু-ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পর ওরা যখন প্লেনের পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো তখন ভোরের আলোও ফোটে নি। দুজনের ফোনেই নোটিফিকেশন মেসেজেগুলো অনবরত ঢুকছে। তার মধ্যে একটা মেসেজ দেখেই দুজনের মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল…” immediately report in the black suv, Numbered 5347″
দুজনেই একে অন্যের দিকে তাকালো। এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়িটা অনেকক্ষণ আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।গাড়িতে ওঠা মাত্র সেটা চলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ বাদেই আরও একটি ম্যাসেজ এলো ওদের দুজনের ফোনে..”your tickets are booked, train will leave the Chitpur station at 7.10 am”.. হ্যালি সাথে সাথে ঘড়িটা দেখলো, চারটে বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট. “ব্রিফটাও একবার দেখে নিস্ বুঝলি! আমরা এবার নিজ ঘরে ফিরছি” বলেই আহান একবার চোখ মারলো। ট্রেন নির্দিষ্ট সময়েই ছাড়লো প্লাটফর্ম থেকে। সকালে প্লাটফর্মে পৌঁছে হাতে দু’ঘন্টার মতো সময় পেয়েছিলো, তখনই বিশ্রাম কক্ষের বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে স্টেশন থেকে অল্প কিছু খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল ওরা।
ট্রেনটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে।
প্রথমে ফ্লাইট তার ওপর গাড়িতে আধ ঘন্টার কাছাকাছি জার্নি দুজনকেই বেশ কাবু করে ফেলেছে তাই আহান আর হ্যালি এখন নিজের নিজের সীটে গা এলিয়ে নিজের নিজের ফোনে ডুবে। অপারেশন স্পটটার ব্যাপারে একটু জেনে নিচ্ছে আর কি..
“পেট্রাপোল হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত ইন্দো-বাংলাদেশ পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত চেকপয়েন্টের একটি। কলকাতা থেকে পঁচানব্বই কিলোমিটার দূরে জাতীয় সড়ক ৩৫-এর উপর অবস্থিত।”
৩
ট্রেনটা যখন পেট্রাপোল স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে সাড়ে নয়টা ছুঁইছুঁই। আহানের পরনে এখন একটা পাজামা পাঞ্জাবি আর হ্যালির পরনে শাড়ি, কপালে সিঁদুর, হাতে নোয়া আর শাঁখা পলা। জায়গাটা সদর থেকে একটু ভেতরের একটি গ্রাম, বনগাঁ। এক্কেবারে বর্ডার লাগোয়া অঞ্চল। ওখানকার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে এই সব পোশাকের ব্যবস্থা। স্টেশনের বাইরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। দুজনে নিজেদের মালপত্র নিয়ে তাতে গিয়ে বসলো।
কুড়ি মিনিটের পথ, ট্যাক্সিটা ছুটে চলেছে যশোর রোডের ওপর দিয়ে। যখন নির্দিষ্ট গন্তব্যে ওরা দুজন পৌঁছালো তখন ঘড়িতে এগারোটা ছুঁইছুঁই। আশেপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু চাষের জমি আর মাটির বাড়ি। পাকা রাস্তা অনেক আগেই ছেড়ে এসেছে। এখন শুধু মাটির এবড়ো খেবড়ো পথ। এই সবের মধ্যে ওদের থাকার ব্যবস্থা একটা দোতলার পাকা বাড়িতে হয়েছে। ওপরওলা থেকে সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। এইটাই নাকি এই অঞ্চলের একমাত্র পাকা বাড়ি। বাড়ির মালিকের কাছে পরিচয় ওরা দুজন স্বামী-স্ত্রী, এখানে একটা জমি কিনতে এসেছে। জমি পছন্দ, আইনি কাজকারবার, আর জমি হস্তান্তর নিয়ে ওই মোটামুটি এক সপ্তাহ মতো থাকবে।
ওদের পৌঁছনোর সাথে সাথেই বাড়ির মালিক শ্রীযুক্ত বনমালী বাবু বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। অমায়িক মানুষ, টাক মাথা, মোটা ঠিক না বলা গেলেও স্বাস্থ্যবান বলা যেতেই পারে। পরনে শুধু একটা ধুতি খালি গা.. ওনার পিছন পিছন ওনার স্ত্রীও বেরিয়ে এসেছেন। ভদ্র মহিলার গায়ের রং একটু চাপা, শারীরিক গড়ন বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ, শরীরে মেদের চিহ্ন মাত্র নেই। মাথায় ঘোমটার নীচে লাল রেখাটা বেশ জ্বলজ্বল করছে, এক মুখ হাসি… বনমালী বাবুই ওনার স্ত্রীর সাথে আহান আর হ্যালির পরিচয় করিয়ে দিলেন। নাম শ্রীমতি ভানুলতা দেবী। ভানুলতা দেবীই আহান আর হ্যালিকে ওদের দোতলায় থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলেন দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
৪
“দুপুরের খাওয়াটা বেশ হলো বল!” আহানের গলায় একটা পরিতৃপ্তির আভাস। হ্যালি এখন ঘরের ভিতরে পায়চারী করছে। “আচ্ছা আহান তুই খেয়াল করেছিস! আসার সময় মাটির এবড়ো খেবড়ো রাস্তাতে কতো গবাদি পশুর খুরের ছাপ ছিল!”
“ওগো বঙ্গ ললনা…ভুলিও না! দেওয়ালেরও কান থাকে। নিজ স্বামীকে তাচ্ছিল্য পূর্বক সম্বোধোন করিলে সমাজ তোমারে মেনে নেবে না নারী!” কথাগুলো বলতে বলতে আহান খাটের উপর গিয়ে বসলো। ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায় হ্যালির পিছনে লেগে ও কি হারে আনন্দ পেয়েছে। ওদিকে হ্যালি রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আহানই ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “আরে তুই ঠিকই বলেছিস, কিন্তু এটা একটা গ্রাম না? দু’দিন থাকি সব কিছু দেখি শুনি তারপর আসল গল্প বোঝা যাবে..” আহানকে কথাগুলো শেষ করতে হলো না। বাইরে নিচের রাস্তা দিয়ে একদল গবাদি পশুর যাওয়ার আওয়াজ পেলো ওরা দুজন।দোতলায় ওদের ঘরটা ছাড়াও আরো দু’টো ঘর আছে, যদিও এখন সেগুলো খালি। এই তিনটে ঘরের সামনে দিয়ে একটা লম্বা বারান্দা। বাড়ির মালিক তাঁর পরিবারকে নিয়ে নিচের তোলায় থাকেন। অবশ্য পরিবার বলতে উনি আর ওনার বউ। নিঃসন্তান দম্পতি।
আহান আর হ্যালি বারান্দায় চলে এসেছে। নিচে দিয়ে একটা বিশাল গবাদি পশুর দল নিয়ে পাঁচটা বাচ্ছা ছেলে যাচ্ছে। আহান ফিসফিস করে বললো, “দেখ বিকেল হয়ে গেছে, তাই ওই রাখাল বালকগুলো এই দলটাকে নিয়ে যে যার মালিকের বাড়ি ফিরছে।” ওরা এভাবে বারান্দায় যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল নিজেরাই খেয়াল করে নি, এর মধ্যে ওরা এরকম আরো দু’টো দলকে ফিরতে দেখেছে। তার মধ্যে একটা দলের কিছুটা অংশকে নিয়ে দু’টো বাচ্ছা ছেলে বনমালী বাবুর বাড়িতেও ঢুকলো। সেটাও ওদের চোখ এড়ালো না।
– “কি দেখছেন আপনারা!” পিছন থেকে বনমালী বাবুর গলার আওয়াজ।
“না মানে, আমরা তো এরকম সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখিনি তাই দেখছিলাম আর কি..” আহানই হেসে উত্তর দিলো।
“তা তো বটেই! তা তো বটেই! আপনারা সব শহরের মানুষ.. এসব আর পাবেন কোথায়? চলুন চলুন খেয়ে নেবেন চলুন। গ্রামেগঞ্জে সবাই রাতের খাবারটা একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নেয় আর কি। ওদিকে আবার সকাল সকাল ওঠা। চলে আসুন…” কথাগুলো বলেই বনমালী বাবু সিঁড়ি দিয়ে নীচে যাওয়ায় জন্য অগ্রসর হলেন।
৫
রাতে খেয়ে আহান আর হ্যালি এখন নিজেদের ঘরে। ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা। দুজনেই মাটিতে দু’টো আলাদা আলাদা বিছানা করে শুয়ে আছে। দুজনের মাথাতেই একটাই চিন্তা..কোথা থেকে কাল শুরু করবে? আহান উঠে একবার বাথরুমে গেল.. হ্যালি মোবাইলে দেখলো সময় রাত এগারোটা।
বাথরুমটা ঘরের সাথেই লাগোয়া। আহান লক্ষ্য করলো বাথরুমে দু’টো দরজা। একটা যেটা শোয়ার ঘরের সাথে যোগ আছে.. তাহলে অন্যটা কিসের? খুব সন্তর্পণে খুললো দরজাটা আহান। এটা পেঁচালো সিঁড়ি নেমে গেছে। ঠিক পাশেই একটা বড়ো কাঁঠাল গাছ। আর নীচে বনমালী বাবুর বাড়ির গোয়াল ঘরটা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না! আচ্ছা তার মানে এটা জমাদারের ব্যবহারের জন্য সিঁড়ি!
দরজাটা বন্ধ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে যখন ঘরে এলো তখন হ্যালি ঘুমে কাতর। আহানও গিয়ে চুপচাপ নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো।
৬
হঠাৎ ঘুমের চটকাটা ভেঙে গেল নীচে গরু-বাছুরের ডাকে। উঠে বোঝার চেষ্টা করলো হ্যালি কি হচ্ছে ব্যাপারটা! ফোনের ডিজিটাল ঘড়িতে তখন প্রায় দু’টো। এতো রাতে কি ব্যাপার? কোনো চোর টোর নয়তো! নতুন জায়গা.. রিভলভারটা শাড়ির কোল আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে খুব সন্তর্পণে ঘরের দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। গোয়াল ঘরটা ঠিক কোনদিকে ওর জানা নেই। অচেনা অজানা জায়গায় এইভাবে হুটহাট করে নীচে যাওয়াটাও ঠিক না। আকাশ মেঘলা থাকায় চাঁদের আলো নেই বললেই চলে। হ্যালি এদিক ওদিক একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করলো। নাহ্ কিছুই নেই কোথাও। গরু-বাছুরের ডাকও ততক্ষণে থেমে গেছে। চারপাশে আরো একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে হ্যালি যখন ঘরে ফিরে এলো আহান তখন ভ্রূ কুঁচকে বসে কি যেন ভাবছে। “কি রে কি ভাবছিস” হ্যালির প্রশ্নে আহানের চমক ভাঙলো।
-“না এতো রাতে হঠাৎ ওরকম শব্দ কেন হলো সেটাই অবাক করছে আর কি, তুই বাইরে কিছু দেখতে পেলি?”
– “না রে.. যা শুয়ে পর !” বাকি রাতটা দুজনের নিরুপদ্রবে কাটলো।
৭
ভোরের সূর্যের সোনালী আলো যেন পুরো গ্রামটাকে সোনায় মুড়ে দিয়েছে। আহান বিভোর হয়ে গিয়েছিল সকালের এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে সে সচকিত হলো। বনমালী বাবু চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে উঠে এসেছেন,
– “আমাদের এখানে সকালটা একটু তাড়াতাড়ি হয় অনিরুদ্ধ বাবু” একগাল হেসে আহনকে কথাগুলো বললেন তিনি।
-“সে তো অবশ্যই” আহানও একটু হেসে জবাব দেয়।
– “কাল রাতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো আপনাদের? তা আপনার স্ত্রীকে দেখছি না? উনি কি এখনো ওঠেন নি?” বনমালী বাবুর প্রশ্নে আহান এক মুহূর্ত ভাবে।পরক্ষণেই জবাব দেয়
-“না আসলে নতুন জায়গা তো, তাই হয়তো একটু দেরি আর কি…” বনমালী বাবু হাসলেন।
-“আচ্ছা জমির ব্যাপারটায় যদি একটু সাহায্য পাওয়া যেত মানে কোনো দালাল বা ওই জাতীয় কেউ যদি আপনার জানা থাকে” আহান থামলো।
-“হ্যাঁ অবশ্যই, আমার পরিচিত একজন আছে নাম হরিহর। জমি নিয়ে ওর সাথে যোগাযোগ করাই সবচেয়ে ভালো। আমি ঠিকানা দিয়ে দেবো আর আমার নাম বললে তো কোনো অসুবিধাই হবে না। নিন.. আপনারা চা খেয়ে একটু ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে নিন আমি নিচে যাচ্ছি” বলে বনমালী বাবু নীচে নেমে গেলেন।
ওদিকে আহান চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে যখন ঘরে প্রবেশ করলো তখন হ্যালি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।
– “কালকের রাতের ঘটনাটা নিয়ে বনমালী বাবুকে কিছু জিজ্ঞাসা করলি নাকি?”
-“একটু সবুর করো পত্নী প্রথম রাতেই এতো কৌতূহল..মালিককে জানানো ঠিক না” একটু রাশভারী গলায় কথাগুলো বলেই আহান হেসে ফেললো।
ওরা যখন নিচে নেমে এলো ভানুলতা দেবী তখন বনমালী বাবুর সাথে কিছু কথা বলছিলেন। ওদের দেখেই হেসে বললেন, “কি শিবানী রাতে কোনো সমস্যা হয় নি তো?” হ্যালি হেসে উত্তর দেয়,
-“না না এতো সুন্দর পরিবেশ, প্রথম দিনই উঠতে কিরকম দেরি হয়ে গেলো দেখুন” আহান ততক্ষণে হরিহরের ঠিকানা নিয়ে নিয়েছে বনমালী বাবুর কাছ থেকে।
৮
হরিহরের বাড়ি যখন ওরা পৌঁছালো এক যুবতী মেয়ে তখন উনুনে রান্না চাপিয়েছে ,দেখে হরিহরের বৌ বলেই মনে হলো..ওদের দেখেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো “কাকে চান বাবু ?” হরিহর বাবু ঘরে আছেন?” হ্যালি জিজ্ঞেস করে.. এমন সময় মেয়েটি রাস্তায় দেখিয়ে দিলো “ওই যে আসছেন”.. হরিহর আসতেই আহান তাকে সব খুলে বললো..শুনেই হরিহরের চোখে যেন একটা ঝিলিক খেলে গেলো..সে চটপট একটু হেসে বললো” একদম ঠিক লোকের কাছেই এসেছেন বাবু, আমি এই লাইনে অনেকদিন ধরে আছি. এমন খাসা জমি দেখাবো না যে একেবারে পছন্দ হতে বাধ্য.. এখনই যাবেন কি বাবুরা জমিটা দেখতে ??” “তা হলে তো মন্দ হতো না কি বলো গিন্নি??” আহানের প্রশ্নে হ্যালিও সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ালো একবার..হাঁটতে হাঁটতে হ্যালিই জিজ্ঞাসা করলো “আচ্ছা হরিহর বাবু !! এখানে সবাই কি শুধু গবাদিপশু পালন আর চাষবাসই করেন?” ” হ্যাঁ সবাই প্রায় একই কাজই করেন… গ্রাম তো বুঝতেই পারছেন তবে একটা ইস্কুল, একটা ছোট ডাকঘর আর একটা ছোট হাসপাতাল আছে, যদিও বেশিরভাগ শহুরে বাবুরাই ওখানে কাজ করেন, আর জানেন বোধহয় অল্প দূরেই ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার তাই পুলিশের পাশাপাশি আপনারা ভালো সংখ্যার মিলিটারিও দেখতে পাবেন মাঝে মাঝেই.. কথা বলতে বলতেই ওরা যে জায়গায় পৌঁছালো সেই জায়গাটা একটা ফাঁকা মাঠ..আশেপাশের জমি রয়েছে আরো.. সেগুলোতে চাষ করা রয়েছে.. কিছুটা দূরে একটা নদীর মতো বয়ে গেছে… কি শান্ত পরিবেশ.. আর তার পাড় বরাবর অনেকগুলো বড়ো বড়ো গাছের সারি… একটু দূরে একটা ছোট মাটির ঘরের মতো.. আহান সেই দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে ” আরে ওটাতো পাম্প হাউস.. এই যে এত জমি দেখছেন এই সব জমিতে ওই খান থেকে জল সাপ্লাই হয়.. ওই যে জলধারাটা দেখছেন..ওটা আসলে এখানকার সাধারণ মানুষজনই ইছামতি নদী থেকে একটা খালের মতো কেটে নিয়ে এসে বানিয়েছে চাষের সুবিধার জন্য.. ওই জলেই এখানকার সব চাষবাস হয়…জানেন !! এই ইছামতি নদীটার একটা বিশেষত্ব আছে এই নদীটার একদিকে আমরা থাকি ওর অন্যদিকে বাংলাদেশ…. এখানে মিলিটারির টহল খুব একটা থাকে না.. এমনিতেই ভারত আর বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ভালো তার ওপর আবার নদী.. বুঝতেই পারছেন!! হেঁ! হেঁ!” কথাগুলো নিঃশ্বাসে বলে হরিহর বাবু এখন বেশ হাঁপাচ্ছেন.. ওদিকে জমিটা আহান আর হ্যালি দুজনেরই বেশ পছন্দ হয়েছে.. এখন ওরা যাচ্ছে জমির মালিকের সাথে কথা বলতে.. জমির একদম কাছেই বাড়ি ভদ্রলোকের. নাম “বিশু”. নিতান্তই গরিব মুসলমান একজন চাষী…. লুঙ্গি পরে দাওয়ার বসে পান চিবচ্ছিলো…বেশ পেটানো শরীর.. ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন.. ওদিকে হরিহর বাবু বলেই চলেছেন.. “একে খরা জমি চাষবাস তেমন ভালো হয় না তার ওপর গত ক-মাস আগে ওর প্রায় পাঁচ খানা গরু-মোষ চুরি হওয়ার পর পেট চালানো দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে তাই এই শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রির চেষ্টা করছেন…” বিশু খাঁর সাথে যখন কথা বলে ওরা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলো তখন বিকাল হই হই.. দুজনেরই পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে…যানবাহনের ব্যবস্থা এখানে তেমন ভালো না.. আসার সময় একটা ভ্যান পেয়েছিল.. কিন্তু এখন দুজোড়া পা’ই সম্বল… অগত্যা ওরা বনমালী বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো.. মাঝে একটা স্কুল বাড়ি আর একটা হাসপাতালও চোখে পড়লো ওদের.. হাসপাতালের সামনে একটা ঝুপড়িতে তখন গরম গরম কচুরি, সিঙ্গারা, চপ ভাজছে… আহান আর হ্যালি জোর কদমে এগিয়ে চললো সেই দিকে….
৯
খান ছয়-সাত কচুরি অবলীলায় পেটে চালান করে দুজনের মুখেই এখন একটু হাসি ফুটেছে। আশেপাশে আরো কিছু লোকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে.. কানাঘুষো যা শোনা যাচ্ছে তাতে বেশ ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছে এরা কাল রাতের গরু চুরি নিয়ে কিছু আলোচনা করছে। আহান আর হ্যালি দুজনেই আর লোভ সামলাতে পারলো না। গিয়ে একটু আলাপ করার চেষ্টা করলো। যদি কিছু জানা যায়! যা শুনলো তাতে দুজনেরই দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। গত কয়েক মাস ধরেই নাকি কারোর না কারোর বাড়ি থেকে কখনো গরু কখনো মোষ কখনো ছাগল চুরি যায়। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো.. চুরি যাওয়ার এক-দুমাসের মধ্যে নাকি আবার গবাদি পশুগুলো ফিরেও আসে নিজের নিজের মালিকের ঘরে। দু-এক সপ্তাহ পর আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আবারো তারা ফিরেও আসে ঠিক সময়ে.. লোকাল পুলিশকে জানিয়েও কোনো কাজ হয় নি। মাঝে একবার মিলিটারিরা খানাতল্লাসি চালিয়েছিল কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া যায় নি। গভর্মেন্টের নাকি কোনো উদ্যোগক নেই। তাই সব যেমন চলার তেমনি চলছে।
আহান ফিসফিস করে হ্যালিকে বললো, “এ আবার কেমন চোর রে? চুরিও করে আবার দুমাসের মধ্যে চোরাই মাল ফিরিয়েও দিয়ে যায়…উঁহু! ডালমে কুছ কালা হ্যায়!” হ্যালিও ওর সুরে সুর মিলিয়ে বললো “ঠিক বলেছিস আহান.. কেন জানি না মনে হচ্ছে এটা সোজা কেস না! দেখতে হচ্ছে তো ব্যাপারটা..”
১০
ওরা যখন ঘরে ফিরলো তখন গ্রামের প্রতিটা বাড়িতেই সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি পড়ছে। বনমালী বাবুর বাড়ির কাজের লোক আহান আর হ্যালিকে বিকালের চা বিস্কুট দিয়ে গেল। সেগুলোকে সানন্দে গ্রহণ করে ওরা দুজন নিচের উঠানেই বসলো। বনমালী বাবু ঘরের ভিতরে কিছু একটা করছিলেন। আহান আর হ্যালিকে দেখে বেরিয়ে এলেন,”কি? পছন্দ হলো জমি?”
একবারেই বাজিমাত..হরিহর সত্যি বোঝে খদ্দের কি চায়!” আহান বললো কথাগুলো।
-“একদম! এত পছন্দ হয়ে গেলো যে সব ঠিকঠাক করেই এলাম একেবারে” হ্যালিও যোগ দেয়। এমন সময় ভানুদেবী গোয়াল থেকে ঘরে এলেন।ওদের দেখে সামান্য হেসে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
-“আচ্ছা আসার সময় স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে গরু চুরি যাওয়ার কথা শুনছিলাম, আপনাদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো?” চা খেতে খেতে হ্যালি জিজ্ঞাসা করলো।
কথাগুলো শুনতে শুনতে বনমালী বাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। আহানের হাতের স্পর্শে একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, “না না বনমালী বিশ্বাসের বাড়ি থেকে গরু সরাবে এত সাহস কার?”বলেই একটু হাসার চেষ্টা করলেন পরক্ষণে বলে উঠলেন “যাই একবার দেখেই আসি গোয়ালটা” বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন গোয়াল ঘরের দিকে..” আহান আর হ্যালিও একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করে ওপরে চলে আসে।
“একটু রেস্ট নিয়ে নে আজ রাতে এলার্ট থাকতেই হবে” আহান কথাগুলো বলে বাথরুমটা একবার ঢুঁ মেরে এলো।
১১
রাত দু’টো
বনমালী বাবুর বাড়ির পিছনের রাস্তা দিয়ে প্রত্যাশা মতোই কিছু গরুর পাল চলে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আহান আর হ্যালি দুজনেই তৈরি ছিল। আহান বাথরুম লাগোয়া দরজাটা নিঃশব্দে খুলে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। হ্যালি ওকে ছায়ামূর্তির মতো অনুসরণ করছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে..আহান মোবাইলে ফ্লাশ লইটটা জ্বালালো..”উমম কি দুর্গন্ধ!” হ্যালি ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে। আহান আর হ্যালি দুজনের পরনেই এখন কালো টি-শার্ট, কালো জিন্স সাথে কালো গামবুট.. হ্যালির হাতে ওর Smith & Wesson Model 500 রিভলভার অন্যদিকে আহানের Ruger Vaquero রিভলভারটা ওর পিঠের কাছে জিন্সের বেল্টের ভিতরে গোঁজা।
ওরা বনমালী বাবুর গোয়াল ঘরটা দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে গোয়াল ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে। সন্তর্পণে দুজনেই আশপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আজ বিকালে বৃষ্টি হওয়ার দরুন মাটি এখনো একটু ভিজে আছে আর তাতেই গরুর খুরের ছাপ স্পষ্ট। এতো রাতে এইখানে গরুর খুরের ছাপ কেন? কোথায়ই বা যাচ্ছে এই গবাদি পশুর দলটা? কারাই বা নিয়ে যাচ্ছে? কেনই বা নিয়ে যাচ্ছে? আহান আর হ্যালি দুজনেরই চোখের দৃষ্টি তীক্ষ হয়ে উঠেছে। একটা যেন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে ওরা.. বেশি দেরি না করে ওরা গরুর খুরের ছাপগুলোকে অনুসরণ করতে লাগলো।
দেখতে দেখতে আহান আর হ্যালি ইছামতি নদীর কাছে পৌঁছে যায়। একটু দূরে গবাদি পশুর দলটা রয়েছে একজন লোক একদম সামনে থেকে পুরো পালটাকে নিয়ে যাচ্ছে পিছনে দু’টো লোক পাহারা দেওয়ার কাজ করছে। পালটা নদীর কাছে যেতেই আরো কিছু লোক কথা থেকে এসে জড়ো হলো। একটু পরেই গরুগুলোকে ধীরে ধীরে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হলো। হ্যালি আর আহান পাম্প হাউসের আড়ালে লুকিয়ে পুরোটাই লক্ষ্য করছে। অন্ধকারে লোকগুলোর মুখ ঠিক করে বোঝা গেল না। আকাশটা এখনো মেঘলা করে আছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তেও শুরু করে দিয়েছে। অগত্যা বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় রইলো না।
১২
-“গরু পাচার তো এখানে হামেশাই হয় কিন্তু হারানো গরু আবার ফেরত আসে কি করে? আর কেনই বা আসে” আহান ফতুয়াটা গা’য়ে দিতে দিতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো হ্যালির দিকে।
ওদিকে হ্যালি এখন ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। মুখটা বেশ গম্ভীর, বোঝাই যাচ্ছে ও কিছু ভাবার চেষ্টা করছে।
বাইরের মুষলধারে বৃষ্টিটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। রাতটা এভাবেই কেটে গেল। সকালেও বৃষ্টি কমার কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। এভাবে একটা পুরো দিন নষ্ট হবে সেটা ভেবেই আহান আর হ্যালির মুডটা একটু খিঁচড়ে আছে। দুপুরের সূর্য মাথার ওপর ওঠার সাথে সাথে বৃষ্টিটা একটু কমলো। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে দুইমুর্তিতে বেরিয়ে পড়লো আশেপাশে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। এদিক ওদিক করতে করতে ওরা যখন হরিহর বাবুর বাড়ির সামনে এলো তখন হরিহর বাড়িতে নেই। তার বৌ যা বললো, তার অর্থ সকাল থেকে গ্রামের অনেকের গরুই পাওয়া যাচ্ছে না। এই কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টিটা ধরায় হরিহর বাবু একটু বেড়িয়েছেন। কিন্তু কোথায় গেছেন সেটা বলে যান নি।
-“কোথায় যেতে পারে বলতো লোকটা?
লোকটাকে কি ঠিক বিশ্বাস করা যায়? যাদের গরু চুরি গেছে তাদের সমবেদনা জানাতে গেছে না অন্য কোনো ধান্দা আছে বলতো? নেটওয়ার্কও যথেষ্ট ভালো লোকটার। এ পান্ডা নয় তো?” আহান কথাগুলো ফিসফিস করে বলে হ্যালির দিকে তাকালো।
সন্দেহটা বেড়েই চলেছে। ফেরার পথে আবার বিশু খাঁর বাড়ি থেকে ঘুরে যাবে ঠিক হলো। লোকটার বাড়ি নদীর কাছেই প্রায় বলতে গেলে গরু চুরির কেসটা আরো একটু বিশদে জানলেও জানতে পারেন। বলেই ওরা দুজন বিশু খাঁর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো,
-“আজ রাতে আমাদের আগে থেকে স্পটে থাকতে হবে বুঝলি?” হ্যালিই বললো কথাগুলো। ওরা দুজনে যখন বিশু খাঁর বাড়িতে পৌঁছালো তখন সব পাখিরা যে যার বাসায় ফেরার তাড়ায়। বিশু খাঁ বাড়িতেই ছিলেন। আশানুরূপ কিছু পাওয়া গেলো না। যতদূর মনে হচ্ছে ভয় দেখিয়ে কেউ ওর মুখ বন্ধ করে রেখেছে।
১৩
রাতে প্ল্যান মতো আহান একটু আগে বেরিয়ে চুপি চুপি নদীর পাড়ে একটা বড় আমগাছে উঠে বসলো। এখান থেকে চারদিকটাই বেশ ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে হ্যালি ওদের ঘরের পিছনের সিঁড়িতে কাঁঠাল গাছের আড়ালে দম বন্ধ করে লুকিয়ে রইলো। দুজনের কেউই জানে না এভাবে কতক্ষন থাকতে হবে। আদৌ আজ কিছু হবে কি না? মশার বেশ ভালো মতোই উপদ্রব রয়েছে। কামড়ে কামড়ে হাত পা পুরো ফুলিয়ে দিচ্ছে দুজনেরই। হ্যালি ওর হাতের ডিজিটাল ঘড়িটা একবার দেখে নিলো..সবে এগারোটা!
হঠাৎ খসখস করে কি যেন একটা শব্দ হলো বনমালী বাবুর গোয়ালঘরটা থেকে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় পুরো সজাগ হয়ে উঠলো হ্যালির। হাতে রিলভারটা তাক করে নিলো গোয়ালঘরটার দিকে। কে যেন এই দিকটাতেই এগিয়ে আসছে। হাঁটা চলার ধরণটা খুব চেনা চেনা লাগছে। বনমালী বাবু! তার মানে এই আসল কালপ্রিট? সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে নেমে এলো হ্যালি। বনমালী বাবু ঠিক ওর সামনে পিছন ফিরে সামনের দিকে হেঁটে চলেছেন, “হ্যান্ডস আপ! সব ফাঁস হয়ে গেছে বনমালী বিশ্বাস… You are under….” কথাটা শেষ করতে পারলো না, মাথায় সজোরে কেউ কিছু দিয়ে আঘাত করলো। বেশ কিছুটা রক্ত চুঁয়েচুঁয়ে কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলো হ্যালি…. চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কে এই ব্যক্তি?…রিলভারটা দিয়ে একটা গুলি করার চেষ্টা করলো.. পারলো কি পারলো না সেটা বোঝা গেল না। হাতের মুষ্টি আলগা হয়ে যাওয়ায় রিলভারটা কোথায় যেন পড়ে গেল। একবার কানের দুলটায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করলো। আর জ্ঞান নেই…..
১৪
গতকাল রাত থেকে বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। আহান ওর পিঠের ব্যাগটা থেকে ব্লিচিং পাউডার বার করে চারপাশে ছড়িয়ে দিলো। হঠাৎ কানের দুলটা থেকে একটা শক খেলে গেল আহানের…. হ্যালি! হ্যালি! শুনতে পাচ্ছিস? না কোনো উত্তর নেই… ঠিক আছে তো মেয়েটা? এখন থেকে যাওয়া এখন সম্ভবও না। আহানের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু একটা হতে চলেছে। যা ভেবেছে ঠিক তাই- কোথাও থেকে বেশ কিছু মানুষের গলার আওয়াজ। পাম্প হাউসের দিক থেকে যেন পাঁচ-ছয়টা ছায়ামূর্তি ওর গাছটার দিকেই এগিয়ে আসছে। নাহ্ এখনই কিছু করা ঠিক হবে না। ব্যাগ থেকে dslr ক্যামেরাটা বার করে তাতে চোখ লাগিয়ে বসলো আহান। প্রমাণ হিসাবে সব কিছু রেকর্ড করে রাখা দরকার। তার পর যা যা ঘটলো তা চাক্ষুষ করলে যে কোনো সাধারণ মানুষেরই হাড় হিম হয়ে যাবে।
নদীতে সাঁতার কেটে উঠে আসছে চুরি হয়ে যাওয়া গরুগুলো শুধু গরু না সাথে মোষও আছে কিছু। সব মিলিয়ে প্রায় দশ- বারোটাতো হবেই সংখ্যায়। পাড়ে উঠে এসে সব দাঁড়িয়ে পড়লো। দেখে মনে হচ্ছে সব ট্রেনিং দেওয়া। লোকগুলো ওই গবাদি পশুগুলোর থেকে কিসব যেন নিচ্ছে আর ঝোলায় পুরছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আহান আর অপেক্ষা করতে পারলো না। যদি অপেক্ষা করতে গেলে বেশি দেরি হয়ে যায়! কানের দুলটায় হাত দিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বললো- তারপর ঝপাং করে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো গাছ থেকে।
১৫
হ্যালি বুঝতে পারছে ওকে কেউ বেঁধে কোথাও একটা ফেলে রেখে গেছে। চারপাশের দুর্গন্ধটা বেশ চেনা। তার মানে ও এখনো বনমালী বাবুর গোয়াল ঘরেই আছে। রিলভারটা খুঁজে পাওয়া দরকার। এই সব বাঁধন খোলার কৌশল ওর আর আহানের জানা। ওদের স্পেশাল ট্রেনিংয়ের সময়েই এইসব শেখানো হয়েছিল। চটজলদি নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে হ্যালি অন্ধকারে এলোপাথাড়ি ভাবে রিলভারটা খুঁজতে লাগলো। হ্যাঁ এই তো পেয়েছে… খড়ের গাদায় পড়েছিল। মাথাটা এখনো ঝিম ঝিম করছে..চোখে ঝাপসা দেখছে..কানের দুলটা দুবার নিচের দিকে হালকা টেনে কিসব যেন বলার চেষ্টা করলো হ্যালি। নাহ্ আহানের সিগন্যাল নিচ্ছে না। আরো একবার দুলটা টেনে হ্যালি কাউকে যেন বললো,
– “হ্যালো হ্যালো… হ্যালি বলছি.. We need backup.. we need backup..” কথাগুলো শেষ করেই হ্যালি বনমালী বাবুর ঘরের উদ্দেশ্যে ছুটলো। নাহ্, সব আঁটে কাটে বন্ধ। মেইন দরজার বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। তার মানে সব এখন নদীর পারে।আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না আহান ওদিকে একা আছে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো হ্যালি।
নদীর পাড়ে যখন পৌঁছালো ততক্ষণে আহান চারটেকে কাবু করে ফেলেছে। একটার সাথে তখনও ধস্তাধস্তি চলছে। লোকটার গায়ে বেশ জোর। ওদিকে আহানের আধুনিক কৌশল, পুরো সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। গরু মোষগুলো তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে চাষের জমিগুলো থেকে পেট পুজো করতে ব্যস্ত। একটু দুরে ধানক্ষেতের পাতাগুলো একবার নড়ে উঠলো না? হ্যালির তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা..
হ্যাঁ ঠিক তাই, একটা বন্দুকের নল আহানের দিকে তাক করা..সাথে সাথে হ্যালির দো-নলা রিভলভারটা গর্জে উঠলো।
১৬
পরেরদিন সকালে লোকাল থানায় বেশ জমজমাটি ভাব। লোকাল পুলিশ মিলিটারিতে চারপাশটা পুরো গিজগিজ করছে। আহান আর হ্যালি থানায় বড়োবাবুর কেবিনে বসে। ওদের ঘিরে আরো কিছু পুলিশ আর মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে।
আহানের ক্যামেরাটা প্রজেক্টরে চলছে। ওটাই একটা সব থেকে বড়ো প্রমাণ এই স্মাগলিং কেসটার। আরো কিছু পুলিশ এসে বলে গেল যে সমস্ত বেআইনি হেরোইন, কোকেন উদ্ধার করা গেছে, সব নাকি ওই গবাদি পশুগুলোর চামড়ার ওপর একটা কৃত্রিম প্লাস্টিকের চামড়া লাগিয়ে তার ভিতরে করে বাংলাদেশে পাচার করা হতো। কখনো বা একই উপায়ে বাংলাদেশ থেকে জিনিসগুলো আমদানিও করা হতো। জেলের ভিতরে তখন আসামীরা। প্ৰধান অভিযুক্ত বিশু খাঁ আহানের মারে আধমরা হয়ে আছে আর বনমালী বাবুর স্ত্রী ভানুলতা দেবী হ্যালির গুলি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বনমালী বাবুকে অবশ্য গ্রেফতার করা হয় নি। উনি আসলে এসব কিছুই জানতেন না। ওনাকে ভানুলতা দেবী রোজ রাতে খাওয়ার সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিতেন। হ্যালি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। আহান ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “আরে সেদিন রাতে তুই বনমালী বাবুকে দেখেছিলিস কারণ ওনার ঘুমের মধ্যে হাঁটা চলা করার স্বভাব আছে। ঘুমের মধ্যে এ রকম হাঁটাহাঁটি করাকে বলা হয় ‘স্লিপওয়াকিং’। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘সোমনামবুলিসম’ বা ‘নকচামবুলিসম’। আরে তুই যখন ওনাকে গোয়াল ঘরে যাওয়ার সময় আসলে কালপ্রিট ভেবে ধরতে যাস তখন পিছন থেকে ভানুলতা দেবী তোকে আক্রমণ করেন।বুঝলেন ম্যাডাম?”
আহানের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই বাইরে থেকে একজন হাবিলদার এসে বলে গেল ওদের জন্য কলকাতা থেকে গাড়ি এসেছে। ছোট্ট কুশলীবার্তা সবার সাথে বিনিময় করে যখন আহান আর হ্যালি গাড়িতে এসে বসলো তখন দুজোড়া চোখ যেন আনন্দে আরো একবার চিকচিক করে উঠলো।
অসাধারণ লাগলো গল্পটি