গল্প-শেষ থেকে শুরু

শেষ থেকে শুরু
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

অফিস থেকে ফেরার পথে রুটি তড়কা কিনে ফ্ল্যাটে ঢুকলো রাতুল। আজ খুব খিদে পেয়েছে ওর। ভাগ্যিস হোটেলগুলো খুলছে এই আনলক পিরিয়ডে, নয়তো বাড়ি ফিরে আবার খাবার গরম করে খেতে হতো। যদিও রোজই তাই করে কিন্তু আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। ফিরেই স্নানঘরে ঢুকে শাওয়ারের তলায় ঠান্ডাজলে স্নান করে নিলে খানিক ফ্রেশ লাগবে। তারপরে খেয়েই একটা জম্পেশ করে ঘুম দেবে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলো একটা অচেনা নাম্বার থেকে মিসকল হয়ে আছে। দূর এখন আর রিং ব্যাক করতে ইচ্ছে হলোনা- ভাবলো যার দরকার সে নিশ্চয়ই আবার করবে।

এতদিন এতবছর ধরে জমিয়ে রাখা আবেগ দোদুল্যমান মন নিয়ে আজ মল্লিকা ফোন করেছিলো রাতুলকে।দীর্ঘ পাঁচবছর সাংসারিক জীবনে বিচ্ছেদের পরেও ও পারেনি ভুলতে কিছুই। আসলে প্রকৃত ভালোবাসলে বোধহয় ভোলা যায় না, ঘৃণা করা যায় না। বড্ড উৎকন্ঠা হচ্ছে ওর, ফোনটা বেজে গেলো অথচ ধরলো না! অবশ্য নতুন এই নাম্বারটা ওর জানা নেই। হয়তো অচেনা নাম্বার দেখে ধরেনি ও। তাও মল্লিকা অপেক্ষা করে একবার যদি রাতুল কল  ব্যাক করে! আবার পরক্ষণেই ভাবে হয়তো রাতুলও ওর মতোই পুরোনো নাম্বারটা ছেড়ে দিয়েছে।

পরেরদিন রাতে একইসময় ফোনটা আবার একটু বেজেই কেটে গেলো। রাতুলের মনে পড়লো গতকাল একই নাম্বার থেকে ফোনটা এসেছিলো। এবার রাতুলই কল ব্যাক করলো। ফোনটা বেজে উঠলো ওই প্রান্তে।কে যেন ফোন ধরে চুপ। তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে রাতুল কিন্তু কোনো উত্তর নেই।

–হ্যালো কে বলছেন?

এবার মৃদুস্বরে কে যেন বললো, আমি।

-আমি? আমিও তো আমি। কিন্তু আপনি কোন আমি?

এবারে ওপ্রান্ত বললো- গলা শুনে চেনা যাচ্ছে না? কেমন আছো?

কানের মধ্যে মিষ্টি ঝর্ণার কলতানে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো রাতুলের। এ গলা তার বহু পরিচিত, ভীষণ কাছের। -কে? মল্লিকা?

— হুম,চিনতে পেরেছো? মনে আছে আমায়?

— তুমি তো আমার মনেই আছো মল্লিকা।

এবারেও ওপ্রান্ত চুপ।

রাতুল এবার বললো–এতদিনে মনে পড়লো আমাকে?

এবারে ওপ্রান্ত হেসে উঠে বললো -তুমিতো আমার মনেই আছো রাতুল।

রাতুলও এবার মৃদু হেসে বললো– দ্যাখো, মনে মনে আমরা কত কাছাকাছি কিন্তু পায়ে পায়ে কতদূরে চলে গেছি।

ওপ্রান্তে মল্লিকা চুপ। শুধু একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস রাতুলের কানে পৌছলো।

আমি এখন অনেক পাল্টে গেছি মল্লিকা…নিজেকে চিনেছি, চিনেছি আশেপাশের মানুষজনকে। আসলে সময় আর পরিস্থিতি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। এতো রাতে তুমি যে আমার সাথে কথা বলছো তোমার উনি কিছু বলবেন না’তো?

– কোন উনি? জিজ্ঞাসা করলো মল্লিকা।

– না তোমার এখন পাশে যিনি।

– আমার পাশে তো কেউ নেই। আমি আর আমার অস্তিত্ব দু’জনে মিলেমিশে বেশ আছি।

– বিয়ে করোনি কেন মলি?

– ওই যে তুমি বলেছিলে- আমাকে তুমি এত ভালোবাসবে যে অন্য কাউকে আমার মনেই ধরবে না–তাই। তা তুমি করেছো নিশ্চয়ই বিয়ে?

– না মলি, তা আর পারলাম কই? আমারো পুরো অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তুমিই আছো। এই যে তুমি এত দূরে থেকেও মনে মনে বলেছো “ভালোবাসি ভালোবাসি”। আর তা আমার মনেও প্রতিধ্বনি তুলেছে প্রতিদিন। তাই তো তুমি আমার কাছেই ছিলে মল্লিকা আর তাই অন্য কাউকে প্রয়োজন হয়নি জীবনে।

– বাহ বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছো তো এখন। কবিতা টবিতা লিখছো না’কি আজকাল?

– মনে মনে সবাই কবি ম্যাডাম আর তুমিই তো আমার কবিতা… হাসে রাতুল…বলে আমি এখন শুধু গুছিয়ে কথাই বলিনা গুছিয়ে সংসারের কাজও করতে পারি। একদিন এসে দেখে যাও ম্যাডাম।
– সে কি? তুমি আর ঘরের কাজ?
– হুম, পাল্টেছি নিজেকে। সবই অভ্যেস জানো! আসলে তুমি চলে যাবার পর… আমার সংসারটা ভেঙে যাবার পর…বাড়িতে আর মন টিঁকছিলোই না। ভাইয়ের বিয়ে হলো…আমার ঘরটা ওকে ছেড়ে দিলাম। তারপর দমদম স্টেশনের কাছে এই ফ্ল্যাটটা নিলাম। অনেক ভেবেছি যে আগে কেন নিইনি এই সিদ্ধান্তটা।আসলে পারিবারিক সম্পর্কে নানাজনের মতামতের চাপে স্বাধীন চিন্তাভাবনা করাটা বেশ শক্ত। এখন কিন্তু বেশ আছি। আমার একলা জীবন পাল তুলেছে তোমার কথা ভেবে…শুধু তোমার কথাই ভেবে। আর এই ভাবনার জোর আছে কিন্তু। দ্যাখো,তুমি আমায় ফোন করলে। অবশ্য আমিও তোমায় করেছিলাম কিন্তু অন্য মানুষ ফোন ধরেছিলো। আমি ভেবেছিলাম তোমার বর।

– না,পুরোনো নম্বরটা বদলে ফেলেছি অভিমানে।

– অভিমান হওয়ারই কথা। আমি অবিবেচকের মত খারাপ ব্যবহার করেই গেছি তোমার সাথে। আমি আজ অনুতপ্ত। পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়।

– থাক ওসব পুরোনো কথা…কিছু আমি ভুলেছি…কিছু তুমিও ভুলেছো। তার চেয়ে নতুন কথা বলি এসো।

এরপর রোজ ফোনে কথপোকথন চলতেই লাগলো। একদিন রাতুলই বললো– এসো একদিন দেখা করি।
-আবার?
-হুম,নতুন করে আবার সব গোছাবো।
– শখ তো মন্দ নয়।
– না,ভাবছি…শেষ থেকে আবার শুরু করলে কেমন হয়?
– এই শুরু আর সেই শুরু মেলাতে পারবে তো?
– নিশ্চয়ই মেলাবো। তিনি যখন আবার আমাদের মিলিয়েছেন তখন আমাদের চেষ্টা করতে দোষ কি?
রাতুল বাইক নিয়ে দাঁড়ালো সেই জায়গায়…ডিউটি শেষে মল্লিকাও এলো সেইখানে। দু’জনে গিয়ে বসলো সেই নদীর ধারে যেখানে ওরা প্রথম প্রেমপর্বে যেত।

মৃদু মৃদু হাওয়া বইছে। নদীর ধারের গাছগুলো যেন ওদের চিনতে পেরে শাখা দুলিয়ে সাদরে সম্ভাষণ করলো।বাসা ফেরত পাখিরাও যেন ওদের দেখে গাছে গাছে কিচির মিচির করে আনন্দে কোলাহল করে উঠলো। নদীর ধারের বেঞ্চে ওরা চুপ করে খানিক বসে রইলো। সুবিশাল আকাশ আর শান্ত নদীও ওদের দিকে অপলক চেয়ে রইল…সত্যি এই দুজনের জুটিকে কী ভীষণই না মানাতো…অথচ….।

সে যাক…দুখের কথা যাক ভেসে যাক নদীর জলে। রাতুলই প্রথম কথা বললো…বললো, দেখো তখন আমার কী ভীষণ জেদ, রাগ, ঈর্ষা ছিলো…সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে হতো। এখন সেসব কিছুই নেই। এখন আমি অন্য মানুষ। বিশ্বাস করো, তোমার চলে যাওয়া আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আর কখনো এমন করে চলে যেও না বলে আলতো করে হাত ছুঁলো মল্লিকার।

মল্লিকা খানিক চুপ থেকে বললো–বোঝো নি আমায়,বোঝো নি কীভাবে তোমার নরম ছোঁয়ায় বেঁচেছিলাম।অভিমানে ডুবে গেছে সব…ভালোবাসাও।

রাতুল ওর শক্ত মুঠোয় নিলো মল্লিকার নরম হাতটি আর এমন করেই ওরা পুরোনো সবকিছু ভুলে আবার নতুনের পথে পা বাড়ালো।

বেশ কিছুদিন পরে রাতুল বললো- আমরা আবার একসাথে থাকতে পারি’না?

– এই তো বেশ আছি। আবার নতুন করে আর লোকে কি বলবে?

-ভয় পাচ্ছো? না, আর আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলছি না। এবার শুধু একসাথে থাকো। পরে কখনো ভরসা হলে বিয়ে কোরো কাগজে-কলমে।

– মানে? লিভ টুগেদার? ও আমি পারবো না। সবাই কি ভাববে?

-মলি, এখনো তুমি লোকের কথা ভাবো? লোক কি তোমার এতদিনের মনের কষ্টের কথা ভেবেছিলো? কেউ ভাবে না বুঝেছো…সবাই শুধু নিজের ভালোটাই ভাবে…এ দুনিয়া বড় স্বার্থপর। তুমি বোকা… তাই এসব ভাবছো। লোকের বলায়, ভাবায় আর আমাদের কিছু যাবে আসবে না। আমাদের সম্পর্কের মাঝে আর কাউকে আমি আসতে দেবো না।
এখন শুধু যে অভিমানগুলো তোমাকে আর আমাকে ছুঁয়ে আছে সেগুলোর কথা ভাবো… সেই অভিমানগুলোকে ভুলিয়ে দাও আদরে,ভালোবাসায়। যে সময়টা আমরা মিছিমিছি নষ্ট করেছি…অবহেলা করেছি… সেই সময়টা আর ফিরে আসবেনা।তাই এখন থেকে যেটুকু সময় পাবো শুধু টুপটাপ ঝরে পড়া সুখ কুড়োই, চলো। প্লিজ মলি, বোঝো একটু।
ঘর ছাড়ার আগে মলি মাকে বলেছিলো…মা শুনে বলেছেন –কি তোদের নতুন যুগের ন্যাকামি…বুঝি না বাপু…শুধু শুধু লোক হাসানো।

দমদমের সেই ফ্ল্যাটে আবার নতুন করে সংসার পাতে দু’জন মিলে। সেখানে খোলা দখিনের ব্যালকনিতে রোদ আসে…বৃষ্টি নামে…পাখি গায়…ফুল ফোটে আনন্দে আর রঙীন প্রজাপতি পাখা মেলে। আর দুটো সাদা মনের ক্যানভাসে সাতরঙের রঙ তুলিতে কতই’না ছবি আঁকা হয়।

দুটো মনপাখি আবার উড়ে যায় খোলা আকাশে স্বপ্নের ডানা মেলে।

Loading

Leave A Comment