গল্প

গল্প- সহজিয়া কথা

সহজিয়া কথা
– শান্তনু ব্যানার্জী

 

 

এ লেখাতে সহজিয়া কথাটা আভিধানিক নয়। জীবনের যাত্রা পথে সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের স্পর্শে নিজেকে সম্মানিত মনে হয়েছে। স্বল্প পরিসরে সামান্য কিছু ঘটনার একটা কোলাজ। একটু আদর মিশিয়ে তাদেরকে আমি বলি সহজিয়া। গ্রামকে গ্রাম হিসেবেই দেখেছি। তাদের dialect বা বিশেষ জায়গার নাম উল্লেখ করা হয়নি। বলা বাহুল্য সব ঘটনাই বহু বছর আগের। অবশ্যই গ্রামীণ পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে।
মুড়ির ঠোঙা মার্কা একটা লোকাল বাস। সন্ধ্যার সময় যাত্রা করে পরের দিন সকালে পৌঁছবে। বাসের লোকজন সকলেই পাহাড়ি। পাহাড়ি পথে বাস এগিয়ে চলেছে। দূরে টিম টিম করে গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলো জ্বলছে। রাত সাড়ে আটটায় বাসটা একজায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লো। দশ মিনিটের জন্য। চা আর বাঁধাকপির বড়া পাওয়া যাচ্ছে। শীতের রাত। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। যখন রাত এগারোটা, তখন ড্রাইভারের মর্জিতে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। রাতটা এখানে থাকবে। ড্রাইভারের ঘুম পেয়েছে। অর্থাৎ সকালে পৌঁছনো হবে না। বেলা গড়িয়ে বারোটা বেজে যাবে। চেঁচিয়ে লাভ নেই। যাত্রীরা এরকম ঘটনায় অভ্যস্ত। সবাই নিজের নিজের থাকার জায়গা খুঁজে নেবে। আমার পাশে বসা মানুষটির সাথে আগেই আলাপ হয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু আমি যেন চাইনিজ বলে নিজেকে পরিচয় দিই। কারণ এখানে চাইনিজদের খুব খাতির করে। আমি ভাবলাম যে আমাকে কি চাইনিজ বলে মনে হয়। যাই হোক ওর সরল বিশ্বাসে বাঁধা দিলাম না। কিন্তু যেখানে থাকার ব্যবস্থা হল তা একেবারেই অনুপযুক্ত জায়গা। কিছু করার নেই এক রাত কাটাতে হবে। পরের দিন ভোরে গাড়ি চলতে শুরু করলো‌। কিন্তু কিছুটা গিয়ে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। মিস্ত্রি না আসা পর্যন্ত গাড়ি কি হবে বোঝা যাবে না। সেই লোকটিই বললো, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। হেঁটে গেলেও পৌঁছে যাব। অগত্যা রাজি হলাম। রাস্তা বলতে কিছু নেই। সঙ্গের লোকটি অভিজ্ঞ। পথে কারো ফেলে যাওয়া খালি সিগারেট প্যাকেট, চুয়িংগামের মোড়ক দেখে দেখে এগোতে শুরু করলো। এখানে অন্ধকার হলে ভালুকের ভয়। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের অপর সীমানায় পৌঁছলাম। তখন বেলা তিনটে। একজায়গায় পৌঁছতে আমাকে বিশাল বড় থালায় ভর্তি গরম সুজির হালুয়া দিয়ে গেল। চার চামচ খাবার পর থালাটা ফেরত দিতেই দেখলাম থালাটা অন্যদের এগিয়ে দিচ্ছে।
নিমন্ত্রিত হয়ে একবার একটা আধাশহর আধাগ্রামে উঠেছিলাম পল্লব ভদ্রের বাড়িতে। পৌঁছতেই এক গ্লাস লেবুর সরবত এসে গেলো। পল্লব জানত আমার সিগারেটের নেশার কথা। তাই জোর করেই পাঁচ প্যাকেট ক্যাপ্সটেন আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। তখন এই ব্র্যান্ডের একটা স্ট্যাটাস ছিল। কিছু কম দামী ব্র্যান্ড ছিল যেগুলো বহুবছর উঠে গেছে। যেমন পাশিং শো, কুল ইত্যাদি। আমার ঠোঁটে সিগারেট কখনো নিভতো না। প্রচলিত ছিল যে, মুখ তো নয় মনিকর্নিকার ঘাট।
কথা হল পরদিন গ্রামের বাড়িতে চড়কের মেলায় নিয়ে যাবে। বললাম, সন্ধ্যায় একটু আশপাশটা ঘুরে দেখি …..
রাস্তায় খুব ধুলো। কিছু দূর অন্তর লাইটপোস্টে চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব লাগানো আছে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে তখনকার বেডফোর্ড ইঞ্জিন ছুটে যাচ্ছে। কচ্চিৎ লেল্যান্ড ইঞ্জিন দেখা যাচ্ছিল।
রাস্তার ধুলো খুব রোল করছিল। এর মধ্যেই রাস্তার এক কোনে একটু ভীড়। ফুলুরি ভাজা হচ্ছে। আমরাও খেলাম।
পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম জলখাবার খেয়ে, গ্রামে লাঞ্চ হবে। তারপর চড়কের মেলায় মজা করে ফিরে আসব। গ্রামের যেখানে আমাদের বিশ্রামের ব্যাবস্থা ছিল সেখানে আগে থেকেই খাটিয়া পাতা ছিল। পৌঁছতেই আমরা আপ্যায়িত হলাম রেকাবিতে করে ছানা আর চিনি সমেত। আন্তরিকতাটাই আলাদা। তার সঙ্গে আমার সিগারেট খাওয়া চলছেই। একটা নাদুস নুদুস আঠারো, ঊনিশ বছরের ছেলে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি করে হাসছে। চোখাচোখি হতেই বললাম, একটা ছাইদানি নিয়ে আসতে। ছুটে গিয়ে একটা প্লেটে কিছু ছাই নিয়ে চলে এলো। সপ্রতিভ কিন্তু সরল এবং সহজিয়া।
চড়কের মেলায় আনন্দ করে ফেরার পথে পল্লব জানালো যে পরের দিন সকালে আমাকে কাছে একটা ড্যামে বেড়াতে নিয়ে যাবে। সন্ধ্যাতে আমার ফেরার ট্রেন।
ড্যামে পৌছে বেশ ভালো লাগছিল। চন্দ্রশেখর ঢালি বলে একজন অল্পবয়সী সদ্য বিবাহিত মাস্টার মশাইয়ের সাথে আলাপ হলো। কাছেই স্কুল। স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন একটু বেড়াতে। এর মধ্যে শুনলাম এখানে সস্তায় টাটকা বড় মাছ ফিসারি অফিস থেকে পাওয়া যায়। ইচ্ছে হলো পল্লবকে একটা মাছ প্রেজেন্ট করি। তাই করলাম। একটা পাঁচ কেজি ওজনের কাতলা মাছ। পল্লব বললো, এতটা মাছ খাবার লোক নেই। বরং মাস্টার মশাই কিছুটা নিন। মাছ কাটার ব্যবস্থা চলছে সেই সময় আর একটি অল্প বয়সী ছেলে এসে দাঁড়ালো। কলকাতা থেকে একাই এসেছে আর মাসির বাড়ি উঠেছে। কয়েক দিন থাকবে। এল আই সি তে কাজ করে । বললো, ও এখানে পারমিশন নিয়ে স্পিড বোটের ব্যাবস্থা করতে পারে। মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী উৎসাহিত হতেই এক দৌড়ে গিয়ে সব ঠিক করে এলো। মাছ কাটার কাজ চলছে। মাস্টার মশাই বাইনোকুলারটা ছেলেটাকে হাতে ধরতে বলে মাছগুলো গোছাতে শুরু করলো। এর মধ্যেই স্পিড বোট এসে গেছে। মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী চড়ে বসলেন। ছেলেটিও চড়ে বসলো। কিছু বোঝার আগেই বোট ছেড়ে দিল। মাছ গুছিয়ে হাত ধুয়ে মাস্টার মশাই দাঁড়িয়ে রইলো। স্পিড বোট অনেক দূরে চলে গেছে। একঘন্টার চুক্তি। কাউকে ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না‌। ছেলেটি নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে। ওর হাতেই তো মাস্টার মশাইয়ের বাইনোকুলার। আমার সময় হয়ে আসছিল‌ বিদায় নিলাম। উনিও মাছের জন্য ধন্যবাদ জানালেন। ফেরার সময় মনে হলো যেন ওনার মাথাটাও স্পিড বোটের মত চক্কর কাটছে।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page