ভুলের মাশুল
– প্রলয় কুমার নাথ
সন্ধ্যার অন্ধরাচ্ছন্ন রাভুলেরস্তা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছিল অরিত্রী। তার আলুথালু পোশাক, অবিন্যস্ত চুল আর শরীরের নানা স্থানে মারের কালসিটে দেখেই বোঝা যায় যে তীব্র দাম্পত্য কলহের শিকার হয়েছে অসহায় মেয়েটা। তার কপাল আর ঠোঁটের কষ গড়িয়ে আসা সরু রক্তের ধারা এখনো শুকিয়ে যায়নি। এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল মেয়েটা, তার ছেঁড়া শাড়ির আঁচল লুটিয়ে পড়ছিল রাস্তার বুকে। সে যে কোথায় যাচ্ছে তা সে নিজেই জানে না। লোকালয় পেরিয়ে পাড়ার ইঁট ভাটার কাছটা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ সে বুঝতে পারলো তিনটে গুন্ডা প্রকৃতির ছেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার পিছু নিয়েছে। বেগতিক দেখে হাঁটার গতি বাড়াল অরিত্রী, তারপর সেটা যেন দৌড়ানোর রূপ ধারণ করলো। ছেলেগুলোও তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলো।
একজন চিৎকার করে বলে উঠলো,”দৌড়ে আমাদের হাত থেকে পার পাবি ভেবেছিস শালী? যেখানেই যাস না কেন, আজ তোর সাথে লুডো খেলেই ছাড়ব রে ফুলটুসী!”
ওদের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওরা আকন্ঠ মদ্যপান করে আছে। এক সময় দৌড়তে দৌড়তে পা হরকে নীচে পড়ে গেল অরিত্রী। শয়তানগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসতে লাগলো তার কাছে। অরিত্রী মাটিতে নিজের শরীরটাকে ঘষটে আরো দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলো আর তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করলো না। একটি ছেলে ঝটপট নিজের প্যান্টের চেন খুলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো অরিত্রীর গায়ের ওপর। বাকিরা দুজন মজা দেখতে এবং নিজেদের সুযোগ আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ঠিক এমন সময় দূর থেকে একটি লাল আলো দেখা গেল, শোনা গেল পুলিশের গাড়ি আসার আওয়াজ। মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটা এগিয়ে এলো তাদের কাছে, গাড়ি থেকে রিভলভার হাতে নিয়ে লাফিয়ে নেমে আসল এক লেডি পুলিশ অফিসার আর কিছু কনস্টেবল। ছেলে তিনটে সেই মুহূর্তে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালানোর জন্য ব্যস্ত হল। কনস্টেবলগুলো ছুটে গেল তাদের পেছন পেছন, কিন্তু তাদের ধরতে পারলো না। মহিলা পুলিশটি এগিয়ে এল অরিত্রীর কাছে, তারপর তাকে মাটি থেকে উঠতে সাহায্য করে বললো, “নাম কি তোমার? তোমাকে কি ওরা কোথা থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল?”
– “আমার নাম অরিত্রী সরকার…না আমাকে ওরা কোন জায়গা থেকে তুলে আনেনি…আমি নিজেই এই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ওরা আমার পিছু নেয়!”
– “স্ট্রেঞ্জ…তোমার বাড়ি কোথায়? আর তুমি এই ভর সন্ধ্যা বেলায় এই জায়গায় এসেছিলেই বা কেন?”
কোন উত্তর দিল না অরিত্রী, শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
– “তোমার বাড়ির ঠিকানাটা বল…আমরা তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসব!”, আবার বললো পুলিশ অফিসার।
– “আমি বাড়ি যেতে চাই না, ম্যাডাম!”
শুনে অবাক হল লেডি অফিসার তথা স্থানীয় থানার ওসি সুতপা মৈত্র। কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে দেখল অরিত্রীর দিকে। তাকে দেখেই সে বুঝতে পারলো যে মেয়েটি শুধু কিছুক্ষণ আগে একটি গণধর্ষণের শিকার হতে চলেছিল এমন নয়, সে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সেরও শিকার। আরেকটু সময় দিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো সে সব খুলে বলবে। অরিত্রীকে গাড়িতে বসিয়ে থানায় নিয়ে এল সুতপা। কিন্তু সেখানেও তেমন মুখ খুলতে চাইলো না সে। এমন মেয়েদের অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছে সুতপা, সে জানে এমন অবস্থায় বেশ মেন্টাল ট্রমার মধ্যে থাকে মেয়েগুলো। সত্যি বলতে মেয়েটার ওপর খুব মায়া হচ্ছিল সুতপার। হয়তো আরেকটু সময় আরেকটু স্নেহের পরশ পেলেই স্বাভাবিক হতে পারবে মেয়েটা। তাই ডিউটি শেষে যখন সুতপা অরিত্রীকে বলে উঠলো, “শোনো, তুমি আমাকে নিজের বোনের মতই ভাবতে পারো, বুঝলে…চলো, কয়েকটা দিন না হয় আমার বাড়িতেই থাকবে চলো!”, তখন বিস্মিত অরিত্রীর আপত্তি করতে পারেনি তার কথায়।
পুলিশের গাড়ি করে অরিত্রীর সাথে বাড়ি ফেরার পথে তাকে নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে চলেছিল সুতপা। আজ ওই ইঁট ভাটার কাছে একটি দেশি মদের ঠেকে রেড করতে গিয়েছিল তার টিম, তাই তারা বাঁচাতে পেরেছে অরিত্রীকে।
পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছে সুতপার, শ্বশুর শ্বাশুড়ি অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। তার স্বামী একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার। স্বামী এবং তিন বছরের ছোট্ট শিশুপুত্রকে নিয়ে ছোট্ট সংসার তার। বিয়ের পর সে চেয়েছিল পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিতে কিন্তু তার স্বামী তা করতে দেননি। তিনি মনে করেন মেয়েদের সবসময় স্বনির্ভর হওয়া উচিত। তাই দিনের বেশিরভাগ সময় যখন সুতপা আর তার স্বামী দুজনেই বাইরে থাকে তখন একজন আয়া দেখাশোনা করে তাদের বাচ্চাটাকে। তার সুখের সংসারের কথা শুনে অচিরেই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল অরিত্রী। ইস, তারও যদি বৈবাহিক জীবনটা এমন হতো। তবে সুতপাকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল অরিত্রীর, পুলিশের মুখোশের গাম্ভীর্যের ভেতর খুব সরল হাসিখুশি মিশুকে মেয়ে সে। দেখতে দেখতে তারা পৌঁছে গেল সুতপার বাড়ি। তিনতলা সুন্দর করে সাজানো গোছানো বিশাল বাড়িটাকে দেখে যেন তাক লেগে গেল অরিত্রীর। সে বুঝতেই পারল যে স্বামীর ভালোবাসা ছাড়াও এই সংসারে আর্থিক প্রাচুর্যেরও সীমা নেই। অধিকাংশ দিনই সুতপার ফিরতে দেরি হয়ে যায়, তখন আয়া বাচ্চাটিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যায়। তার স্বামী অবশ্য সে ফিরলে তবেই একসাথে বসে খান। ফোনে স্বামীর কাছে অরিত্রীর সম্বন্ধে সব কথা জানিয়েছিল সুতপা। তিনিও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন অরিত্রীকে কিছুদিন এই বাড়িতে রাখার জন্য। বাড়ি ফিরে প্রথমে অরিত্রীকে নিজের একটি শাড়ি দিয়ে পরে আসতে বললো সুতপা। তারপর সে তাকে নিয়ে গেল তার স্বামীর কাছে, তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সে হাসিমুখে বললো, “এই হল হল আমার প্রিয় পতি দেবতা…শ্রী দীপঙ্কর মৈত্র!”
প্রথম দেখাতেই দীপঙ্কর আর অরিত্রী যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইলো একে অপরের দিকে। তার কিছু পরে নমস্কার প্রতিনমস্কারের পালা মেটালো দুজনে। সুতপা একবার কৌতুকের স্বরে বললো, “কি গো, তোমরা দুজনে একে অপরকে আগে থেকেই চেন নাকি?”
উত্তরে শুধু মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলেছিল অরিত্রী।
রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। ঘুম আসছিল না অরিত্রীর দুই চোখে। সে নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে মৈত্র বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়ালো। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার চারিদিকে, পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসছে হালকা হালকা ঠান্ডা বাতাস। আজ যদি সুতপা না থাকতো তাহলে ওই শয়তানগুলোর হাতে তার কি অবস্থা হত ভেবে শিউরে উঠছিল অরিত্রী। এমন সময় গলা খাকানির আওয়াজ শুনে পেছন ঘুরে চমকে উঠল অরিত্রী। সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে দীপঙ্কর। দীপঙ্কর মৃদু স্বরে বলে উঠলো, “আমাকে নিশ্চয় তোমার মনে আছে, অরিত্রী?”
অরিত্রী কোন উত্তর দিল না সে প্রশ্নের, এক দৃষ্টে চেয়ে রইল দীপঙ্করের দিকে। কিছুই ভোলেনি অরিত্রী, প্রতিটা স্মৃতি এখনো স্পষ্ট হয়ে ভাসছে তার চোখের সামনে। খুব ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছিল অরিত্রী, এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মচারী তার বাবাকে নিয়ে ছিল তার পরিবার। কলেজের গন্ডি পেরোতেই তার বিয়ের চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগলেন তার বাবা। তার ভাগ্য প্রসন্ন হওয়ায় অরিত্রীর জন্য এসেছিল উচ্চপদে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী সুদর্শন দীপঙ্করের সম্বন্ধ। দীপঙ্কর এক দেখাতেই পছন্দ করেছিল অরিত্রীকে। বিয়ের কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অমোঘ নিয়তির ফেরে, বিয়ের দিনই সকলকে অবাক করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল অরিত্রী। রাজুর সাথে কয়েক বছর একই কোচিংয়ে পড়ত অরিত্রী। সেখান থেকেই গড়ে উঠেছিল তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক। রাজু রূপ গুণ কোন অংশেই দীপঙ্করের সমতুল্য নয় জেনেও এমন আকর্ষণীয় সম্বন্ধ হাতছাড়া করে ভালোবাসার মানুষটার হাতই সেদিন আঁকড়ে ধরেছিল অরিত্রী। বেকার যুবক রাজুরও পরিবারে কেউ ছিল না, স্থানীয় একটি সাইকেল গ্যারেজে কাজ করতো সে। তার সংসারে অভাব জেনেও, তাকে বাবা কখনো বাড়ির জামাই হিসাবে মেনে নেবে না জেনেও বাবাকে লুকিয়ে তার সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্যেশ্যে পাড়ি দেয় অরিত্রী। তারপর প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে বাবার সাথে আর কোন সম্পর্ক নেই অরিত্রীর। তার বাবাও আর বেঁচে নেই, এবং মৃত্যুর আগে তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি কোনো এক অনাথ আশ্রমকে দান করে যান!
– “এই ভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে অরিত্রী?”, প্রশ্ন করলো দীপঙ্কর।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অরিত্রী বললো, “মদের নেশাটা যেন রাজুকে রাক্ষস বানিয়ে তোলে। বিয়ের পর থেকেই মদ খেয়ে আমার গায়ে হাত তোলা ওর এক স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। এখন মাঝে মাঝেই নেশাগ্রস্ত হয়ে আমাকে বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে আসতে বলছিল। কোন মুখে আমি বাড়ি যাই বলুন? আর না গেলেই মার…আজ অত্যাচার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে…” লজ্জায় কুণ্ঠাবোধে কথা শেষ না করেই চুপ করলো অরিত্রী।
-“রাজুর শাস্তি হওয়া দরকার অরিত্রী…তুমি সুতপাকে ওর ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলছো না কেন?”
– “না, আমি চাই না পুলিশ ওর কোনো ক্ষতি করুক…ও মানুষ হিসাবে খারাপ নয় দীপঙ্কর বাবু…আমি এখনো ওকে আগের মতই ভালোবাসি। জানি ওর নেশা কেটে গেলে আবার সেই আগের রাজুই হয়ে উঠবে…তাই…”
– “জানিনা তুমি কতটা সুখে আছো অরিত্রী” কথা শেষ করার আগেই দৃঢ় গলায় বলে উঠল দীপঙ্কর, “তবে আমি কিন্তু প্রথম দেখাতেই তোমায় ভালবেসে ছিলাম…সেদিন যদি তুমি রাজুকে ছেড়ে আমার হাত ধরতে তাহলে কি খুব একটা ভুল করতে অরিত্রী?”
অবাক চোখে অরিত্রী তাকিয়ে রইলো দীপঙ্করের দিকে। অতঃপর শান্ত নির্লিপ্ত গলায় সে বলে উঠলো,
– “এখন আর সেই সব ভেবে কোন লাভ নেই দীপঙ্কর বাবু…সুতপা খুব ভালো মেয়ে…ওকে সুখে রাখুন আপনি”, এই কথা বলে আর কোন দিকে না তাকিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এল অরিত্রী।
পরদিন সারাটা বেলা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কাটালো অরিত্রী। তার শুধু মনে পড়ছিল রাজুর কথা। হয়তো গতকাল তার হাতে মার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়াটা ঠিক হয়নি তার। এখন নেশা কেটে গিয়ে হয়তো রাজু আবার আগের মানুষ। হয়তো অরিত্রী কোথায় গেল এই ভেবে সেও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে তার জন্য! বাড়ি ফিরলেই তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে সে, আবার চলতে থাকবে তাদের সংসার! তাই সন্ধ্যার দিকে কাউকে কিছু না জানিয়ে মৈত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অরিত্রী। নিজের বাড়ি ফেরার পথ ধরলো সে। টালির ছাদ দেওয়া একতলা ছোট্ট বাড়িটার কাছে আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে রাজু আর অপর কোন এক মহিলার হাসির আওয়াজ শুনতে পেল সে। চুপি চুপি বাড়ির পেছনের খোলা জনলাটার দিকে এগিয়ে এল অরিত্রী। সে দেখলো বিছানার ওপর নগ্ন হয়ে রয়েছে এক কুৎসিত মহিলা। দেখে বাজারের যৌনকর্মী বলেই মনে হল তাকে। মদ্যপ রাজুর উলঙ্গ শরীরটা ক্রমাগত ওঠা নামা করছে সেই মহিলার দেহের ওপর। সেই মহিলাটি যৌন সুখপ্রাপ্তির আওয়াজ করতে করতে খিলখিল করে হেসে বলছে, “তোর বউ যদি জানতে পারে যে তুই তার রেখে যাওয়া গয়না বেচে আমার সাথে ফুর্তি করছিস, তাহলে কি ভাববে বল তো?”
কোমর দোলাতে ব্যস্ত মদ্যপ রাজুও বলে উঠলো, “কি আবার বলবে ওই মাগী? ওকে এই ঘরে ঢুকতে দিলে তো…”
– “সে কি রে! তুই না ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলিস…”
– “আরে রাখ তোর ভালোবাসা! ওই শালীকে পটিয়ে বিয়ে করেছিলাম যাতে ওর ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বাবার কাছ থেকে দিনের পর দিন পয়সা হাতাতে পারি! সেটা আর হল কোথায়, শালা বুড়োটা মরার আগে পুরো সম্পত্তি কোন এক অনাথ আশ্রমের নামে লিখে দিল। আমার প্ল্যান পুরো ফেল, এখন ওই শালী ফিরে এলেও ওকে আবার লাথ মেরে বার করে দেব…হা হা”
ওরা আরো অনেক কিছুই বলে চললো, কিন্তু অরিত্রীর কানে যেন সেই সব ঢুকলোই না। সে রাজুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এতদিন এত অত্যাচার সহ্য করেও সে রাজুর সংসার করেছে শুধুমাত্র তাকে ভালোবাসে বলে, এখন বুঝতে পারলো সেই ভালবাসা প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়! যেন বাঁচার ইচ্ছাটাই ধীরে ধীরে চলে গেল অরিত্রীর মন থেকে। সে আবার ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো, তবে আজ তার গন্তব্য হল বাড়ির পাশের রেল লাইন, উদ্দেশ্য আত্মহত্যা। অন্ধকারের মধ্যে রেল লাইনে দাঁড়িয়ে রইলো অরিত্রী। দূর থেকে সেই লাইনেই একটি ট্রেন আসছে বুঝতে পারলো সে, দেখা যাচ্ছে তার আলো, শোনা যাচ্ছে তার হুইসেলের শব্দ। অরিত্রীর আরো কাছে এগিয়ে এল ট্রেনটা, আসন্ন মৃত্যুর দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিল অরিত্রী। কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতেই লাফ মেরে রেল লাইনের এক পাশে গিয়ে পড়ল সে। ট্রেনটি সশব্দে বেরিয়ে গেল তার পাশ দিয়ে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে অরিত্রীর মনে হল, না এত সহজে মরবে না সে। যার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আজ তার এই অবস্থা, যার প্ররোচনার জন্য দীপঙ্করের সাথে সুখে সংসার করা হল না তার, যার জন্য বাবা তাকে ত্যাগ করলেন, যার জন্য আজ তাকে পথে ধুলোয় এই ভাবে পড়ে থাকতে হচ্ছে, এত সহজে ছেড়ে দেবে তাকে? নাহ, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে নাহলে মরেও শান্তি পাবে না সে!
ধীর পায়ে অরিত্রী আবার এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। এখন দেখল রাজু মদের নেশায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে বিছানাতে। ওই বাজারের মেয়েটা হয়তো কাজ শেষে বেরিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে তাই বাড়ির সদর দরজা ভেজানো। পা টিপে টিপে অরিত্রী এসে দাঁড়ালো রাজুর বিছানার কাছে। বিছানার এক পাশে এখনো পড়ে রয়েছে দেশি মদের বোতল আর আধ খাওয়া মদের গ্লাস। অরিত্রী জানত নেশা কিছুটা কাটলেই ওই গ্লাসের মদটা শেষ করবে রাজু। নিঃশব্দে রান্নাঘর থেকে এক প্যাকেট ইঁদুর মারার বিষ নিয়ে এল অরিত্রী আর তা মিশিয়ে দিল রাজুর মদের গ্লাসের মধ্যে। তারপর সে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। পেছনের জানলা দিয়ে দেখল কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে উঠে মদের গ্লাসটা নিঃশেষ করলো রাজু। আর সাথে সাথেই মরণ যন্ত্রণা শুরু হল তার শরীরে। মুখ দিয়ে গেজলা উঠতে উঠতে নীচে পড়ে গেল রাজু। ছটফট করতে করতে তার চোখ গেল জানলার দিকে। সে দেখলো অরিত্রী তখনো এক দৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিথর হয়ে গেল রাজুর দেহ।
সেই রাত্রে নিজেকে অনেক বেশি হালকা আর ফুরফুরে লাগছিল অরিত্রীর। শুধু সুতপার জন্য একটা চাপা ঈর্ষা বোধ যেন লুকিয়ে ছিল তার মনের কোন অংশে। যদি রাজুর প্ররোচনায় সে পা না দিত, তাহলে হয়তো সুতপার জায়গাটা আজ তার হত। সেও দীপঙ্করের সাথে সুখে স্বাচ্ছন্দে সংসার করতে পারতো। কিন্তু এখন যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, আর তার জন্য সুতপার সাথে কোন অন্যায় হোক সেটা কখনই হতে দেবে না সে। সে ফিরে এল মৈত্র বাড়িতে। তারপর দীপঙ্কর আর সুতপাকে সব কথা জানিয়ে নিজের দুই হাত মুঠো করে এগিয়ে দিল সুতপার কাছে। তারপর বললো, “আমি আমার স্বামীকে খুন করেছি সুতপা…তুমি আমায় এরেস্ট করো!”
সেদিন রাতে বাড়ির ছাদে দীপঙ্করের সাথে অরিত্রীর যে কথাগুলো হয়, তা সবই গোপনে শুনেছিল সুতপা। ভাগ্যের কি পরিহাস, অরিত্রীর মতই সুতপার মনেও তার জন্য ঈর্ষা বোধ জাগছে কারণ সেই যে ছিল দীপঙ্করের প্রথম ভালোবাসা। কিন্তু সুতপা জানে যে অরিত্রী কখনই দীপঙ্করকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইবে না। সে অরিত্রীর দুই হাত ধরে মৃদু হেসে বলে উঠলো, “তার কোন দরকার নেই বোন। এক বিশ্বাসঘাতক নরাধমকে উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছো তুমি। আর পাড়ার সকলেই দেখেছে যে গতকাল তুমি অত্যাচারিত হয়ে রাজুর বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। আজ তোমাকে ওর ওখানে কেউ দেখেনি। তাই এই কেসটাকে দাম্পত্য কলহের জেরে এক লম্পট মদ্যপ মানুষের হতাশায় ভেঙে পড়ে আত্মহত্যার ঘটনা প্রমাণ করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না আমাদের। আর শোনো, আমি তোমার থাকবার জন্য একটি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র ঠিক করেছি। আমি চাই তুমি অতীতের সব কথা ভুলে আবার জীবনটাকে নতুন করে শুরু কর, কেমন?”
অরিত্রী কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো সুতপাকে। তার চোখ গেল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দীপঙ্করের দিকে। তার মুখেও প্রসন্নতার হাসি ফুটেছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেই কোথাও যেন মিশে আছে নিজের প্রথম প্রেমকে না পাওয়ার বেদনা। কিছু কিছু ভুলের মাশুল হয়তো মানুষকে সারা জীবনের জন্য দিয়ে যেতে হয়!