অমানুষ
– প্রলয় কুমার নাথ
– “মা, ভাত বেড়ে দাও…বড্ড খিদে পেয়েছে…” পাড়ার রকের ইয়ার দোস্তদের সাথে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে এসে হাঁক পারল সঞ্জয়।
-“কই গো শুনছো, তোমার নবাবপুত্তুর রাজকার্য করে বাড়ি ফিরলো…তাকে সোনার থালা করে রাজভোগ সাজিয়ে দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন তোমার?” ভাতের হাঁড়ি নিয়ে কাজে ব্যস্ত নীলিমা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বিতৃষ্ণার স্বরে বলে উঠলেন সঞ্জয়ের বাবা বিনোদ বাবু।
-“ওফ আবার তোমরা বাপ ছেলে মিলে শুরু করলে…আমার আর এই সংসারে থাকতে এক দন্ডও ভালো লাগেনা বাপু…একদিন সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাব যেদিকে দুই চোখ চায়…” ছেলের সামনে ভাত ডাল তরকারির পাত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে উঠলেন নীলিমা দেবী।
– “ছেলে!” গর্জে উঠলেন বিনোদ বাবু, “ওই অমানুষটাকে ছেলে হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে আমার…চাকরি বাকরির তো কোন চেষ্টা নেই, শুধু দিন রাত রকে বসে আড্ডা আর বাড়ি ফিরে গান্ডি পিন্ডি গেলা…এখন তো ভাবি আমার কোন সন্তান না থাকলেও কোন দুঃখ ছিল না!”
সঞ্জয়ের কাছে বাপের এই ভর্ৎসনা শোনাটা রোজকার রুটিনের মধ্যেই পরে। তাই সে এত কিছু শুনেও নির্বিকার চিত্তে ভাত খেয়ে যেতে লাগলো।
– “উফফ তুমি থামবে…সবেমাত্র ছেলেটা খেতে বসেছে আর অমনি তুমি…”, নীলিমা দেবীর কথা শেষ না হতেই আবার চেঁচিয়ে উঠলেন বিনোদ বাবু,
– “কি থামবো শুনি…তোমার এই অকর্মণ্য ছেলের চামড়াটাও হয়েছে একেবারে গন্ডারের মত…আমি যে এত কথা বলছি ওর কোন ভ্রূক্ষেপ আছে? সত্যি এমন অমানুষ আমি দুটো দেখিনি…” বলতে বলতে শোবার ঘরের দিকে পা রাখলেন বিনোদ বাবু। তিনি চলে গেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলিমা দেবী সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
- “মানুষটার কথায় রাগ করিসনি বাবা…বুঝিসই তো মানুষটার বয়স হচ্ছে…তোকে নিয়ে চিন্তা করে বলেই তো…”, চোখের কোনে শাড়ির আঁচলটা ধরে সেই স্থান ত্যাগ করলেন নীলিমা দেবী।
বাবার কথা তেমন গায়ে না মাখলেও মায়ের চোখের জল দেখে সঞ্জয়ের বুকের ভেতরটা যেন হুহু করে উঠল। মাথা নিচু করে ডাল দিয়ে মাখানো ভাতের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে তার মনে হল এক নিমেষের মধ্যেই তার খিদেটা যেন পেট থেকে কোথায় চলে গেল। আধ খাওয়া ভাতের থালাটা দূরে সরিয়ে রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে একটা বিড়ি ধরালো সে। জামাটা খুলে রেখে বুক পকেট থেকে সস্তার মোবাইল ফোনটা বার করে দেখলো কখন সেটার চার্জ চলে গিয়েছে তার খেয়ালই হয়নি। সে ফোনটা চার্জে বসিয়ে অন করতেই বেশ কয়েকটা মিসড কল এলার্ট এবং একটি মেসেজ ঢুকলো তার ফোনে। তার মানে সন্ধ্যার দিকে অপর্ণা ফোন করেছিল তাকে, একবার নয় বেশ কিছুবার। শেষে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে সে, “তোমার সাথে খুব দরকারী কথা আছে সঞ্জুদা…কালকে বিকালে একবার পার্কে দেখা করতেই হবে। আসবে কিন্তু!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলার বাইরে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো সঞ্জয়।
পার্কের এই বেঞ্চটা ওদের অনেক দিন ধরে চেনা। ওরা যখনই এখানে আসে এই বেঞ্চেই বসে। অপর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো ওর দিকে চেয়ে। অপর্ণার সাথে ওর সম্পর্ক সেই উচ্চ মাধ্যমিকের সময় থেকে। সঞ্জয়ের থেকে স্কুলে এক বছরের জুনিয়র ছিল অপর্ণা। তারপর দুজনেই ভর্তি হয়েছিল একই কলেজে। সঞ্জয়ের ছিল বি.কম পাস আর অপর্ণার ইংলিশ অনার্স। সেই ঘটিগরমওয়ালাটা এগিয়ে এল ওদের দিকে, কিন্তু অপর্ণা জানিয়ে দিল যে আজ কিছু খাওয়ার ইচ্ছা নেই তার।
– “কি হয়েছে বলবে তো…নাকি আরো কিছুক্ষণ বেজার মুখেই বসে থাকবে”, বললো সঞ্জয়।
-“গতকাল সন্ধ্যায় আমাকে দেখতে এসেছিল সঞ্জুদা…চন্দন দেখতে ভালো, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট পাশ করে কলকাতায় মোটা মাইনের চাকরি করে…বাড়িতে সবার ওকে খুব পছন্দ…এখন শুধু ওরা কি বলে সেই অপেক্ষা…” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চললো অপর্ণা।
- “আর তোমারও পছন্দ তো?”
– “এটা হেঁয়ালি করবার সময় নয় সঞ্জুদা…এতদিন এম.এ করার বাহানায় আমি বিয়ের কথায় বাধা দিচ্ছিলাম…এখন তো সেটাও কমপ্লিট…এখন কি ভাবে…”
-“তুমি বিয়েটা করেই নাও অপু…এমন ভালো সম্বন্ধ পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার…”
কথাটা শুনে প্রথমে খুব হকচকিয়ে গেল অপর্ণা। তারপর সে সজোরে কষিয়ে দিল এক থাপ্পড় সঞ্জয়ের গালে। তার জামার কলার ধরে সে বলে উঠলো,
– “এটা শোনার জন্য এতদিন তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিলাম আমি? এটা শোনার জন্য নানা টাল বাহানা করে একের পর এক ভালো সম্বন্ধগুলোকে নাকচ করেছি আমি? এটা শোনার জন্য তোমাকে এতদিন নিজের শরীরটা ইচ্ছামত দিয়ে এসেছি আমি? এটা শোনার জন্য এতদিন ধরে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি আমি…” চিৎকার করতে করতে এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল অপর্ণা। পার্কের অন্যান্য কাপেলরা এবার উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তাদের দিকে। অপর্ণার ব্যবহারে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল সঞ্জয়। সে একবার চেষ্টা করলো অপর্ণাকে নিজের বুকে টেনে নিতে। কিন্তু উত্তেজিত অপর্ণা সজোরে ধরে ফেললো সঞ্জয়ের হাতটা, তারপর “চলো আমার সাথে…চলো…” বলে টানতে টানতে সঞ্জয়কে নিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল।
পুরোনো একতলা বাড়িটার দাওয়ায় বসে নিজের একটা ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করছিলেন নীলিমা দেবী। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে যেতে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে উঠতে যাবেন, এমন সময় সামনের দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। তিনি দেখলেন একটি মেয়েকে নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল তার ছেলে। আরেকবার ভালো করে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন যে সঞ্জয় নয়, বরং মেয়েটাই ধরে রয়েছে তার হাত। তার কিছু বলার আগেই অপর্ণা এগিয়ে এলো তার দিকে, তারপর কুণ্ঠা মেশান স্বরে বললো,
-“মাসীমা, আমাকে হয়তো আপনি চেনেন না। আমার নাম অপর্ণা। আপনার ছেলের সাথে একসাথেই পড়াশোনা করেছি আমি। আর আজ আপনার সামনে বলতে বাধা নেই যে আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি, মাসীমা…”
বাড়ির বাইরে একটি অপরিচিত মেয়ের গলা শুনে বেরিয়ে এলেন বিনোদ বাবুও।
– “আহ্ অপু…কি হচ্ছে কি, বন্ধ কর এইসব…” ফিসফিসিয়ে উঠল সঞ্জয়।
– “না সঞ্জয়…আর মুখ বন্ধ করে থাকতে রাজি নই আমি…” সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে বলে অপর্ণা এগিয়ে গেল বিনোদ বাবুর কাছে। তারপর তাকে বললো,
-“মেসোমশাই, আজ প্রায় সাত আট বছর ধরে আপনার ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক। ওকে ছাড়া আর অন্য কাউকে নিজের স্বামী রূপে কখনই ভাবতে পারব না আমি। তাই তো আজ ছুটে এসেছি আপনাদের কাছে…”
– “তোমার কথা তো কখনো আগে শুনিনি মা?” বিস্ময়ের স্বরে বলে উঠলেন বিনোদ বাবু।
– “তার মানে আপনার ছেলে আপনাদেরকে আমার সম্বন্ধে কোন কথাই বলেনি…এখন তো সন্দেহ হয় যে ও আমাকে সত্যিই ভালোবেসে ছিল কিনা? নাকি ইচ্ছামত শুধু আমার শরীরটা পাওয়ার জন্য…”
– “কি বলছ মা, তুমি!…কি রে, কি রে বল, ও যা বলছে তা কি সত্যি…” সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন বিনোদ বাবু। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো সঞ্জয়।
-“এক পয়সা তো ইনকাম করার মুরোদ নেই…বাপের পয়সায় বসে বসে খাস, কোনো লজ্জা নেই? তার ওপর এই সব? তোর মত অমানুষ জানোয়ার ছেলে জন্মাবার পরই কেন যে মুখে নুন দিয়ে মেরে দিলাম না আমি…”, তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন বিনোদ বাবু। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ না করেই অপর্ণা বলে চললো,
– “আমার বাড়ি থেকে অন্য সম্বন্ধ দেখছে…কিন্তু বিশ্বাস করুন মাসীমা, মেসোমশাই…ওকে ছাড়া যে অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারি না আমি…তাই আমি চাই আজই ও আমার কপালে সিঁদুর তুলে দিক, আজ থেকেই এই বাড়ির বউ হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দিন আপনারা!”
-“না না এ অসম্ভব…তুমি কি দেখে ওই অকর্মণ্যটাকে বিয়ে করতে চাইছো শুনি…এমনিতেই আমাদের টানাটানির সংসার…বিয়ে করে ও কি খাওয়াবে তোমায়!”, বলে উঠলেন বিনোদ বাবু। কান্নায় ভেঙে পড়লো অপর্ণা। নীলিমা দেবী এগিয়ে গেলেন অপর্ণার দিকে, তারপর তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে তার চিবুক স্পর্শ করে বলে উঠলেন,
– “আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের ভেতর এখন কি চলছে মা। সত্যি বলতে তোমার মত এমন লক্ষীমন্ত মেয়েকে এই বাড়ির বউ হিসেবে পাওয়া আমার কাছে গর্বের বিষয়…কিন্তু তোমার একটা ভবিষ্যত আছে মা, আর আমার ছেলে তোমাকে কথনই কোন সুখ স্বচ্ছন্দ দিতে পারবে না যা যে কোন মেয়েই তার স্বামীর কাছ থেকে চায়। নিজের পেটের ছেলে, তাও বুকে পাথর চেপে বলছি…সঞ্জুকে বিয়ে করলে তোমাকে খুব পস্তাতে হবে মা…যা হয়েছে হয়েছে…এখন তোমার বাড়ির লোক যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তাকেই বিয়ে কর মা…আর ভুলে যাও ওই হতভাগাটাকে!”, বলতে বলতে নিজেও কেঁদে ফেললেন নীলিমা দেবী। অপর্ণা ঘুরে দাঁড়াল সঞ্জয়ের দিকে, তারপর নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে কয়েকটা সস্তার সাজের জিনিস আর কিছু চিঠি টেনে বের করে সেগুলো সপাটে ছুঁড়ে মারলো সঞ্জয়ের মুখে। তারপর বললো,
– “সকলে বলত আমি তোমাকে ভালোবেসে খুব ভুল করছি, সঞ্জুদা…কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না। স্বপ্ন দেখতাম একদিন তুমি খুব ভালো একটা চাকরি করছো, তোমার সাথে সুখে সংসার করছি আমি! কিন্তু আমি ভুল ছিলাম সঞ্জুদা…সত্যিই ভুল করেছিলাম তোমার মত একটা অমানুষকে ভালোবেসে…তোমার দেওয়া সমস্ত গিফ্ট আর প্রেমপত্র ফিরিয়ে দিলাম তোমায়, আর কোনদিন যেন তোমার মুখ দেখতে না হয় আমাকে!” এই বলে মুখ ঢেকে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল অপর্ণা।
***
পাড়ার রকে বসে আড্ডা মারতে ইচ্ছা করছিল না সঞ্জয়ের। হতাশা, লজ্জা আর আত্মগ্লানিতে তার প্রাণটা হুহু করে কাঁদছিল, শুধু চোখে কোন জল ছিল না কারণ ছেলেদের যে কাঁদতে নেই। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি ভেসে আসছিল তার চোখের সামনে। স্কুলে পড়াকালীন পড়াশোনায় খারাপ ছিল না সে। অন্যান্য সকল বাবা মায়ের মত নীলিমা দেবী আর বিনোদ বাবুও অনেক স্বপ্ন দেখতেন তাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। পোস্ট অফিসের কেরানী বিনোদ বাবুর আয় ছিল অল্প, কিন্ত তিনি যতটা পারতেন ছেলের পড়াশোনা আর টিউশনের পেছনে খরচা করতেন। মাধ্যমিকে বেশ ভালোই নম্বর পেয়েছিল সঞ্জয়। তাই উচ্চ মাধ্যমিক সায়েন্স নিয়েই ভর্তি হয়েছিল সে। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে আর কি হবে। সেই সময় থেকেই তার জীবনে এল অপর্ণা। পড়াশোনার দিকে বেশি দৃষ্টিপাত না করে সেদিনের সেই উচ্ছসিত তরুণটি সময় ব্যয় করেছিল প্রেমিকার কাছে। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক ফল হল খুব খারাপ। কলেজে বি.কম পাশে ভর্তি হল সঞ্জয়। তখন থেকেই যেন পড়াশোনার ক্ষেত্রে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল সে। কোনো মতে পাশ করে কলেজের গন্ডি পেরোতেই সূচনা হল তার বেকার জীবনের। আর সেদিন থেকে আজ অবধি সে সকলের চোখে অমানুষ, অকর্মণ্য। সেদিন থেকে আজ অবধি ওই ছাপোষা রেজাল্ট নিয়েই অফিসের দোরে দোরে ঘুড়েছিল সঞ্জয়, একটা চাকরির আশায়। কিন্তু কিছুই হয়নি। মাঝে পেয়েছিল একটা কাজ একটি বিমা কোম্পানিতে, কিন্তু টার্গেট না পূরণ করতে পারায় সেই চাকরিও গিয়েছে। কি মনে হতে সামনে রাখা দেশি মদের বোতলটা তুলে ঢকঢক করে এক নিমেষে পুরোটা ফাঁকা করে দিল সঞ্জয়। তারপর কাউকে কিছু না বলে ধরলো বাড়ি ফেরার পথ। সেটা দেখে তার এক সঙ্গী তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– “কি হল গুরু…আজ এত তাড়াতাড়ি কেটে পড়ছো?”
তার কথায় পাত্তা দিল না সঞ্জয়। অমনি অপর এক সঙ্গী তাকে বললো,
– “আরে জানিস না…গুরুর আজ খুব মন খারাপ…আরে ওর ওই জানেমন, কি যেন নামটা…হ্যাঁ, অপর্ণা…ওর যে পরের মাসেই বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে চন্দন নামের এক চার্টার্ড একাউন্টেন্টএর সাথে!”
নিরিবিলি রাস্তায় টলতে হাঁটছিল সঞ্জয়। আশেপাশে যাও বা এক দুইজন পথচারী ছিল, তাদের গলার আওয়াজ কানে আসছিল সঞ্জয়ের,
– “আরে এটা বিনোদ বাবুর ছেলে না? কি অবস্থা হয়েছে ওর, মুখ দিয়ে বেরোনো মালের গন্ধে টেকা দায়! সত্যিই এমন ভদ্রলোক বাবার এমন অমানুষ সন্তান…এ তো ভাবাই যায় না!”
এই সব গা সওয়া হয়ে দিয়েছে সঞ্জয়ের। উদ্ভ্রান্তের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে, টলমল পায়ে পৌঁছে গিয়েছিল শহরের শেষ প্রান্তের রাস্তায়। এমন সময় হঠাৎ মুষলঝাড়ে বৃষ্টি নেমে এল। রাস্তা একেবারে জনমানবশূন্য। এমন সময় হঠাৎই সঞ্জয়ের পেছন ঝড়ের গতিতে ধেয়ে এল একটি দামী গাড়ি। গাড়ি চালক বোধহয় এত বৃষ্টির মধ্যে সঞ্জয়কে আগে থেকে দেখতে পায়নি। তাই অল্প দূরত্বে তাকে দেখে হঠাৎ ব্রেক কোষে ধরে। আর তারপরই ঘটলো বিপত্তিটা। গাড়ির আওয়াজে সচকিত হয়ে টলমল পায়ের লাফ মেরে কিঞ্চিৎ দূরে সরে গেল সঞ্জয়। রাস্তায় পড়ে গিয়ে অল্প চোট লাগল তার শরীরে। কিন্তু গাড়িটা যেন হঠাৎ ব্রেকের ঝোঁক সামলাতে না পেরে এক পাশে হেলে গিয়ে সজোরে বাড়ি খেল রাস্তার ধারে থাকা একটি গাছের সাথে। ড্রাইভারের পাশের জানলার কাঁচ ভেঙে গিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল গাছের কিছু ডালপালা। গাড়ির ভেতর থেকে একটি মেয়ের চেনা গলার আওয়াজ শুনতে পেল সঞ্জয়, “চন্দন…চন্দন কি হল তোমার?” কিন্তু তার কিছু পরেই স্তব্ধ হয়ে গেল সেই কন্ঠ। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন সব নেশা উবে গেল সঞ্জয়ের মস্তিস্ক থেকে। সে ছুটে গেল গাড়িটার দিকে। গাড়ির ভেতরে এক অচেনা সুদর্শন যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় স্টিয়ারিংয়ের ওপর মাথা রেখে পড়ে আছে। আর তার পেছনের সিটেও আহত হয়ে যে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে রয়েছে…সে আর কেউ নয়, অপর্ণা। সঞ্জয় তার নেশাতুর লাল হয়ে যাওয়া চোখের ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইলো ওদের দিকে।
***
নার্সিং হোমের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অস্থিত চিত্তে অপেক্ষা করছিল অপর্ণা এবং চন্দনের পরিবার। অবশ্য আরো একজনও সেখানকার চেয়ারে মাথা নত করে বসে ছিল, সে হল সঞ্জয়। অপর্ণার আঘাতটা তেমন গুরুতর নয়, সে আগেই সুস্থ হয়েছে। কিন্তু চন্দনের অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল। মাথায় বড্ড গুরুতর জখম হয়েছে তার, হয়েছে অধিক মাত্রায় রক্তক্ষরণ। তাই তার অপারেশন চলছে এই সময়। তার মা বাবা কান্না ভেজা গলায় এক মনে ভগবানকে ডেকে যাচ্ছিলেন। বিয়ের আগে হবু স্ত্রীকে নিয়ে একটু বেরিয়েছিল চন্দন, তাতে এ কী বিপত্তি! অপর্ণার মা বাবা ক্রমাগত সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলেন ওদেরকে। এমন সময় নিভে গেল ও.টির লাইট। ডাক্তার বাবু বেরিয়ে এসে হাসিমুখে চন্দনের মা বাবাকে বললেন,
– “অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে! আপনার ছেলে এখন আউট অফ ডেঞ্জার! আর কয়েকটা দিন ওকে একটু অবসার্ভেশনে রেখে আশা করি আমরা রিলিজ করতে পারব!”
সকলের মুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফুটে উঠল। ডাক্তার বাবুকে ধন্যবাদ দিতে দিতে আর ঈশ্বরের নাম করতে করতে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন চন্দনের বাবা মা। এমন সময় ওদের সকলকে অবাক করে ডাক্তার বাবু বলে উঠলেন,
-“ধন্যবাদ যদি দিতেই হয় তাহলে সঞ্জয় বাবুকেও দিন! কারণ সঠিক সময়ে যদি এম্বুলেন্স ডেকে পেশেন্ট দুজনকে উনি এখানে না আনতেন, আর চন্দন বাবুর অপারেশনের জন্য উনি নিজের রক্ত না দিতেন, তাহলে হয়তো আপনাদের ছেলেকে আমাদের পক্ষে বাঁচানো সম্ভব হত না! সত্যি মানুষের মত কাজ করেছেন সঞ্জয় বাবু…ব্রাভো ইয়ং ম্যান!”
ডাক্তার বাবুর কথা শুনে সকলে বিস্ময় তথা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইল সঞ্জয়ের দিকে।
কয়েক দিন আগেই রিলিজ দেওয়া হয়েছে চন্দনকে। এখন সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ সে। অপর্ণা তো আগেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আজ চন্দনের আহ্বানে অপর্ণা এবং তার মা বাবা এসেছেন তাদের বিশাল বড় বাড়িটাতে। ওরা সকলেই দেখলো যে অনাহুত অতিথির মত সেখানে ডাকা হয়েছে সঞ্জয়, বিনোদ বাবু আর নীলিমা দেবীকেও। সকলে একত্রিত হলে চন্দন বলে উঠলো,
– “আজ আপনাদের চোখে থাকা একটা মস্ত বড় ভুলকে আমি ভেঙে দিতে চাই। অপর্ণা আমাকে কোন কথা গোপন করেনি, সঞ্জয়ের সাথে ওর একটা সম্পর্ক ছিল জেনেও আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি…এটা ভেবে যে ছেলেটা সত্যিই হয়তো অমানুষ, সে ডিসার্ভ করে না অপর্ণাকে।”
চন্দন কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল সঞ্জয়ের দিকে। জল ভরা চোখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্জয়। চন্দন গিয়ে সঞ্জয়ের দুই কাঁধ ধরে মুখে প্রসন্নতার হাসি নিয়ে বললো,
– “কিন্তু জীবনে বড় হওয়ার পরীক্ষায় পাশ না করলেও, সব চেয়ে বড় মনুষ্যত্বের লড়াইয়ে যে জিতে গিয়েছে সঞ্জয়। অপর্ণাকে ও ভালোবেসেছিল, কিন্তু তার বদলে লাঞ্ছনা আর অপমান ছাড়া ওর ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। অপর্ণার সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল, কিন্তু তাতে তো অপর্ণারও মত ছিল! তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওর আমাকে এখন ঈর্ষা করা উচিত কারণ আমিই যে কেড়ে নিতে চলেছি ওর প্রেমিকাকে। তাই সেদিন গাড়ি এক্সিডেন্টের পর ওর কাছে সুযোগ ছিল আমাকে আর অপর্ণাকে ওই স্থানেই মরণের মুখে ফেলে কেটে পরার। কিন্তু ও সেটা করেনি, নিজের সমস্ত মান অভিমান ভুলে আমাদের নার্সিং হোমে পৌঁছে দিল সে, এমনকি নিজের রক্ত দিয়ে আমার জীবন পর্যন্ত বাঁচালো সে! হয়তো সে ভেবেছিল অপর্ণা সত্যিই সুখে থাকবে আমার কাছে! সত্যিকারের মনুষত্ব আর অপর্ণার প্রতি গভীর ভালোবাসার এর থেকে বেশি কোন প্রমাণের দরকার হয়না। তাই আমি ঠিক করেছি, অপর্ণার সাথে আমার নয়, বিয়ে হবে সঞ্জয়ের। তাছাড়া আমার অফিসে আমাকে এসিস্ট করার জন্য একজন কর্মচারীকে নিয়োগ করার কথা চলছে, সেই পজিশনে আমি সঞ্জয়কে নিযুক্ত করব। আমার বিশ্বাস আমি ওকে ঠিক গড়ে পিটে তুলতে পারব যাতে ও জীবনে আমার মতই সাফল্য অর্জন করে। কি অপর্ণা, এবার খুশি তো?”
অপর্ণা চোখের জল মুছে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগল চন্দনের দিকে। সকলে অবাক হয়ে দেখলো চন্দন অপর্ণার হাতটা গুঁজে দিল সঞ্জয়ের হাতের মধ্যে। দুজনেই বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো একে অপরের দিকে। চন্দন যেন মনে মনে বলে উঠলো,
– “শুধু মনুষত্বের পরীক্ষায় তুমি একা পাশ করবে আর আমি হেরে যাব, তা কি করে হয় সঞ্জয়? তাই এত কিছু হওয়ার পর অপর্ণাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমিও জিতে গেলাম নিজের বিবেকের কাছে…প্রমাণিত হল যে তোমার মত আমিও অমানুষ নই!”
(সমাপ্ত)