ঘুঙুর
– সৃজিতা ধর
ঘুঙুরের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো অনন্যার। ওর বাবা ওর সাধের ঘুঙুরটা হাতে নিয়ে চোখের জল মুছছে। কাল অনুর(অনন্যার) বিয়ে। রোজকার অভ্যাসের ছেদ ঘটতে চলেছে। প্রতিদিন আদরের মেয়েটার নাচের ছন্দ আর বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখবে না। নাচের জগতে অনন্যার পা পড়েছিল সেই ছয় বছর বয়সে। সামর্থ না থাকায় নাচ শিখতে পারেনি। দেখে দেখে যা শিখেছে…আর বড়ো হয়ে স্মার্টফোনের দৌলতে ইউটিউবে নাচ শেখা….অনু নাচে কিন্তু দারুণ, দেখার মত। নিজেদের আর্থিক অবস্থা দেখে নাচ শেখার কথা মুখ ফুটে বলেনি কখনো। কিন্তু বাবার মন আজও কষ্ট পায়, অলক্ষ্যে কাঁদে। ও যখন বছর ষোলোয়, তখন একটা ঘুঙুর উপহার হিসেবে পেয়েছিল বাবার থেকে। মাধ্যমিকের দুর্দান্ত রেজাল্টের পর এটাই ছিল অনুর উপহার। পড়ালেখাতেও বেশ ভালো। প্রাইভেট কোম্পানির উচ্চপদে চাকরিও পেয়েছে মাস তিনেক হল।
অনু এগিয়ে এসে বাবার চোখের জল মুছে দিল।
– মন খারাপ? বেশি দূরে তো না। মন খারাপ হলেই চলে যাবে।
– নারে মা, মন খারাপ না…. কষ্ট। আচ্ছা, কাল নাচ নিয়ে কি কথা হচ্ছিল অজয়ের সাথে?
খানিকটা গর্বিত হয়েই বলল অনু- “ও বলেছে আমাকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেবে। আমার সব না পাওয়াগুলোকে পাইয়ে দেবে বলেছে।” বাবার চোখে তখন মেয়েকে সুপাত্রস্থ করার শান্তি দেখা গেল।
– বাবা-মেয়ের গল্প শেষ হলে এদিকে এসো।
মায়ের এই মধুরবচন অনেকটা বিরিয়ানি খেতে খেতে মুখে লবঙ্গ পড়ার মতই লাগল… যাই হোক।
আজ অনুর বিয়ে। “কন্যা সম্প্রদান”-এর সময় চোখের কোণে যে জলটা চিকচিক করছিল সেটা একমাত্র অনুর চোখ এড়াতে পারেনি। মেয়ে বিদায়ের সময় আশীর্বাদ করে বাবার প্রথম প্রশ্ন- “ঘুঙুরটা নিয়েছিস তো?” অঝোরে কাঁদতে লাগলো মেয়ে। পরে অবশ্য সামলে নেয়।
বৌভাতের রাতে অজয়ের প্রথম প্রশ্ন
– তুমি কবে জানি জয়েন করছো?
– কেন…..কেন বলো তো?
– না মানে আমার বস্ হার্ডলি পাঁচদিনের ছুটি মঞ্জুর করেছে। তোমার?
-আমি দিন দশেকের ছুটি নিয়েছি।
পরের দিন সকালে খালি ভাবছে অনু- শুধু চাকরির খবর নিল? কই… আমার কোনো শখের কথা তো জানতেও চাইলো না। পরে অবশ্য মনকে শান্ত করে- কিবা আর শুনবে? সবই তো জানে…ঐ নাচটাই যা শখের আমার।
বিয়ের মাস চারেক কেটে গেল। একদিন অনু বললো অজয়কে,
– তোমায় একটা কথা অনেকদিন ধরে ভাবছি বলবো। বলছিলাম, মনে আছে আমায় তুমি বলেছিলে….
– কি বলেছিলাম?
– ঐ যে নাচের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেবে।
– ধুর পাগল…. তুমি সিরিয়াসলি নিয়েছিলে নাকি? আমি তো জাস্ট কথার কথা বলেছিলাম। তাছাড়া ঘরের কাজ মিটিয়ে অফিস করে এসব নাচ করার সময় পাবে?
– কিন্তু ওটা যে আমার ইচ্ছে…. তাছাড়া বাবার সামর্থ্য ছিল না। তোমার তো আছে, আমারও আছে।
– কি হবে ঐ নাচ শিখে?
– কেন? আমি কত নাচের মুদ্রা শিখতে পারবো, কত নাচ শিখতে পারব… তোমার আপত্তি?
– নাচের মুদ্রা কি আর মুদ্রার আগমন ঘটাবে? আমি তোমার চাকরি দেখে সম্বন্ধ এনেছিলাম। ওসব নাচ-টাচ ভুলে যাও। তাছাড়া তুমি তো আর মমতা শঙ্কর নও….
এক লহমায় সবটা যেন শেষ হয়ে গেল। শুধু ভাবছে- আমার চাকরিকে, আমার টাকাকে ভালোবাসে? বিয়ের আগের সব প্রতিশ্রুতি মিথ্যে ছিল?
অফিস না গিয়ে সোজা বাবার কাছে গেল অনু, সবটা খুলে বললো। বাবা হয়ে মেয়েকে কিভাবে বলবে সংসার ভেঙে চলে আসতে? বলল- “আর কোনো উপায় নেই? তাহলে নাচটা নাহয় বাদই….” “চুপ করো বাবা। তুমিও? তুমিও সেই একই কথা বলছ? আজ আমি স্বাবলম্বী। নিজের খরচ চালিয়ে নাচ শেখার ক্ষমতা আমার নিজেরই আছে। আমি তো শুধু পাশে থাকার মানুষ খুঁজছিলাম। কি চাইছো? সংসার বাঁচাবো? ওটা কি কোনো সংসার যেখানে আমার ইচ্ছেটাকে পায়ে পিষে মারা হয়, যেখানে কেউ আমাকে না… আমার টাকাকে ভালোবাসে? ওটা সংসার না। ওটা অন্যকিছু।” নিজের সিদ্ধান্ত জানায় অনু। আর ফিরবে না ঐ বাড়িতে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করে তবেই দাঁড়াবে অজয়ের সামনে।
অনুর নাচের দক্ষতা ওকে খুব তাড়াতাড়ি ওপরে উঠিয়ে দিচ্ছিল।
দু’বছর পরের কথা। একটা ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কম্পিটিশন হয়। সেখানে অনু সেকেন্ড পজিশন পায়। তারপর থেকেই ওর নাচের কেরিয়ার শুরু। না, নাচটাকে পেশা করেনি অনু। বরং বিনামূল্যে নাচ শেখায় আজ। অনুর জায়গাটাই এখন অন্যরকম।
রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ সেই পরিচিত পুরোনো নম্বর থেকে ফোন।
– হ্যালো, অজয় বলছি।
– হুম্ বলো।
– কাল দেখা করবে একবার?
– কেন?
-কথা আছে কিছু। আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারছি।
– যাক শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে তবে। তবে কাল না, আগামী ২ তারিখ। ঐ কফিশপে যেখানে প্রথম দেখা করেছিলাম।
– আচ্ছা বেশ। আর… থ্যাংকস আমাকে বোঝার জন্য।
– ঠিক আছে। রাখি। গুড নাইট।
-হুম গুড নাইট।
২ তারিখ আবার দেখা হল সেই আইনত স্বামী-স্ত্রীর। টেবিলে বসে কথা বলছে। হঠাৎ একটা খাম বের করে দিল অনু। অজয় খামটা খুলে নির্বাক। হ্যাঁ…. ডিভোর্স পেপার। যে অজয় কোনোদিন ওর শখের দাম না দিয়ে শুধু টাকা চেয়েছে, সেইইই অজয় আজ নাচের “সেই মুদ্রার” লোভেই যে আবার ফিরে আসেনি তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? জীবনে একবার করা ভুলটাকে দ্বিতীয়বার আপন করতে চায়নি অনু। শুধু একটা কথাই বললো অনু- “তুমি বলেছিলে না নাচ শিখে কি হবে? আমি অনেক কিছু পেয়েছি এই নাচ থেকে। তোমার মত বিষাক্ত কীটদের চিনতে পেরেছি যারা নাচের মুদ্রার সাথে ব্যাবসায়িক মুদ্রার তফাৎটুকু বোঝে না। তোমার সাথে বিয়ে নামক পুতুল খেলাটা আজ নাহয় ভেঙেই দিলাম। আমি আমার যোগ্য মর্যাদা পেয়েছি যেটা তুমি আমায় কোনোদিন দিতে পারতে না।”
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই একটা মেয়ে এসে অনুকে প্রণাম করে বলল-“ম্যাম আমি ঐ কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছি।” অনু অজয়ের দিকে তাকিয়ে বললো- সন্মানটাও পেয়েছি।
গল্পের অনু যা পেরেছে , বাস্তবে সব অনুদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ থাকেনা তাই এ গল্প টা যে সব অনুরা পড়বেন তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া র সময় এই গল্প টা মনে রাখতে অনুরোধ রইল। সীমা চন্দ্র।
সংসার না ভেঙ্গেও নিজেকে প্রমান করা যায়, মনের জোর টাই আসল | মেয়েদের যে কোনোরকম অগ্রগতির পথে বাধা আসবেই, সবার আগে স্বামীর কাছ থেকে, তারপর নিজের বাবা বা মায়ের কাছ থেকে, তাহলে তো কারো সঙ্গেই সম্পর্ক রাখা চলে না | সেই জীবনের সাফল্যে সার্থকতা কোথায়?
শুধু সহ্য শক্তি আর মনের জোরে সাফল্য আসে, আসতে বাধ্য |