Site icon আলাপী মন

প্রতিবেদন- বৃত্তি প্রবৃত্তি প্রভৃতি

বৃত্তি প্রবৃত্তি প্রভৃতি
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

আবেদন:- না পড়ে অকারণ মতামত বা লাইক দেবার প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ।

পৃথিবীর প্রাচীনতম কালে, যখন বর্ণাশ্রম সৃষ্টি হয়নি, সেই কালে মানুষের কিছু কাজকে বৃত্তি হিসাবে বিবেচিত করা হতো।
যেমন- কিরাত বৃত্তি, দস্যুবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি এবং ভিক্ষাবৃত্তি। এগুলিই হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃত্তি।
লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, এই পাঁচ বৃত্তির মধ্যে বেশ্যাবৃত্তি এবং ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে অসহায় অবস্থা অবস্থান করছে।
চৌর্যবৃত্তির মধ্যে ধূর্ততা, দস্যুবৃত্তির মধ্যে নিষ্ঠুরতা এবং কিরাত বৃত্তির মধ্যে বীরত্ব বা সাহসীকতা ( কিরাত/ ব্যাধ বা শিকারী)।
সেই অতি প্রাচীন কালে, এই পাঁচ প্রকার বৃত্তি ভিন্ন, অন্য কোনও রকম বৃত্তি বা জীবনধারণের উপায় তাদের জানা ছিল না।

কালক্রমে চাষাবাদ, পশুপালন ইত্যাদি দ্বারা তারা সমাজবদ্ধ জীবনধারার প্রচলন করে, এবং স্বাভাবিক ভাবেই প্রবর্তিত হয় সামাজিক নিয়মানুবর্তিতা। বর্ণাশ্রম এই নিয়মানুবর্তিতার একটি অঙ্গ।

আজকের এই অতি আধুনিক যুগে, আবারও যদি ভালো করে লক্ষ্য করা যায়, দেখা যাবে, একমাত্র শিকারী বা কিরাত বৃত্তি আইনত নিষিদ্ধ (যদিও চোরা শিকারী রমরমা)। বাকি চারপ্রকার বৃত্তি কিন্তু স্বমহিমায় উজ্জ্বল। যদিও তাদের রূপভেদ রঙভেদ ঘটেছে বিস্তর।
কীরকম?
ধরা পড়লে তবে চোর, নইলে সব ব্যাটাই সাধু। একসময় পুকুর চুরির কথা শোনা যেতো, এখন তো আকাশ পাতাল নদী পাহাড় সমুদ্র সবকিছুই চুরি যাচ্ছে (উচ্চস্তরীয় কান্ড)।
ডাকাতি তো ডাংগুলি খেলার মতোই একটা বালক সুলভ চপলতা। থোড়াই কেয়ার।
সাধারণ ভাবে অসামাজিক কাজ রোধ করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সেই কাজে কতখানি কর্তব্যপরায়ণ সে বিষয়ে মানুষের মনে সন্দেহের অবকাশ আছে।
অবশ্যই এই প্রতিক্রিয়ার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।
ইদানিং তো এমন অবস্থা যে, পুলিশকে রক্ষা করতে, পুলিশ রক্ষাবাহিনী গঠনের শীঘ্র প্রয়োজন। নইলে বেচারিরা লুপ্ত জাতিতে পরিণত হয়ে মিউজিয়াম আর ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে।

বেশ্যাবৃত্তি। এটা যে কোন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে, সে কথা কারও জানতে বাকি নেই।
একসময় যে বৃত্তি শুধুমাত্র নিরুপায়, অসহায় অবস্থায় কেউ কেউ অনিচ্ছায় গ্রহণ করতে বাধ্য হতো,
আজ তা অতি উচ্চ আকাঙ্খা আর লালসার কারণে বিকিকিনির মূল্যবান পসরা হয়ে উঠেছে। প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন। আগে এর একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। বাংলার বাবুকালচার এবং তার পরবর্তী সময়েও, কয়েকটি বিশেষ পল্লী পরিবেশে এদের পরিসর সীমিত ছিল। আধুনিকতার অনলাইন সিস্টেম, সমস্ত প্রাচীর চুরমার করে দিয়েছে।
বহু বিউটি পার্লার, স্পা, মাসাজ পার্লারের আড়ালে রমরমা দেহ ব্যবসা। এছাড়াও হোটেল, রিসর্ট ইত্যাদি তো আছেই। আছে তথাকথিত নাইট পার্টি। মাখন শ্রেণীর ফুর্তি আলয়। আগেও ছিল, এখন শুধু আদল বদল।

বাকি রইলো ভিক্ষাবৃত্তি।
গুরুকুলের সময় কালে, আশ্রমিক শিক্ষার্থীদের ভিক্ষান্নে ক্ষুন্নি নিবারণ অনিবার্য ছিল। কৃচ্ছসাধন ছিল শিক্ষার অঙ্গ, তাই এই ব্যাবস্থার প্রচলন। রাজপুত্র কিংবা কোটালপুত্র এখানে বিবেচিত হতো না। শিক্ষার্থীই ছিল তাদের একমাত্র ভেদহীন পরিচয়।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসীগণ, ভিক্ষু নামে পরিচিত ছিলেন। বৌদ্ধভিক্ষু। “ভিক্ষা অন্নে বাঁচাইবো বসুধা।”

বৈষ্ণব সেবায় নিয়োজিত ভক্তগোষ্ঠী, ভিক্ষায় সংগৃহীত অন্ন গ্রহণ করতেন কিংবা আজও কেউ কেউ সেই প্রথার প্রতি অটল বিশ্বাস হেতু ভিক্ষান্ন সেবা করেন।
হিন্দু সাধু কিংবা মুসলমান ফকির দরবেশ গন, গৃহস্থের বাড়িতে এসে ভিক্ষা গ্রহণ করতেন। গৃহস্থেরা এই সাধু, ফকিরদের সেবা করা, অতি পুণ্যকর্ম জ্ঞান করতেন।
সন্ন্যাসী, ফকিরকে ভিক্ষা না দেওয়া, তারা গৃহস্থের অকল্যাণ বিবেচনা করতেন।
এই প্রথা ছিল, একপ্রকার বিশুদ্ধ ধর্মাচারণ। কোনও তঞ্চকতা এবিষয়ে স্থান পেত না।

আজকের অতি আধুনিকতায় মোড়া যুগে, ভিক্ষাবৃত্তি এক আশ্চর্য শিল্পকলায় পর্যবসিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। ভাড়া করা শিশু কোলে, কৃত্রিম অভাগী মায়ের অভিনয়ে বিগলিত হয়ে, কেউ কেউ পকেটে কয়েনের খোঁজ করেন।
দাতা বিশ্বাস করেন তার এই অমূল্য এক বা দু’টাকার কয়েন, তাকে মহা পুণ্যবাণ হতে বিপুল সাহায্য করবে। কিন্তু তিনি একবারও ভেবে দেখলেন না, তার এই অকারণ নিষ্ফল দান, সেই মানুষটিকে কর্ম বিমুখতার দিকে একধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে,
“অন্ধ কানাই গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে….. আজকের যুগে শুধু বেমানান নয়, সমাজের লজ্জাও বটে।
স্বামীজি তাই বলেছিলেন, ভিক্ষা, মানুষের অলসতার প্রকাশ। তাকে উৎসাহ দান করে কর্মবিমুখ হতে সাহায্য করা মহা অন্যায়।

অবশ্য, পাশাপাশি বলে রাখা ভালো- যারা সত্যিই নিতান্ত অপারগ, হীনবল ভগ্নদেহ, যারা অকৃত্রিম ভাবে অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকে জীবন ধারণে অক্ষম। তাদের ভিক্ষা নয়। মননশীল সহযোগিতা এবং উপযুক্ত সাহায্য সহকারে সম্মান যুক্ত বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করা, অবশ্যই পুণ্যের কাজ।

Exit mobile version