Site icon আলাপী মন

গল্প- সন্ধ্যায় অস্ত চন্দ্রিমার

সন্ধ্যায় অস্ত চন্দ্রিমার
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

আমি আর শুভ গোধুলির রঙ মেখে সমুদ্র তট থেকে বাড়ি ফিরছি।
সমুদ্রের গর্জন ও উত্তাল ঢেউয়ের মোহে মন এখনও মাতাল হয়ে আছে। সুরা পান না করেও মাতাল হওয়া যায়। তা আজ জানলাম।
আমার অগোছালো চুলে বালির কণা এখনও জাপটে রেখেছে। বালুর রাশি রাশি কণা আমার ঘন কালো কেশ রাশির মোহে আছন্ন হয়ে আছে।
শুভ তো হেসে খুন আমার কথা শুনে,
-যা কেশ তোমার টানলেই এক গোছো হাতে চলে আসবে । এক গোছা কেশ নিয়ে বললাম, চললাম..

ড্রাইভার ছোকরাটা ফিক করে হেসে উঠলো।শুভর কথা শুনে।
আমি মুখ বেঁকিয়ে টাটা সুমোর জানলার কাঁচ নামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
শুভ কি জানে! আমার চুলের তারিফ করতো কলেজে পড়ার সময় ডজন খানিক ছেলে।
একেই মন খারাপ তার মধ্যে শুভটা যা..তা একটা।

ফিরতে মন চায় না একদম। চোখ বন্ধ করলে দীঘার সমুদ্রর ঢেউ যেন চোখের সামনে এসে আছড়ে পড়ছে।
ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা। টাটাসুমো চলছে দুর্বার গতিতে। হঠাৎ টাটাসুমোর ড্রাইভার ব্রেক কষলো সজোরে। আমি সামনের দিকে ঝুঁকে গেলাম।
শুভ ও ড্রাইভার তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। নেমে গেলাম আমিও। মেয়েটার মাথায় সামান্য চোট লেগেছে। বড় দুর্ঘটনার হাত হতে বেঁচে গেছে।
ড্রাইভার বললেন,
বড় জ্বালাতন করে এই পাগলিটা। সন্ধ্যা হলেই রাস্তাতে নেমে পড়ে।
-আপনি চেনেন একে?
-হ্যাঁ এখানকার সবাই চেনে ওকে।

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে রুবী এখন পাগলি হয়ে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে। সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় চলে আসে। গাড়ির চালকদের জিজ্ঞাসা করে টোটনকে দেখলে না কি? কিছু খেয়েছে ও না কি কান্না করছে আমার বাচ্চাটা?
-সময় মতো ব্রেক না কষলে বিপদ হয়ে যেত..কি হয়েছিল টোটনের?
-টোটনের পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করছিল সেই রাতে রুবি। অনেক বাচ্চা এসেছিল ওদের ঘরে। রুবি রাঁধুনির কাজ করে। স্বামী অন্য মহিলার সাথে থাকে। রুবির জীবন টোটন। কেক কাটার সময় রুবি ‘টোটন.. টোটন’ করে ডেকে কোনো সাড়া পেল না। আট দশটা বাচ্চা আছে কিন্তু টোটন নেই। খোঁজ চললো রাতভর। পুলিশকে জানানো হল কিন্তু টোটন আজও নিরুদ্দেশ। এক বছর হয়ে গেল। রুবি খুঁজে বেড়ায় টোটনকে আজও..
-আহা বেচারি ছেলেকে না পেয়ে পাগল হয়ে গেল।

টাটাসুমো চলছে হঠাৎ গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেল। কোলাঘাটের একটু আগে। ধাবায় বসে শুভ আমি চা খাচ্ছি।
শুভ..শুভ…
– আরে ঐ দেখ, খোকনের মা জেঠিমা এই দিকে আসছে।
– এই সময় জেঠিমা এখানে কি করছে?

আমার শ্বশুর বাড়ির পেছন দিকটাতে জেঠিমা থাকেন। জেঠিমার একটি মাত্র ছেলে খোকন। শুভর বন্ধু খোকন।
কিন্তু আলুথালু বেশে, কেমন যেন মনমরা হয়ে আছে জেঠিমা ।
-কোথায় যাচ্ছো জেঠিমা? বলতেই জেঠিমা কেঁদে অস্থির হয়ে গেলো।
দু’টো পুলিশ তৎক্ষণাৎ এসে জেঠিমাকে বললো, চলুন জিপে উঠুন।
আমি বললাম- কি হয়েছে অফিসার? ইনি আমাদের জেঠিমা আপনারা যান জেঠিমাকে আমারা বাড়ি নিয়ে যাবো।
-না না উনি বৃদ্ধাশ্রম থেকে পালিয়ে এসেছেন।
-মানে? কি বলতে চাইছেন, ওনার ছেলে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছে! ইমপসিবল.. হতেই পারে না। ওনাদের পরিবারকে আমরা ভালো ভাবে জানি। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আপনাদের।
শুভ বললো, জেঠিমা চিন্তা করো না। আমরা আছি। কোনও ভয় নেই তোমার। কি হয়েছে বলো?

জেঠিমা বলতে লাগলো, তোমরা দীঘায় বেড়াতে গেলে যেদিন। সেই রাতেই ওরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছে। বৌমা তো আমার মেয়ে, খোকন তো আমি না খেলে খাবারটাও খায় না, কি হলো ওদের জানতে হবে আমাকে?
তাই পালিয়েছি আমি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। চারদিন বহু কষ্ট করে ছিলাম। আজ সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না রে।

পুলিশ অফিসার বললেন, আমাদের তো কাজ করতেই হবে। চলুন আমাদের সাথে।

শুভ বললো, জেঠিমা তুমি যাও আমি তোমাকে কাল সকালে গিয়ে নিয়ে আসব।চিন্তা করো না। খোকন তোমাকে থাকতে না দিক আমার কাছে থাকবে তুমি। তুমি যাও।কিছু ফরমালিটিস আছে সে সব করে তোমাকে আনতে যাব কাল সকালে।

খোকন তো এমন ছেলে না। প্রাণ থাকতে জেঠিমাকে ও আলাদা করতে পারবে না। কি এমন হল। দীঘায় বেড়াতে গেলাম কতো আনন্দ করলাম ফেরার সময় এই দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য!
পুলিশ অফিসার জেঠিমাকে ভ্যানে করে নিয়ে গেল।
শুভ আমি ধাবায় বসে রইলাম ঘন্টা খানেক।

একই দিনের একই সন্ধ্যায় দু৬টো পৃথক ঘটনা মনকে নাড়া দিয়ে গেল।
এক মা নিখোঁজ ছেলেকে পাওয়ার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে চলন্ত গাড়ির সামনে চলে আসে, যদি খবর পাওয়া যায় ছেলের..

আর এক মা ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্য ছেলের দেওয়া বাসস্থান থেকে পালিয়ে ছেলের কাছে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে।
এক ঘন্টা হয়ে গেল। মধুর সন্ধ্যা আমাদের বিরাট ভাবনার চাদরে মুড়ে দিল।

বাড়ি পৌছে খোকনের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমি ও শুভ। কিন্তু খোকন আর চন্দ্রিমা বাড়িতে নেই। তালা ঝুলছে গেটে।
মস্তি করছে হয়তো মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে।
চাই না,ৎছেলে সন্তান চাই না..
-আহ্ মিঠু হচ্ছেটা কি চুপ করো।
– না না.. মেনে নিতে পারছি না। তুমিই তো বলেছিলে জেঠিমা কতো কষ্ট করে খোকনকে মানুষ করেছে। দিনের পর দিন উপোসী থেকে খোকনকে লেখা পড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শেষে এই পুরস্কার পেল সন্তানের থেকে অভাগী মা। বাড়িটা তো ওর বাবার। স্ত্রীর অধিকার নিয়ে জেঠিমা থাকবে। তুমি কাল সকালেই জেঠিমাকে নিয়ে আসবে। তারপর দেখছি আমিও..

রাত হল অনেক.. খোকনরা এখনও ফিরলো না। শুভকে কথা বলতেই হবে। খানিক পর ভোর হবে। জেঠিমা হয়তো সারা রাত জেগে ভোরের অপেক্ষা করবে এই ভেবে, শুভ নিশ্চয়ই আসবে..
কিন্তু খোকন! খোকন তো এখনও এলো না
অনেক কষ্টে দুচোখের পাতা এক হল। ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা।

“সকলি তোমার ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি ,তোমার কর্ম তুমি করো মা লোকে বলে করি আমি”
রোজ সকালে সামনের বাড়ির চক্রবর্তী কাকু গঙ্গা স্নান সেরে এই গানটা করতে করতে বাড়ি ফেরেন। কাকুর কণ্ঠে
মায়ের গান শুনে ঘুম ভেঙে গেল আজও।
ঘুম থেকে উঠে খোকনের বাড়ির দিকে আগেই নজর পড়ল শুভর।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ঘরে আছে ও।
শুভ আমাকে নিয়ে গেল ওর বাড়িতে। খোকনকে ডাকতেই দরজা খুলে, খোকন বললো, কবে এলি তোরা?
– জেঠিমাকে ডাক তো..
-মা এখানে থাকে না‌।
-থাকে না? না কি এই বাড়িতে জায়গা হয়নি জেঠিমার। চন্দ্রিমাকে ডাক দরকার আছে।
– ও নেই এখানে,
– কোথায় গেল এতো সকালে চন্দ্রিমা?
-সে তোকে জানতে হবে না.. কেমন ঘুরলি সেটা বল?

এর মধ্যে খোকনের মোবাইল বেজে উঠলো।
‘হ্যালো’ বলেই চুপ হয়ে গেল খোকন।
ফোনটা রেখে খোকন বললো, তোরা এখন যা। আমি অফিস যাব। রাতে কথা হবে।
আমরা কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে এলাম।

ঠিক সকাল সাতটার মধ্যে রওনা হলাম
আমরা। পুলিশের দেওয়া ঠিকানায় বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার জন্য, জেঠিমাকে আনতে।

“ঠাঁই ঘর” বৃদ্ধাশ্রমের অফিস রুমে বসে আছি আমরা দশ মিনিট মতো, এর মধ্যে ম্যানেজার এসে আমাদের কথা শুনলেন।জেঠিমাকে আমরা বাড়ি নিয়ে যাবোই।
ম্যানেজার বললেন, অসম্ভব কোনও মতেই এটা করা যাবে না।

-কেন সম্ভব না স্যার? আমরা দায়িত্ব নিয়ে সবটাই করবো।
– দেখুন,ওনার ছেলে মিস্টার অভিজিত একমাসের জন্য ওনার মাকে রেখে গেছেন এখানে। আমরা কিছুই করতে পারব না,
স্যরি..
-একমাস,এরকম-টাও হয় না কি বৃদ্ধাশ্রমে?
যতদিন বাঁচবে ততদিন তো..

-আহ, ,চুপ করো না, শুভ আমাকে থামিয়ে বললো,
-স্যার, আমরা বেড়াতে গেছিলাম তাই সবটা জানি না যদি খুলে বলেন সবটা, কথা দিচ্ছি গোপন রাখব পুরো ব্যাপারটা।

– অভিজিত বাবুর স্ত্রীর দু’টো কিডনিই ড্যামেজ। লাস্ট স্টেজ এখন, ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে, এক সপ্তাহ মতো….
সুলতা দেবী এই শোক সহ্য করতে পারবেন না। ঘরের লক্ষ্মীকে বিদায় দিতে পারবেন না তিনি। তাই একমাস মতো তিনি এখানে থাকবেন, তারপর যা হবে, ভগবান জানেন।

ও গড, খোকন তুই আমাকে বললিনা কেন !
শুভ আর আমি বাড়ি ফিরলাম। খোকনের ঘরের দরজা তালা ঝুলছে না, তার মানে ও এখন ঘরে আছে। গেলাম ওর ঘরে, খোকন.. খোকন বাজে ছেলে তুই, বলেই শুভ খোকনকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
চন্দ্রিমা বললো,কেমন ঘুরলে তোমরা? সমুদ্র, ঢেউ বেশ লাগে তাই না, রাতের সমুদ্র খুব সুন্দর তাই না!

আমি বললাম, কি হাল হয়েছে তোমার চন্দ্রিমা!
-মৃত্যু পথ যাত্রী ভাই, ডাক্তার বাবু বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন তাই। একবার মাকে নিয়ে এসো দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। মা যে খুব ভালোবাসে আমাকে, খুব ভালোবাসে..

আমি ওদের ঘরে আর থাকতে পারলাম না। আমার ঘরে চলে এলাম। খাওয়া দাওয়া কিছুই হল না আমাদের। অপেক্ষা যেন কিসের! দুপুর থেকেই মনটা খুব চঞ্চল আমার।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, আমরা খোকনের ঘরে গেলাম। খোকন খাটের পায়া ধরে বসে আছে চন্দ্রিমা ঘুমোচ্ছে শান্তিতে..

এ কোন সন্ধ্যা? আমরা তো এই সন্ধ্যা চাইনি কখনও।
গান, গল্প, হাসিতে- আড্ডাতে আমাদের সন্ধ্যা কাটতো, আজ বেমানান আমার কাছে এই সন্ধ্যা। টেনে হিঁচড়ে অধরা সময়কে আমি বইতে পারব না। জেঠিমার জন্য মনটা কাঁদছে। শেষ দেখা দেখতে পেল না মেয়ের।
মেয়ে তথা বৌমার খাটের সামনে ধুপ জ্বলছে আর জেঠিমা হয়তো ধুপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছে,আমার ছেলে বৌমার মঙ্গল করো। দীর্ঘায়ু করো ওদের…
ভবিতব্যর কাছে আমরা যে অসহায়।
বড় অসহায়- তাই তো সন্ধ্যা বেলায় চন্দ্রিমা অস্ত যায়…

Exit mobile version