গল্প- অসমাপ্ত

অসমাপ্ত
-সৃজিতা ধর

– আজ ফিরতে অনেকটা দেরী হয়ে গেল। আসলে ফিরতে গিয়ে গাড়িটা…বিপ্লবকে আর বাঁচাতে পারলাম না, জানো তো! বড্ড ভালো ছিল ছেলেটা।
– কি! কি বললে!
– ওমা, তুমি ‘এভাবে’ কাঁদছো কেন!

সদ্য স্বামীহারা হতে যাওয়া মনোরমা দেবী যেন আরেকবার নতুন জীবন পেলেন। অবনীমোহন বাবুর মৃত্যু সংবাদটা তাহলে বোধ হয় ভুল ছিল। পাশের বাড়ির রমেশবাবু এই ভুল খবরটি দিয়েছিলেন মনোরমা দেবীকে। অর্ধেক খবর শুনে তাৎক্ষণিক গল্পকার হয়ে যাওয়াটা কিছু মানুষের স্বভাবগত ত্রুটি। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ মুছে মনোরমা দেবী অবনীবাবুকে ভুল খবর শোনার কথাটি জানায়। কাছে গিয়ে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে ওনার কখনো না ছেড়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেন।
সেই রাতে কেউই খায়নি কিছু। ভোরের দিকে ওনাদের ছেলে সুজয় এসে দরজায় কড়া নাড়ল। ভেতরে এসে জিজ্ঞাসা করছে যে মনোরমা দেবী কিছু খাবেন‌‌ কিনা। স্বামী কিচ্ছু খায়নি, আর উনি খেয়ে নেবেন…তাই ছেলেকে না খাওয়ার কারণটা বললেন দরজার কাছে গিয়ে। সুজয় পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঘাড় নাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। মনোরমা দেবী চাদরটা অবনীবাবুর বুক অবধি টেনে দিলেন। পাশে শুয়ে বারবার এপাশ-ওপাশ করছেন কিন্তু ঘুমটা আর আসছে না। স্বামী হারানোর ভয়টা খানিক বাদে বাদেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অতএব, খানিকটা বাধ্য হয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে ছাদে‌ চলে গেলেন। ঠান্ডা হাওয়াটা বেশ ভালো লাগছে। শরীরে যে ম্যাজম্যাজে ভাবটা ছিল সেটা অনেকংশেই কমে‌ আসছে। কিছুক্ষণ পর নীচে নেমে দেখলেন অবনীবাবু ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন আর হাতে খাতা-পেন।
– বুঝলে গিন্নি, গল্পটা সম্পূর্ণ হয়নি। মনটাও‌ ভালো নেই। গল্পটা নিয়েই থাকি আপাতত। কি বলো?
– ও…সেই গল্পটা! আচ্ছা লেখো। তবে একটানা বেশিক্ষণ লিখে আমায় আবার ঘাড়ে মালিশের কথা বলো না যেন!
– হাসালে। না, না বলব না তোমায়। একটু চা করে দাও না…ফ্রেশ হয়ে যাবে মাইন্ডটা।

মনোরমা দেবী গেলেন চা‌ করতে। দু’কাপ চা করে নিয়ে আসার সময় সুজয় একটা কাপ নিতে যাচ্ছিল। উনি বললেন- তোর চা ফ্লাস্কে রাখা আছে। একটু নিয়ে নিস বাবা। আজ তোর বাবার সাথে চা খেতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
বিকেলের দিকে অবনীবাবু আর মনোরমা দেবী বেরোলেন একটু পাড়াটা হেঁটে আসার জন্য। প্রতিদিনেরই অভ্যাস। ফুচকা দেখতে পেয়ে ফুচকাও খেলেন। তারপর পাড়ার একটা পার্কের বেঞ্চে বসে দু’জনে‌ গল্প করছেন। তাদের বিয়ের গল্প, প্রথম প্রথম প্রেমের আব্দারগুলো…এইসব গল্পের মাঝে হারিয়ে গেলেন দুই প্রবীণ। অবনীবাবুর চোখে আজ একটু বেশিই মায়া। একজন‌‌ বেলুনওয়ালা রঙ-বেরঙের বেলুন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটা হার্ট শেপের বেলুন স্ত্রীকে দিয়ে বললেন- এই নাও তোমায় হৃদয় দিলাম।
– আজ প্রথম দিলে বুঝি!
– হ্যাঁ।
– মানে?
– তোমার প্রেমে যে রোজ পড়ি…
– থাক্ হয়েছে। সবাই শুনবে যে!

দু’জনে এবার বেঞ্চ ছেড়ে উঠে বাড়ি ফিরছেন। ওঠার সময় খোঁচা লেগে বেলুনটা ফেটে গেছিল যদিও। অগত্যা মন খারাপ করেই বাড়ি ফিরলেন মনোরমা দেবী। ঘরে ঢুকতেই দেখেন এক ভদ্রলোক মাঝের ঘরে সোফায় বসে আছেন। সুজয় আলাপ করাতে যাওয়ার আগেই মনোরমা দেবী বললেন- আমি যাই ওপরের ঘরে। তোর বাবা বোধ হয় ঐ দিকেই গেলেন। ওনার লেখা বইটা খুঁজছিলেন কিন্তু পাচ্ছিলেন না। এখনও বোধ হয় ওটাই খুঁজতে গেলেন। আমি গিয়ে খুঁজে দিয়ে আসি। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ঐ‌ ভদ্রলোক সুজয়ের বন্ধুর দাদা, ড. অনিমেষ রায… সুজয়ের ডাকে আজ‌ এসেছেন।
মনোরমা দেবী অবশেষে খুঁজে ‌পেলেন‌ বইটা। অবনীবাবুর হাতে দিয়ে পাশে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। অবনীবাবু ওনার নির্দিষ্ট আরাম কেদারাটিতে বসে বইটা উল্টে-পাল্টে দেখছেন। উনি বাংলার প্রফেসর ছিলেন। এককালে প্রচুর গল্পও লিখতেন। ওনার গল্প সমগ্রের একটা বইও বেরিয়েছিল। তবে একটা গল্প তিনি তিন-চিরদিন ধরে লিখছিলেন। সেটা এখনও শেষ হয়নি। গল্পের নাম নির্বাচনও হয়নি। মনোরমা দেবী গল্পটা নিজে‌ নিয়ে পড়লেন। উনিও সাহিত্যে‌ কম কিছু নন। অবনীবাবু বসার জায়গা ছেড়ে উঠে সারা ঘর পায়চারি করছেন। মনোরমা দেবী একগ্লাস জল‌‌ নিয়ে অবনীবাবুকে দিয়ে বললেন- জল খেয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করো। তারপর ঠিক লিখতে পারবে। অবনীবাবু নীচের ঘর থেকে কি একটা আনবেন বলে নীচে গেলেন।
সুজয় আর ড. অনিমেষ রায় দরজা দিয়ে দেখছিল পুরো বিষয়টা। সুজয় বললো- এবারই ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দাও দাদা।
– হ্যাঁ, আমি গিয়ে কথা বলি, তুমি এসো।
ড. অনিমেষ মনোরমা দেবীর সামনে গিয়ে কথা বলে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। হঠাৎ পেছন‌ থেকে সুজয় এসে মাকে শক্ত করে ধরলো। ইঞ্জেকশনটা পুশ করার সময় মনোরমা দেবী বলে উঠলেন- ওই তো…ওই তো… তোর বাবা…দেখো না কিসব করছে ওরা…। বলতে বলতেই চোখটা বুজে আসছে। ওরা তাকিয়ে দেখে দরজার কাছে কেউই নেই। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ধাক্কা লেগে আরাম কেদারাটা দুলতে শুরু করলো, পাশে গল্পের খাতাটাও পড়ে আছে। সুজয় খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলো ওটা বাবার লেখা সেই অর্ধেক গল্পটা, যেটার নামকরণ মনোরমা দেবী সবেমাত্র করেছিলেন। গল্পের নাম দিয়েছেন-“অসমাপ্ত”।
“বুঝলে সুজয়, ‘সিজোফ্রেনিয়া’, সহজ ভাবে বললে হ্যালুসিনেশন। যা যা করছেন, ভাবছেন, বলছেন সেগুলোর অস্তিত্ব নেই কোনো। মেসোমশাইয়ের হঠাৎ চলে যাওয়াটা মানতে পারেননি। গতকাল খবর শোনার‌ পর থেকে তো নাকি এই ঘরেই পড়ে আছেন! উনি আসলে ওনার মত করে একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন। সেখানে তিনি স্বামীকে নিয়ে আরেকটা সাজানো সংসার পেতেছেন। এরকম সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। ওনার ঘুমটা খুব জরুরি। এখন বেশ কিছুক্ষণ ঘুমোবেন উনি। কোনো চাপ সৃষ্টি করো‌ না। শুধু নজরে নজরে রেখো। আর বাড়াবাড়ি হলে ইঞ্জেকশন…।”
-“থ্যাংকু দাদা। বাবার কাজে নিমন্ত্রণ রইল। পরে দিন আর সময়টা জানিয়ে দেব। এসো কিন্তু।”
সত্যি, কিছু কিছু গল্প ‌অসমাপ্তই থেকে যায়, চাইলেও শেষ করা যায় না। ভালো থাকুক এরকম মনোরমা-রা। বাস্তবটা বোধগম্য হলে বোধ হয় গল্পে দাড়ি‌ পড়বে। নয়ত সারাজীবন মনোরমা-রা গল্পের ইতি খোঁজায় ব্যস্ত থাকবে। সকাল হলে আবারও হয়ত মনোরমা দেবী আর অবনীবাবুর দেখা হবে। তবে কল্পনায়… নিছকই কল্পনায়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তবে কি সেটা ভালোবাসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য! কিছু কিছু সুজয়ের মনে এই প্রশ্নটা থেকেই গেল।

Loading

Leave A Comment