আতঙ্ক
– পায়েল সাহু
ঘরে ঢুকেই সৃজার খোলা ডায়েরিটার দিকে চোখ পড়ে প্রত্যুষের..ঘরে সৃজাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে পড়তে শুরু করে ডায়েরিটা,
কোথাও কোনো সম্বোধন ছাড়াই লেখা শুরু..
আমাকে বুঝতে চাও? তাহলে সমুদ্রকে দেখো….
দিগন্ত বিস্তৃত পরিধি আমার, সূর্য মুখ লুকোয় আমারই কোলে, হেসেও ওঠে আমারই পরশে। দিবা রাত্রি বালুকাবেলায় আছড়ে পড়া উত্তাল, দুরন্ত ঢেউয়ের নাচনে প্রাণ চঞ্চল, সদা হাস্যময়ী আমি….ঢেউ পার করে অতলে গভীরে গেলে শান্ত, স্থির, অপূর্ব মোহময়ী আমি…. খুঁজতে চাও? তাহলে ভয় ভীতি ফেলে এসো আমার কাছে, আর যদি না চাও তাহলে আমার বালুতটে দাঁড়িয়ে প্রাণভরানো আনন্দ নাও।
যত রাগ, দুঃখ, অভিমান, ভালোবাসা আমার সৈকতকে ঘিরে, ঐ বোঝে একমাত্র আমাকে, আমার প্রতিটি বিন্দুতে মিশে আছে আমায় ভালোবেসে…. বাকিদের জন্যে আমি ভীষণ উদাসীন, আনমনা। আপন করতে চাও আমাকে, কাউকে ফেরাই না আমি, দু’হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নি…. কিন্তু তারাই সহ্য করতে পারেনা আমার নির্ভীকতা, আমার লবনাক্ত স্বাদ…. ফিরতে চাইলেই মুহূর্তে ফেরাতে পারি আমি। ফিরিয়েও দিই। তবু তবু… তারা ফিরতে চেয়েও ফেরে না, বসে থাকে আমার সৈকতে। অবাক হয়ে উপভোগ করে আমার ঢেউয়ের উন্মাদনা, অবগাহনে তৃপ্তি উপলব্ধি করে।
আমি অতলান্ত গভীর, তল পাবে না যার.. উন্মত্ততার চরম সীমায় তোমায় নিয়ে যেতে পারি.. উচ্ছাস আনন্দে তৃপ্তি দিতে পারি..দৃষ্টিসুখের আশ্রয় হতে পারি.. শুধু আমাকে আগলাতে যেও না, আমাকে করায়ত্ত করার ভাবনা এনো না.. পারবে না। আমি শুধু বাঁধা পড়ে আছি আমার প্ৰিয় সৈকতের কাছে, যাকে পেরিয়ে আমায় ছুঁতে এলে ডুববে আচমকা, অপ্রস্তুত তোমার মুষ্টির ফাঁক দিয়ে নিমেষে গলে পড়বে সে… যে শুধু মিশে আছে আমার সাথে, একমাত্র সেই আমার অতল গভীর স্পর্শ করেছে.. মিশেছে আমাতে।
ঐ যে বিশাল নীলিমা, ওর রূপে আমি মুগ্ধ…. সারাদিন ওর দিকে চেয়েই আনমনে কাটিয়ে দিই সারাবেলা।
আমাকে অহংকারী ভাবছো? ভাবতেই পারো। তবে জেনো ভুল ভাবছো, আমি আত্মমগ্ন থাকতেই ভালোবাসি, নিজেকেই নিয়ে মত্ত থাকতে পছন্দ করি। ভাবছো আঘাত করবে আমায়? করতেই পারো, তবে সে আঘাত আমার লাগবে না, কারণ তুমি যে আমায় ছুঁতেই পারো না, তোমার আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় আমার নোনা জলের খানিক অবশ্যই ভেজাবে তোমাকে…
নোনা জলের আঘাত আরামপ্রদ নয় জানো নিশ্চয়ই?
জল ভেবে আমাকে পাত্রে বন্দি করবে ভেবেছ? চেষ্টা করতেই পারো, তবে ব্যবহার করতে পারবে না আমায়।
যে নদীরা ছুটে এসে মেলে আমার মাঝে, আপন করে নিয়ে তাদের রাখি আমার কাছে, সে আসে স্বেচ্ছায় আসে, ভুল করেও যাই না আমি তাদের ধারায় মিলতে, আশ্রয় দিই বুকের গভীরে তাদের আমি, গড়ে নি নিজের মতো ঢঙে।
কি ভাবছো…. বিরাট শক্তিশালী আমি? তা ভাবতেই পারো, সুনামি আনতে পারি যখন তখন।
দূরেই থাকো বরং, মাঝে মাঝে এসে দেখে যেও, তোমার ভালোবাসার পথের অপেক্ষা করবো আমি। শুধু করায়ত্ত করার ভুল কখনো করোনা। পথ হারাবে অযথা..
সৃজার ফেলে রাখা ডায়েরি আর এই কথাগুলো কি আমার জন্যই রাখা? ভাবতে চেষ্টা করে প্রত্যুষ
আজ সকালে অফিস যাওয়ার আগেও সৃজার সঙ্গে প্রচন্ড ঝগড়া করেছে, তারপর বেরিয়ে গেছে না খেয়েই। সৃজার এই লেখালেখির চাকরিটা আর সহ্য হচ্ছে না
প্রত্যুষের, ঐ তো কটা টাকা মাইনে, কি এমন রহস্য আছে যে কিছুতেই ঐ চাকরিটা ছাড়তে চাইছে না? কলেজ স্ট্রিটের অফিসটায় গিয়ে দেখেও এসেছে সে, নামেই অফিস, যেন আস্ত একটা গুদাম ঘর, অজস্র বই পত্রে ঠাসা, সৃজা আর দুটি ছেলে মেয়ে সংশোধন চলেছে রাতদিন সমস্ত নামী লেখক লেখিকাদের পান্ডুলিপি। কি এমন উৎসাহ পায় কে জানে। নাকি প্রত্যুষ নিজে রিপোর্টারের চাকরি করতে করতে একটু বেশি সন্দেহজনক হয়ে পড়েছে? ভাবার চেষ্টা করে নিজেই।
সৃজার ডায়েরিটা নিয়ে আরো একবার পড়ার চেষ্টা করে, আচ্ছা সৈকত কে? সৃজার সঙ্গে কাজ করা ছেলেটা নাকি? আচ্ছা ওদের তবে প্রেম চলছে? আর এই নীলিমা নামটা মানে ঐ সৃজার সহকর্মী মেয়েটি, যে ওদের প্রেমে সাহায্য করছে?
ভয়ংকর একটা চিৎকার করে প্রত্যুষ ডাকে সৃজাকে। সাড়া না পেয়ে আরো বেশ কয়েকবার। শেষমেশ নিজেই রান্না ঘরের দিকে আসতে অবাক হয় বেশ…
রান্না ঘরের দরজা তো বন্ধ, শুধু রান্নাঘর কেন গোটা বাড়ির কোথাও নেই সৃজা, রাত দশটাতেও ফেরেনি নাকি? রাগে মাথাটা দপ দপ করতে থাকে প্রত্যুষের, বিয়ের মাত্র দু’ বছরের মাথায় সব শেষ হয়ে গেলো? ভাবতে পারেনা সে আর কিছু….
পরের সাত দিন শুধু পাগলের মত খুঁজেছে, তারপর সাহায্য নিয়েছে পুলিশের, সমস্ত রাগ একসময় আতঙ্কে পরিণত হয়েছে যে সৃজা তার ওপর রাগ করে আত্মহত্যা করলো নাকি! কিন্তু পুলিশ এসে শুধু মাত্র রান্নাঘরের জানলা ভাঙা ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারে না।
—————————————————-
এক বছর কেটে যাওয়ার পরেও সৃজার কোনো সন্ধান না পেয়ে প্রত্যুষ আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় তারই অফিস কলিগ রূপালীকে। পুরোনো অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে রূপালীকে সে বেশ খানিকটা স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে, একটি কন্যা সন্তান নিয়ে সুখী সংসার তাঁদের তবু মাঝে মাঝেই সে যেন স্বপ্ন দেখে সৃজাকে।
বৌকে স্বাধীনতা দিলেও মেয়ে তুলির ক্ষেত্রে কিন্তু অন্য রুপ প্রত্যুষের। একটু বড় হতেই মেয়েকে দার্জিলিং-এর হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলেও মেয়ে বাড়ি আসলে যেন মাঝে মাঝেই অন্য মানুষ হয়ে ওঠে প্রত্যুষ। ভীষণ রক্ষনশীল আচরণ, শাসন আর চিৎকারে কুঁকড়ে থাকে তুলি।
অদ্ভুত এই আচরণের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না রূপালী।
এই পরিস্থিতিতে আরো একবার বজ্রপাত ঘটিয়ে নায়িকা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বসে তুলি।
—————————————————-
আজ একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক ফিরোজা আত্মপ্রকাশ করবেন, যার লেখা গল্প নিয়ে এর মধ্যে বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে, যার লেখনী যুবক যুবতীদের কাছে ভীষণ প্ৰিয়, পাঠকদের চাহিদায় আজ শেষ অব্দি তিনি প্রকাশ্যে আসতে চলেছেন। প্রথম সারির অনেক সংবাদপত্রই তার সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহী, সেই কারণে প্রত্যুষকেও তার অফিস থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে।
আজ বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে তার, রূপালীর কাছে ফোনে মেয়ের কথা শুনে ইচ্ছে করছে যেন গলা টিপে মেরে ফেলে তুলিকে, ঠিক যেমন করে সৃজাকে..
আজে বাজে ভাবনা ঝেড়ে প্রত্যুষ এগিয়ে যায় সামনের দিকের আসনের জন্যে। ঘিয়ে রঙ্গের তসরের শাড়িতে লাল মোটিফের কাজ করা, এক হাতে সোনার বালা, অন্য হাতে ঘড়ি, কাঁচা পাকা চুলের লেখিকাকে দেখে মাথাটা যেন কাজ করছিলো না প্রত্যুষের, সৃজা তবে মরেনি? সেই ফিরোজা? কিভাবে সম্ভব হলো এসব? হাজার চেষ্টা করেও যার খোঁজ পায়নি প্রত্যুষ, তাকে আজ হাজার আলোর সামনে দেখে নিমেষে আঁধার নেমে আসে প্রত্যুষের চোখে, মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, মুহূর্তে মনে হয় চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু পারে না, সামলে নেয় নিজেকে, সৃজা থুড়ি আজকের ফিরোজা কিন্তু বেশ সাবলীল, যেন চিনতেই পারছেনা প্রত্যুষকে। যদিও আলাদা করে কথা বলার কোনো সুযোগ পায়না সে। আর পাঁচজন সাংবাদিকের মতোই সাধারণ কিছু প্রশ্ন সেরে ফিরে আসে বাড়ি।
একরাশ প্রশ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরে মেয়ে তুলিকে সামনে দেখে রক্ত চড়ে যায় মাথায়। হাতের কাছের ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে তেড়ে যায় তুলির দিকে, তুলিকে বাঁচাতে আসা রূপালীকে ক্ষত বিক্ষত করে তোলে মুহূর্তে, দিশাহারা তুলি প্রাণ বাঁচাতে কোনোক্রমে রাস্তায় বেরিয়ে ছুটতে থাকে আর ঠিক তখনই একটা গাড়ি এসে থামে তুলির সামনে, দরজা খুলে সৃজা শীঘ্র উঠে আসতে বলে তুলিকে। পেছনে পেছনে আসতে থাকা উন্মত্ত প্রত্যুষকে পেছনে ফেলে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায় সৃজার গাড়ি।
—————————————————-
রান্না ঘরে ঢুকে আচমকাই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রত্যুষ সৃজার ওপর, চুলের মুঠি ধরে বারবার মাথাটা ঠুকে দিতে থাকে রান্না ঘরের দেওয়ালে। সৃজার কান্না, চিৎকার কোনোটাই যেন স্পর্শ করতে পারেনা তাকে। শুধু অদ্ভুত একরকম জান্তব গলার স্বর বেরোতে থাকে প্রত্যুষের গলা দিয়ে। একসময় সৃজার মাথা ফেটে রক্ত বেরোতে দেখে তাকে ছুঁড়ে ফেলে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে চলে যায় প্রত্যুষ।
সৃজা কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়েছিল জানে না, শুধু জ্ঞান ফিরে পেয়ে সে ফোন করে তার দাদাকে, কোনোমতে সমস্ত কথা বলে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে বলে প্রত্যুষের চোখ এড়িয়ে। সৃজার দাদা কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এসে ভোর রাতে চুপিসারে রান্না ঘরের জানলা ভেঙে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সৃজাকে।
সৃজার সন্দেহটা এতদিনে সঠিক প্রমাণিত হয়, প্রত্যুষ আসলে বাই পোলার ডিসঅর্ডার রোগের স্বীকার।
বাড়ির পাশের রাস্তায় কুকুরের ভীষণ চিৎকারে বিরক্ত প্রত্যুষ তাদের তাড়াতে যায়, পরদিন সকালে দেখা যায় বেশ কিছু কুকুরের মৃতদেহ, বাড়িতে কোনো পড়শি এলে আচমকা রূঢ় ব্যবহার সৃজাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করে। যদিও কিছুক্ষণ পরেই সেসব কোনো কিছুই মনে থাকতো না প্রত্যুষের।
আর তাই প্রত্যুষের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর মৃত্যুভয় পেতে থাকে সৃজা, রাতারাতি তার থাকার সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে যায় দার্জিলিং এর একটি লেডিস হোস্টেলে। আর এখানে থেকেই জীবনটা সুন্দর একটা দিশা পায় তার। কলেজ স্ট্রিটে চাকরিটা করার সময় থেকেই বিভিন্ন লেখক লেখিকার লেখা পড়তে পড়তে সৃজাও অবসর পেলেই ডায়েরিতে লিখতো ছোটো খাটো গল্প, প্রবন্ধ। দার্জিলিং-এ এসে এখানকার একটি স্কুলে চাকরি আর বাকি অবসর সময়টা চলতে থাকে ছদ্মনামে পুরোদমে লেখা লেখি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সেসব ছাপা হতে সৃজা ওরফে লেখিকা ফিরোজা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন পাঠক মহলে।
হঠাৎ এই স্কুলেই ছাত্রী হয়ে আসে প্রত্যুষের মেয়ে তুলি।
স্কুলের খাতায় তার নাম ঠিকানা দেখে সৃজা জড়িয়ে নেয় তার জীবনে। নিজের পরিচয়ও জানায় তুলিকে।
নিজের মেয়ের মতোই তাকে আগলে বড় করে তোলে সৃজা। জীবনকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পূর্ণ মাত্রায় বাঁচার শিক্ষা দেয় সে তুলিকে। যদিও সৃজার ব্যাপারে সমস্ত কথা তুলি তার মা রূপালীকে বললেও বাবাকে কোনোদিনই কিছু বলেনি।
—————————————————-
সৃজার কথামতো আজই তুলি ভবিষ্যতে তার অভিনেত্রী হওয়ার ইচ্ছার কথা জানায় বাড়িতে, প্রত্যুষ যে সেটা কোনোমতেই মেনে নেবে না, বরং তুলির কিছু ক্ষতি করে ফেলতে পারে এটা ভেবেই সৃজা তার সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে রওনা হয়েছিলো প্রত্যুষের বাড়ির দিকে…..
সেই রাতেই সৃজা আর তুলি পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে প্রত্যুষের সমস্ত কথা জানায় এবং রূপালীকে উদ্ধার করতে বলে।
পুলিশের সশস্ত্র একটি বাহিনী রওনা দেয় প্রত্যুষের বাড়ির উদ্দেশ্যে। অর্ধমৃত রূপালীকে উদ্ধার করা গেলেও প্রত্যুষ অধরাই থেকে যায়।
হারিয়ে যায় চিরকালের মতো, রেখে যায় তার পরিবারের প্রতিটি মানুষের জন্যে সারাজীবনের মতো প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয়
————————————–সমাপ্ত————————