গল্প- “খুঁজে ফিরি আজও”

“খুঁজে ফিরি আজও”
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু অলৌকিক ঘটনার কথা বলছি।

(১)

আমার দাদু ঈশ্বর ভুবন মোহন চক্রবর্তী কালীঘাট মায়ের মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন।আমার মামা বাড়ি মন্দিরের সামনেই। দাদু তখন কালীঘাটে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।দাদু ভোর বেলায় মন্দিরে প্রবেশ করতেন।খুব নিষ্ঠা সহকারে দাদু পুজো করতেন। মা কালী ছাড়া আর কিছু তিনি জানতেন না।আমরা তখন সব ছোট। মামার বাড়ি বেড়াতে গেছি। বড় মাসী ও তার মেয়েরাও গেছে। যে দিনের কথা বলছি সেদিন অমাবস্যা ছিল। রাত তখন দু’টো বাজে।
বদদি ভাই বলছে, ও দাদু বাথরুম যাব।
দাদু উঠতেই আমি বললাম, আমিও যাব।

আমার মামার বাড়ির ঘরের দরজা খুললেই রাস্তা। মানে বারান্দাটা পুরো খোলা। নিঝুম, নিস্তব্ধ রাস্তা। আর বাথরুমটা বারান্দা দিয়ে গিয়ে অনেকটা ভেতরে। পুরো অন্ধকার। ওখানে আলোর ব্যাবস্থা ছিল না তখন।
যাইহোক বাথরুমে ঢোকার মুখেই দেখি খুব লম্বা একজন মহিলা সাদা শাড়ি পড়ে হাতে একটা কাপড়ের পোঁটলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, কে গো দাদু উনি? এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? কি লম্বা! এতো লম্বা কেউ হয় নাকি?
দাদু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আর বদদিকে জড়িয়ে ধরে পৈতে নিয়ে গায়ত্রী জপ শুরু করলো। আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল লম্বা মহিলাটা।
দাদু আমাদের কিছু বললো না তখন। পরের দিন সব জানতে পারলাম। দু’ মাস আগে ঐ বাড়ির এক ভাড়াটিয়ার মা মারা গেছিল।গয়াতে পিণ্ডি দেওয়ার কথা ছিল অথচ ওনার ছেলে সেটা করেনি। দাদু রাতের ঘটনা বাড়ির ভাড়াটিয়াদের বললেন। সব শুনে মৃত মায়ের ছেলে বলল, কালকেই যাব গয়াতে।এখনও চোখের সামনে ভাসে সেই লম্বা সাদা শাড়ি হাতে পুঁটলি সহ সেই মহিলার ছবি। দাদু আমাদের সঙ্গে ছিলেন বলে সেই যাত্রাতে বেঁচে গেছিলাম গায়ত্রী মন্ত্রের যে আসীম ক্ষমতা, অনেকেই মানতে চায়না।

(২)

কিছু বছর আগের ঘটনা তখন আমি বেলঘরিয়াতে একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতাম। সেদিন সন্ধ্যা বেলায় খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই আমার কোচিং সেন্টার থেকে বের হতে অনেক দেরি হয়ে গেল। বৃষ্টি একটু কম হতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেনে উঠে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কখন যে ট্রেন ব্যারাকপুর স্টেশনে ঢুকে পড়েছে তা জানলাম না। সবচেয়ে বড় কথা যে আমি জানতাম না ওটা ব্যারাকপুর লোকাল।তাহলে তো আমি ওই ট্রেনে উঠতাম না।
যাইহোক, “ওঠ ওঠ” আমার কানের কাছে এসে যেন মা বললো। ধড়মড়িয়ে উঠলাম।ঘড়ি দেখলাম, ঘড়িতে তখন রাত নটা দশ বাজে।
আমি চোখ খুলে দেখি বগিটা আলো ছায়া মেশানো অন্ধকার। জানলার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম এক ভদ্র মহিলাকে দেখে।লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাল সিঁদুরের টিপ কপালে জ্বল জ্বল করছে। হাতে শাঁখা পলা। এই রকম কালো কোন মহিলাকে আমি প্রথম দেখলাম সেদিন।
আমাকে মহিলাটি বললেন, বাস সট্যান্ডটা কোথায়? আমি চিনি না। আমাকে নিয়ে যাবে?
আমি বললাম, ট্রেন থেকে নামব না এখন।
মহিলা বললেন, এতো আর যাবে না। বসে থেকে কি করবে?
আমি এবার ভাবতে থাকলাম- তাই তো ট্রেনে তো কেউ নেই। এই বলে ট্রেন থেকে নেমে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কোন লোকাল?
উনি বললেন ব্যারাকপুর।

আমি পেছন ফিরতেই ঐ মহিলা বললেন তুমি তো শ্যামনগর যাবে। আমিও যাব তোমার সাথে।
চলুন বলে আমি আগে আগে যাচ্ছি পেছন পেছন ঐ মহিলা যাচ্ছে। সুকান্ত সদনের সামনে আসতেই 85 নম্বর বাস এসে গেল।আমি আর উনি ছাড়া আর কেউ নেই ওখানে। ঝড় বৃষ্টির রাত, রাত সাড়ে নটা বাজতে চললো। খুব প্রয়োজন না থাকলে আর কে বের হবে! আমি বাসে উঠে বললাম আপনি উঠে আসুন। পেছন ফিরে দেখি কেউ তো নেই..আমি চিৎকার করে বললাম, কোথায় গেলেন আপনি? বাস ততক্ষণ চলতে শুরু করেছে।
বাস থামাও..আমার সাথে আরও একজন আছেন, বলতেই কন্ডাক্টর বললো আপনি বাস সট্যান্ডে একাই ছিলেন।
আমি বললাম, উনি শ্যামনগর যাবেন। কিছু চেনেন না উনি। কোথায় গেলেন?
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওনাকে খুঁজতে লাগলাম।

তারপর ভাবলাম উনি জানলেন কি করে যে আমি শ্যামনগর যাব। বাড়ি এসে সব মাকে বললাম।
মা বললো, কালীঘাটের মা আমাকে বাস সট্যান্ড পর্যন্ত দিতে এসেছিল। তাই তো আমার ঘুম ভাঙল মার ডাকে। সেই অলৌকিক ঘটনা ঘটার পর থেকে অনেক খুঁজেছি ওই মহিলাকে কিন্তু দেখা আর পাইনি ওনার।

(৩)
সাউথ সিটি মলের একটু আগে আমার অফিস।;মানে ডিসান হসপিটালের থেকে অনেকটাই যেতে লাগে।
আমার অফিস থেকে বের হতে একটু দেরি হয়ে গেছিল সেদিন। রাত্রি সাড়ে নটা বাজে তখন বিধাননগর স্টেশনে আমি। ঝড় বৃষ্টিতে বাস আটকে ছিল মনি স্কোয়ারে। তাই এই বিপত্তি ।
যাইহোক আমি দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনের জন্য।

একটা ছেলে আমার সামনে হঠাৎ এসে বললো, বারোটা বেজে যাবে তোমার বাড়ি ফিরতে ফিরতে..

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনার কি তাতে?

ছেলেটি বললো, না বলছি রিক্সা করে যেও না। অটোতে করে বাড়ি যেও।

কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম, সেটা আমি বুঝবো। আপনি যান এখান থেকে।

ছেলেটি নম্র হয়ে বললো, দেখবে একটা অটো দাঁড়িয়ে থাকবে শ্যামনগর স্টেশনে।
আমি ভাবছি এই ছেলেটা জানলো কি করে আমি শ্যামনগর যাব। এবার ভালো করে ছেলেটাকে দেখতে লাগলাম। কেমন বখাটে দেখতে। তবে চোখ দু’টো যেন মায়াময় ছেলেটার।

এতক্ষণ বেশ রেগে রেগেই কথা বলছিলাম। এবার একটু সংযত হয়ে গেলাম।
আমি বললাম, আপনি কোথায় থাকেন?

ছেলেটি বলল শ্যামনগরে নেমেই দেখবে অটো দাঁড়িয়ে আছে। আমিও নামবো শ্যামনগর। বলতে বলতেই ট্রেন এল। 9 .40 এ ট্রেনে উঠলাম হিসাব মতো 10 .30 মধ্যেই শ্যামনগর স্টেশন পৌছে যাব। কিন্তু সোদপুরে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল। ব্যারাকপুরে নাকি সিগন্যাল নেই। কিছু করার নেই ।
অগত্যা বসে বসে ছেলেটার কথা ভাবছি।বারোটা বাজবে বললো ছেলেটা। মানে শ্যামনগর স্টেশন পৌছাব রাত বারোটা ।ছেলেটার চোখ দু’টো আমার চোখের সামনে ভাসছে। ঠিক রাত বারোটা। শ্যামনগরে ট্রেন ঢুকলো। আমি নামলাম কিন্তু ছেলেটা কোথায় গেল? ও যে বলল ও শ্যামনগর নামবে। কেউ তো নেই আমি ছাড়া। এবার ভয় লাগছে। এক ছুটে অটো স্ট্যান্ডে এলাম।

“তাড়াতাড়ি আসুন একটাই সিট আছে” অটোদাদা হাঁক দিচ্ছে।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, এত রাতে অটো তো থাকে না দাদা, তাহলে এখন?

অটোদাদা বললো, বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরছি আপনাকে একা দেখলাম তাই ডাকলাম।পেছনে তিনটে ছেলে বসে আছে। আমি ভালো করে ঐ ছেলেগুলোকে দেখলাম। না তো, ঐ ছেলেটা নেই তো। ওদের মধ্যে
একজন বললো, আপনি খুঁজছেন কাউকে?
আমি বললাম- হ্যাঁ
অটোদাদা বললো, এত রাতে বাড়ি ফিরছেন? ট্রেনের গন্ডগোল ?
রোজ যাতায়াতের জন্য সব অটোদাদা বা অটোভাইরা আমাকে চেনে।
আমি আর কোনো কথার উত্তর দিলাম না।
“অটো দাঁড়িয়ে থাকবে, বারোটা বাজবে,” এই কথাগুলো শুধু কানে গুঞ্জরিত হচ্ছে ।ছেলেটার চোখ দু’টো ভুলতে পারিনি আজও। সেই রাতের অলৌকিক ঘটনা আজও মনকে নাড়া দেয়।
আজও খুঁজে বেড়াই তাকে। সেই মায়াময় চোখ যে ভোলার না।

Loading

One thought on “গল্প- “খুঁজে ফিরি আজও”

Leave A Comment