Site icon আলাপী মন

গল্প- ছপাক

ছপাক
– প্রলয় কুমার‌ নাথ

-“আমি আর পারছিনা…পারছিনা শাশ্বত!” বিছানার চাদরটা দুই হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে উন্মাদের মত মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করছিল তন্বী, “বারবার…বারবার দিদি দেখা দিচ্ছে আমায়!”
সে ছুটে এসে আমার বুকের জামা খামচে ধরে পাগলের মত কাঁদতে লাগল অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে।
– “ডা: সেনগুপ্তের দেওয়া ওষুধগুলো নিশ্চয় ঠিক করে খাচ্ছ না তুমি” বলে উঠলাম আমি। তারপর এগিয়ে গেলাম বেডসাইড টেবিলের দিকে যার ওপর ওর সমস্ত ওষুধগুলো রাখা থাকে। দেখতে লাগলাম সকালের এই সময়ে ওর কোন ওষুধটা খাওয়ার কথা বলেছেন ডাক্তার বাবু। মনরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডা: প্রবাল সেনগুপ্তের যথেষ্ট নামডাক আছে এই অঞ্চলে। প্রচুর মানুষ তার চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছেন। আজ বেশ কিছু মাস ধরে তন্বী তার কাছে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেছেন তন্বীর সাময়িক কিছু হ্যালুসিনেশন হচ্ছে, যা সিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্টদের মধ্যে খুব কমন। সমস্ত ওষুধ খাওয়ানো, কাউন্সেলিংএ নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি সময়মতই করাচ্ছি আমি। তবুও কেন জানি না তন্বীর পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না। ওর জন্য আমার চিন্তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কি অপর কোন এক মৃত মানুষকে বারবার দেখতে পায়! এমন চলতে থাকলে তো ওকে মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে! তন্বী হঠাৎ ছুটে এসে টেবিল ক্লথটা ধরে এক টান দিল, ওপরে রাখা সমস্ত ওষুধপত্র ঘরের মেঝেয় যত্রতত্ৰ ছিটকে পড়লো। কান্না ভুলে এবার অদ্ভুত কণ্ঠে খিলখিল করে হাসতে লাগলো তন্বী। কি মনে হতে হাতটা তুলে ওর গালে লাগাতে গেলাম সপাটে এক চড়। কিন্তু ও আমার হাতটা ধরে ফেললো, কি আশ্চর্য পৈশাচিক শক্তি ওর গায়ে যে নিজে একজন শক্ত সামর্থ চেহারার পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও ওর মত একজন দুর্বলচিত্ত নারীর হাতের বাঁধন থেকে এক চুল নড়াতে পারলাম না নিজের হাত!
– “কাল দিদি এসে আমাকে সব বলেছে…সঅঅঅব…কেন সে বারবার আমাকে দেখা দিচ্ছে…ও আমাকে ছাড়বে না শাশ্বত…কিছুতেই ছাড়বে না!”
তন্বীর কথা শুনে একটা অপার্থিব শীতল আতঙ্কের স্রোত যেন বয়ে গেল আমার গোটা শরীর জুড়ে। বললাম,- “তোমার দিদি বহ্নি আর আর এই পৃথিবীতে নেই তন্বী! সে আর ফিরে আসতে পারে না…কিছু বলতেও পারে না…”
– “সে ফিরে এসেছে, শাশ্বত…সে বলেছে যে প্রতিশোধ নিতে চায়…প্রতিশোধ!”
কথাগুলো শুনে এই এসি ঘরের মধ্যেও যেন ঘামতে শুরু করলাম আমি। কি জানি কেন ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগল কয়েক মাস আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাটার কথা।

***

বহ্নির সাথে আমার বিয়ের সম্বন্ধটা এনেছিলেন আমার এক দূরসম্পর্কের মামা। ভালো স্বচ্ছল পরিবার ওদের, দুই বোনের মধ্যে ওই বড়। ওদের বাবা এখনো সরকারি চাকরি করেন, কয়েক মাস পরে অবসর নেবেন। দুই বোনই সুন্দরী। তিনি বড় মেয়ে বহ্নির জন্য আমায় পছন্দ করেছিলেন। প্রথমে বহ্নি দাশগুপ্ত নামটা শুনেই কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছিল ওকে আমার বেশ চেনা। পরে ওকে দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। ওর সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ পেয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ক্লাস নাইন অবধি ও আর আমি একই স্কুলে পড়েছি। ও ছিল আমার থেকে দুই বছরের জুনিয়র। ক্লাস নাইনের পর আমি অন্য স্কুল থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাই ব্যাঙ্গালোরে। সেখান থেকেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে পরে ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় আসি। আর বহ্নি ওই স্কুল থেকেই উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে পরে আর্টস নিয়ে গ্রাজুয়েশন করে। সেই ক্লাস নাইনে পর এত বছর পরে ওর সাথে আমার এই পরিস্থিতিতে দেখা হবে তা সত্যিই ভাবিনি! এক দেখাতেই পাকা হয়ে গিয়েছিল আমাদের বিয়ের কথা। কিন্তু বিধাতা পুরুষ বোধহয় এই বিয়ে আমাদের ভাগ্যে লিখে রাখেননি। তাই তো আমাদের বিয়ের কয়েক সপ্তাহ আগেই ঘটেছিল সেই দুর্বিষহ নির্মম ঘটনাটা যা আমাদের সকলের জীবনের গতিপথটার আমূল পরিবর্তন ঘটালো।

সেদিন দুপুর থেকেই বহ্নির মায়ের শরীরটা ভালো ছিল না, আর বোন তন্বীর সামনেই ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা তাই সে পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। এদিকে বাবাও বলেছিলেন অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরী হবে। তাই বিকালের দিকে মায়ের জন্য কয়েকটা ওষুধ কিনতে গিয়েছিল বহ্নি। স্টেশন সংলগ্ন ওষুধের দোকানটা তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে। সেদিন দোকানে খরিদ্দারদের ভিড়ও ছিল প্রচুর। তাই সমস্ত ওষুধ কিনে দাম বুঝে নিয়ে আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। স্টেশন থেকে ওদের বাড়িতে আসতে একটি শর্টকাট রাস্তা আছে। সেটাই ধরেছিল বহ্নি। জায়গাটা বেশ নির্জন। সন্ধ্যা নেমে বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে চারিদিকে। তার ওপরে সেই স্থানে তেমন বাড়ি ঘরও নেই, ঘন ঝোপঝাড় আর আম গাছের সারি রাস্তার দুই পাশে। হঠাৎ পাশের ঝোপের ভেতর কারোর পদশব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বহ্নি। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি তীব্র আলোর ঝলকানি এসে লাগল তার দুই চোখে। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল বহ্নি, আর ঠিক তখনই একটি অস্ফুট শব্দ শোনা যায়…

“ছপাক…”

কোন তরল পদার্থ যেন ছিটকে এসে ছড়িয়ে পড়ল বহ্নির চোখে মুখে। নিভে গেল তার চোখের সামনে জ্বলা আলো। মুহূর্তের মধ্যে গোটা মুখে তীব্র দহনের জ্বালায় ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে রাস্তায় পড়ে ছটফট করতে থাকল বহ্নি। রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগল মায়ের জন্য সদ্য কেনা ওষুধের শিশিগুলো, আর তার সাথেই কাজ হয়েছে জেনে পাশের ঝোপের ভেতর থেকে সেই পদশব্দ দূরে সরে যেতে লাগল। মুখের তীব্র জ্বালাটা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকল, কি হল তা বোঝার আগেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল বহ্নি। কোনো এক সহৃদয় পথচারী পরে বহ্নিকে স্থানীয় হাসপাতালে পৌঁছে দেন। খবর পেয়ে ছুটে আসে ওর মা, বাবা আর বোন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। জ্ঞান হবার পর থেকে মা, বাবা আর বোনকে কাঁদতে দেখে সে স্যালাইনের নল হাত থেকে খুলে ছুটে গেল হাসপাতালের ওয়াশরুমে। সেখানে থাকা আয়নায় মাঝে চেয়ে দেখল নিজের মুখের প্রতিবিম্বের দিকে। অ্যাসিডের দ্বারা বীভৎস ভাবে ঝলসে গিয়েছে তার মুখের ৯০% চামড়া। নিজের ফর্সা সুন্দর মুখটাকে যেন নিজেই চিনতে পারল না বহ্নি, অপার্থিব আক্রোশে দেওয়ালের সাথে মাথা কুটে চিৎকার করতে লাগল সে, – “না! এ হতে পারে না…কিছুতেই না!”
ওর মা, বাবা এবং বোন ছুটে এসে ওকে সামলাতে চেষ্টা করলো। হাসপাতাল থেকে কোনো মতে ওকে বাড়িতে নিয়ে গেল। কিন্তু আকস্মিক নিজের সব রূপ, সৌন্দর্য হারানোর আঘাতটা কিছুতেই সহ্য করতে পারলো না বহ্নি। পরদিনই ওর ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ওড়নার ফাঁসের সাহায্যে ওর ঝুলন্ত শরীরটাকে প্রথম আবিষ্কার করল ওর মা! ওর হাতের মুঠোয় মধ্যে ধরা ছিল একটি দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজ যাতে লেখা ছিল,

“কে আমার এত বড় ক্ষতি করল তা আমি জানি না। এও জানিনা যে এই দেশের আইন তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবে কি না। কিন্তু মৃত্যুর পর আমার আর কিছুই অজানা থাকবে না। তখন আমাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না, যে এই কাজ করেছে তাকে কিছুতেই ছাড়ব না আমি। মৃত্যুর পরও নিজের ওপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া যায়, আর সেটাই হবে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য!”

এর পরদিনই জানতে পেরেছিলাম বহ্নির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারাটা কার কাজ ছিল। ওই পাড়ার ছেলে অনিমেষ অনেক দিন ধরেই বহ্নির পেছনে লাগতো। রাস্তা ঘাটে দেখা হলে তাকে বারবার বিরক্ত করতো, প্রণয় নিবেদনের ব্যর্থ চেষ্টা করতো। বহুদিন ধরে এমন দৃশ্য এই পাড়ার অনেকেই দেখেছে। কিন্তু বহ্নির ওই অশিক্ষিত পাড়ার রকে বসে আড্ডা মারা বেকার ছেলেটাকে একদম পছন্দ ছিল না। প্রেম করা তো দূরের কথা সে সর্বদা ওই মস্তান গোছের ছেলেটার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতো। এখন যেন ওদের পাড়ার সকলের কাছেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেল যে বহ্নির যেহেতু আমার মত শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে, তাই রাগে আক্রোশে হতাশায় সেই বিয়ে পন্ড করতে অনিমেষই সেদিন সন্ধ্যায় বহ্নির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছে। এছাড়াও আরেকটা কথা জানাজানি হয়ে গেল যে এই ঘটনার আগের দিন অনিমেষই বাথরুম পরিষ্কার করবে বলে পাড়ার একটি দোকান থেকে অ্যাসিড কিনে এসেছিল। এই কথাটা যেন আগুনে ঘিয়ের কাজ করলো। পুলিশ কিছু করার আগেই পাড়ার ছেলেরা রাগে ফেটে পড়ে চড়াও হল অনিমেষের বাড়িতে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হিড়হিড় করে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে এসে মারধোর করতে লাগল সকলে। অবশেষের বাড়ির লোকের ফোন পেয়ে পুলিশ যখন এসে পৌঁছলো, তখন আর অনিমেষের দেহে প্রাণ নেই!

বহ্নির শ্রাদ্ধ শান্তির পর ওদের বাড়ি থেকেই এসেছিল আমার সাথে বহ্নির বোন তন্বীর বিয়ের প্রস্তাবটা। বাড়ির বড় মেয়ের সাথে যা হল, তারপর কেই বা বিয়ে করতে চাইবে সেই পরিবারের ছোট মেয়ের সাথে। তাই ওদের পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে আমিও আর না করতে পারিনি ওদের প্রস্তাবে। তাছাড়া আমার বাবা মার পুত্রবধূ হিসাবে তন্বীকেও অপছন্দ ছিল না। একটি শুভ দিন দেখে অত্যন্ত আড়ম্বরহীন ভাবেই আমার আর তন্বীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হল তন্বীর নিজের মৃত দিদি বহ্নিকে দেখতে পাওয়ার এই অদ্ভুত মানসিক অসুস্থতাটা!

***

– “প্রতিশোধ!…কিসের প্রতিশোধ, তন্বী? যে তোমার দিদির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে ছিল, সেই অনিমেষ তো আজ এই পৃথিবীতে নেই…তাহলে…”চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি।
– “না শাশ্বত, দিদির মুখে অনিমেষ অ্যাসিড ছোঁড়েনি!” বললো তন্বী।
– “এ কী বলছো তুমি! অনিমেষ অ্যাসিড ছোঁড়েনি! কিন্তু সবাই যে তাকেই অপরাধী মনে করে…তাহলে সেদিন বহ্নির মুখে কে অ্যাসিড ছুঁড়ে ছিল তন্বী?”
– “সেটা আমিও জানি না, কিন্তু শুধু এটা বলতে পারবো যে অনিমেষ অ্যাসিড ছোঁড়েনি!”
– “এই সব কি উল্টো পাল্টা কথা বলছো তুমি, তন্বী? মনে হয় তোমার মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছে!”
– “না শাশ্বত, আমার মাথা একটুও খারাপ হয়নি…তাহলে বলছি শোনো”, হিসহিসিয়ে বলতে লাগল তন্বী, “যেদিন তুমি দিদিকে দেখতে এসেছিলে, সেদিন থেকেই তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমার অর্থ, রূপ এইসব পাগল করে তুলেছিল আমাকে। মনে মনে পরিকল্পনা করছিলাম কি ভাবে দিদির সাথে তোমার বিয়েটা ভেস্তে দেওয়া যায়। তাই ওই ঘটনার কয়েকদিন আগে একান্তে গিয়ে দেখা করেছিলাম অনিমেষের সাথে। জানতাম যে তার মনেও আমার মত দিদির প্রতি প্রবল হিংসা এবং আক্রোশ বর্তমান। আমি শুধু উস্কে দিয়েছিলাম সেই আগুনটাকে। আমার পরিকল্পনা মতই অনিমেষ অ্যাসিড কেনে পরের দিন দিদির মুখে ছোঁড়ার জন্য। পরদিন দিদিকে বিকালে মায়ের ওষুধ কিনতে যেতে দেখে আমি অনিমেষকে ফোনে জানালাম এবার তৈরি হয়ে নিতে, আজই ধ্বংস করে দিতে হবে দিদির সব রূপ আর সৌন্দর্য! দিদি যখন দোকান থেকে ওই রাস্তা দিয়ে ফিরছিল, তখন আমি আর অনিমেষ লুকিয়ে ছিলাম পাশের ঝোপের মাঝে। কিন্তু বিশ্বাস করো…যখন আসল মুহূর্ত এলো, মনে পড়ে গেল দিদির সাথে ছেলেবেলায় কাটানো সকল মুহূর্তের কথা, কত ভালোবাসে আমাকে দিদি। কখনো সে কি স্বপ্নেও ভাবতে পারছে আমি তার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করেছি? তাই পারলাম না…পারলাম না শেষ মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবের রূপ দিতে। আটকে নিলাম অনিমেষকে, সেও হয়তো খুব ভালোবাসতো দিদিকে। তাই আমার মতই শেষ মুহূর্তে দিদির এতবড় ক্ষতি করতে পারলো না সে। অ্যাসিডের বোতলটাকে ওখানেই ফেলে আমরা সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। অনিমেষের কোনো কথা না শুনেই তাকে সবাই পিটিয়ে মেরে ফেলে, তাই তো এত কথা বাইরে আসেনি! সেই জন্যই দিদির আত্মা আমাকে পুরোপুরি মারছে না, শুধু তার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার যড়যন্ত্র করার জন্য আমাকে ধীরে ধীরে মানসিক কষ্ট দিয়ে শাস্তি দিতে চাইছে!”

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম তন্বীর সব কথা। ও সব কথা বলে আস্তে আস্তে কেমন ঝিমিয়ে পড়ল। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। চোখ চলে গেল ঘড়ির দিকে। এখনই বেরোতে হবে নাহলে অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাবে। তাহলে শেষমেষ কে ছুঁড়েছিল অ্যাসিড বহ্নির মুখে? মনে প্রশ্নের ঝড় নিয়ে কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে ঠান্ডা হয়ে এলো গাড়ির ভেতরটা! আমি এসি বন্ধ করে জানলার কাঁচ নামাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাঁচগুলো নামলো না, অদ্ভুত ঠান্ডার পরিবেশটাও গেল না। আমার বাইরের চারিদিকটা এই রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল বেলাতেও কেমন যেন অন্ধকার হতে শুরু করেছে! আকাশে মেঘ করেছে নাকি? ঝড় উঠবে নাকি? ঠিক সেই সময় আমার চোখ গেল আমার সামনে রাখা গাড়ির আয়নায়! আমার গাড়ির পেছনের সিটে ওটা কে বসে আছে? বীভৎস পচা গলা মাংসে ভরা তার গোটা মুখ, ভনভন করে পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে তার চারিপাশে! শুধু নাম মাত্র সূক্ষ্ম মণি বিশিষ্ট তার সাদা চোখগুলো যেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বহ্নি! অপার্থিব সুরে সেই অশরীরী বলে উঠলো,
– “কেন করলে তুমি এটা? কেন আমার মুখের সাথে আমার স্বপ্নগুলোকে, আমার বাঁচার ইচ্ছাটাকে অ্যাসিডের ঝাঁঝে পুড়িয়ে শেষ করে দিলে শাশ্বত? বলো কেন?”

হ্যাঁ, আমি, এই শাশ্বত মল্লিকই সেদিন অ্যাসিড ছুঁড়েছিল তার হবু স্ত্রী বহ্নি দাশগুপ্তের মুখে। কি করবো বলো, তোমাকে দেখেই যে ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো চাগাড় দিয়ে উঠলো আমার মনে। মনে পড়ে আমাদের একই স্কুলে পড়াকালীন আমার ক্লাস নাইনে ইতিহাস পরীক্ষার দিনটার কথা। স্কুলে পরীক্ষার সময় বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়ের পাশাপাশি বসার সিট পড়েছিল, যাতে কেউ দেখাদেখি করে না লিখতে পারে। তোমার সিট পড়েছিল আমার পাশে। ইতিহাসে আমি বরাবরই কাঁচা, মানছি সেদিন আমি গার্ডের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে টুকলির কাগজ দেখে উত্তর লিখছিলাম। তুমি লক্ষ্য করেছিলে সেটা, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ সেই কাগজটাকে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলে গার্ডকে! খুব সৎ, খুব আদর্শবাদী সেজেছিলে সেদিন না? কিন্তু জানো তারপর আমার কি হয়েছিল? আমার গোটা পরীক্ষাটাই বাতিল করে দেওয়া হয়। ফেল করানো হয় আমাকে। গোটা স্কুলে সকলের হাসি আর উপহাসের পাত্র হয়ে উঠি আমি। তাই তো বাধ্য হয়ে ওই স্কুল ত্যাগ করে আমাকে অন্যত্র ভর্তি করান আমার বাবা। কি ভেবেছিলে তুমি? এতদিন পর সেই কথা আমার মনে থাকবে না? না, এতদিন পরে সেই সব ঘটনাগুলোকে অল্প বয়সের ছেলেখেলা ভেবে তুমি ভুলে গিয়ে আমাকে বিয়ে করার কথা ভাবলেও, তোমাকে দেখে আমার মনে একটাই শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল…প্রতিশোধ। আর তাই তো গোপনে খোঁজ নিই তোমার সম্বন্ধে, জানতে পারি অনিমেষের কথা। ঘটনার আগের দিন রাতেই অনিমেষকে নিয়ে একটি বারে যাই আমি, ওকে মদ খাইয়ে জানতে পারি তোমার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার পরিকল্পনার কথা। সেদিন রাতটা স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে কাটাই আমি, কি হতে চলেছে তা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছায়। পরদিন বিকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে অনিমেষই আমায় ফোন করে ডেকে নেয়। ওরা ওই রাস্তার পাশের ঝোপে পৌঁছনোর কিছুটা পরে আমি পৌঁছাই। দেখতে পাই যে শেষ পর্যন্ত অনিমেষ অ্যাসিডের বোতলটি নীচে ফেলে দিয়ে তন্বীকে নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। ওরা চলে গেলে আমি রাগে ফুঁসতে থাকি, মুহূর্তের মধ্যে নিচ থেকে কুড়িয়ে নিই অ্যাসিডের বোতলটাকে, আর তারপর…

– “ক্ষমা করে দাও আমাকে, বহ্নি!…ক্ষমা করে দাও আমাকে!” আতঙ্কে চিৎকার করলাম আমি। কিন্তু বহ্নির অশরীরী কানে বোধহয় সেই কথা ঢুকলো না। সে ধীরে ধীরে নিজের হিমশীতল হাতগুলো দিয়ে আমার দুই কাঁধ স্পর্শ করল। তারপর তার বীভৎস ঝলসানো মুখটাকে নিয়ে এলো আমার মুখের খুব কাছে…তার হলদে হয়ে যাওয়া তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো নেমে এলো আমার গলার টুঁটির ওপর…তারপর একটা অসহ্য যন্ত্রণা…আমার হাতের স্টিয়ারিং কেঁপে উঠলো…আর সামনে থেকে একটা মাল বোঝাই ট্রাক এসে…একটা বিকট শব্দ…তারপর আর আমার কিছু মনে নেই!

***

রাস্তায় বেশ কিছু লোক ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল একটি এক্সিডেন্টের জায়গার চারিপাশে। একটি গাড়ির সাথে একটি মাল বোঝাই ট্রাকের ধাক্কা লাগে এই স্থানে। ট্রাক বা তার চালকের তেমন কোন ক্ষতি না হলেও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে গাড়ি চালকের। শাশ্বত মল্লিকের রক্তাক্ত মৃতদেহটার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সকলে। কারণ, তার শরীরে এক্সিডেন্টে লাগা আঘাতের চিহ্ন থাকলেও, তার গলার টুঁটির অংশটি আশ্চর্য জনক ভাবে উধাও, যেন কোন হিংস্র শ্বাপদ প্রবল আক্রোশে খুবলে ছিঁড়ে নিয়েছে তার শরীরের ওই অংশটাকে!

(সমাপ্ত)

Exit mobile version