শাঁখের করাত
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়
হরিহর গোঁসাই প্রায় প্রতিদিনই হরিসংকীর্তন শুনতে যান মঠে। সেদিনও গেছেন, শুনছেন হরিনাম। কিন্তু আজকে যেন কিছুতেই মন বসছে না। উসখুস করছেন। বারবার পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকাচ্ছেন। চোখে মুখে ভক্তি ভাবের বদলে উৎকন্ঠা ভাব।
পাশে বসে থাকা এক ভক্ত, আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ও হরিদা ব্যাপার কী? আজ তোমাকে বড্ড অমনোযোগী দেখছি। বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছো, কারুর কী আসবার কথা আছে নাকি?
হরিদা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, না গো ভাইটি। বাইরে নতুন জুতোজোড়া ছেড়ে রেখে এসেছি কিনা, যদি চুরি হয়ে যায়?
আমি চলি ভাই। কালকে সেই পুরনো ছেঁড়া চটি পড়েই আসবো।
হরিবোল.. হরিবোল,
সেই রামপ্রসাদের গান খানা মনে আছে?
‘সংসার ধর্ম বড়ো ধর্ম মা
তাই পারিনে ছেড়ে যেতে।’
জীবন কাটলো সংসারের দায় সামলাতে। শেষ বয়সে এসে, শেষ পাড়ানির কড়ি যোগারের মরিয়া চেষ্টা। কিন্তু অভ্যেস পিছু ছাড়বে কেন?
অভ্যেস হলো পোষা বেড়াল। তিতিবিরক্ত হয়ে দূরে ছেড়ে দিয়ে এলেও, ঠিক গন্ধ শুঁকে শুঁকে ফেরৎ আসবে।
সংসার জাল হলো মায়া সুতোয় বোনা। অভিমন্যুর চক্রবুহ্যে এনট্রি আছে এক্সজিট নেই।
আসল কথা মন। যে রঙে রাঙাবে, মনে সেই রঙ ধরবে। সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে এলেই মন কেমন যেন উড়ুউড়ু হয়ে ওঠে। কামনা বাসনাগুলো কিচ্ছুক্ষণের জন্য হলেও নির্বাসনে যায়। বৈরাগী হতে চায় মন।
মনে হয় এইতো প্রকৃত জীবন চেতনা। বৈভব ঐশ্বর্য সঞ্চয়, সুখ দিতে পারলো কৈ? শান্তি?
চল মন বৈরাগী হই।
আহা রে, যেন কতই সহজ। চল, লগা দিয়ে চাঁদ পেড়ে আনি গোছের ব্যাপার। যেন শিশুর হাতের চুষিকাটি।
ঠাকুর বলেছিলেন, সংসারে থাকবি পাঁকাল মাছ হয়ে। মাঝেমধ্যে সাধুসঙ্গ করবি। কিন্তু সাধু পাই কোথায়! ভন্ড আর ধর্ম বেচা কারবারি গিজগিজ করছে।
গন্ধমাদন পর্বতের বুকে হাজারো আগাছার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে প্রাণদায়ী বিশল্যকরণী? চিনব কীভাবে, কে চিনিয়ে দেবে?
উত্তরাখন্ডের কেদারনাথ মন্দিরের কিছুটা দূরে, এক নির্জন পাহাড়ি পরিবেশে, আচমকাই সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম এক যোগী পুরুষের।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি এখানে মানে কেদারনাথ মন্দিরে কেন এসেছি। বলেছিলাম, দর্শন করতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
উনি বলেছিলেন, আজ এখানে আসা কত সহজ। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন এখানে আসতে অনেক কষ্ট, ক্লেশ স্বীকার করতে হতো। রাস্তা ছিল না। পাহাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে, হিংস্র জন্তুর নজর এড়িয়ে, দিনের পর দিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থেকে পায়ে হেঁটে এখানে যারা শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারতেন, তারা ছিলেন নিরাসক্ত যথার্থই ভক্ত। দেবতার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতেই আসতেন তারা।
সেসময় এখানে না ছিল ঠিকঠাক থাকার আশ্রয়, কিংবা ভোজনের ব্যবস্থা।
পরোয়াই করতেন না তারা সেইসব বাধা। তাদের মুখে আর অন্তরে ছিল একটাই নাম,,,
জয় শিবশম্ভু, জয় কেদারনাথ, জয় ভোলে নাথ।
এই হলো বিশ্বাস। ভক্তি। পূজা নিবেদন।
সেই তাদের সঙ্গে তোমাদের এখানেই পার্থক্য। তোমরা এসেছো প্রমোদ ভ্রমণে। অন্যরকম পরিবেশে ছুটি কাটাতে। একঘেয়েমি থেকে কিছুদিনের জন্য রেহাই পেতে। হাওয়া বদল করতে।
হিমালয়ের অতুল সৌন্দর্যের অপরূপ মায়াবী পরিবেশে ধীরে ধীরে নেমে আসছিল সন্ধ্যার আঁধার। মন্দির থেকে ভেসে আসছিল মৃদু ঘন্টার ধ্বনি, আর নাম না জানা পাহাড়ি রাতজাগা পোকা পতঙ্গের রহস্যময় ডাক।
জটাজুট ধারী প্রায় উলঙ্গ যোগী চলে গেলেন গুহাভ্যন্তরে। দেনাপাওনা, প্রত্যাশা, ভোগবাসনা হীন নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। যেখানে ভোগবাদীদের কঠোর ভাবে প্রবেশ নিষেধ।
রাতে হলিডে হোমের আরাম বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছে না। কেবলই সেই সাধুবাবার কথাগুলো মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন এসেছি এখানে?
ভক্তি নেই, বিশ্বাস নেই, পুজো অর্চনা নেই, ঈশ্বরের প্রসাদ পাবার বাসনা নেই এমনকি তার কাছে কোনও প্রার্থনাও নেই। তাহলে? তাহলে এই দেবভূমিতে কেন, কেন?
দু’টি হাত। একটি থাকুক সংসার দায়িত্ব কর্তব্য পালনে। অন্য হাত থাকুক ঈশ্বরের চরণে। কিন্তু হায়রে..তেমন হচ্ছে কৈ!
দু:টি হাত দিয়েই মনেপ্রাণে আষ্টেপৃষ্টে ধরা আছে সংসারের মায়ার বাঁধন দড়ি। উপায় নেই, উপায় নেই। পালাবার উপায় নেই । এই তোমার অনিবার্য নিয়তি।
আর মাত্র ক’দিন। ফিরতে হবে চিরাচরিত যাঁতাকলের সংসারে। ঘানিটানা ডাল ভাতের অফিস কাছারি জীবন। সেই খুঁটেই বাঁধা আছে মন।
তা নাহয় হলো । কিন্তু শেষপর্যন্ত এই সংসার সব হিসেব চুকিয়ে দেবে তো? মূল্য দেবে তো? অন্তত শেষ বয়সের মর্য্যাদাটুকু? কে বলে দেবে?
আমি মনের বশে নাকি, মন আমার বশে?
কে বলে দেবে?
প্রত্যাশায় ভরপুর মন, গভীর রাতে অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে বাঁশিতে সুর তোলে মালকোষ রাগে। সংসারী মনে শাঁখের করাত।
হরি হরি করি নাকি পিষে মরি?
মন বলে আমি মনের কথা জানি না। হায়রে,
মন অতি বিষম বস্তু।