রম্য- শেষ সাক্ষাৎকার

শেষ সাক্ষাৎকার
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

দাশরথি দাশ আজ দুপুরে দেহ রাখলেন। বাহাত্তুরে বুড়োর জীবনাবসান। বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে ব্যাথা। শ্বাসকষ্ট। নিমেষে নিঃশব্দে এপার থেকে ওপার।
নো হসপিটাল। নো নার্সিংহোম। নো সন্দেহজনক বাড়তি বিল। নো বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রাণান্তকর নরকযন্ত্রণা।
আহা, কী চমৎকার শান্তিময় মৃত্যু। ওগো, সকলেরই কেন এমন করে মরণ আসে না?
আবদার বোঝো…
না, আসবে না। মরণের ধরন দেখে বোঝা যায়, মানুষটি কেমন ছিল। ভালো নাকি বজ্জতের একশেষ।

পাড়া প্রতিবেশী আর গুটিকয়েক পরিচিত লোক, কাঁচ ঘেরা গাড়িটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। নির্বিবাদী, ভাল মানুষের শেষ বিদায়। রোববারের ক্ষণিকের বৃষ্টি ভেজা গোধূলি বেলায়, সকলেই জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, মুখের এক্সপ্রেশনে যেন নিদারুন করুণ ভাব বজায় থাকে। কেননা এইটাই রেওয়াজ। তাছাড়া, যেকোনো মৃত্যুই দুঃখের, এইটুকু আপ্তবাক্য ছাড়া, দুঃখের আর কোনও কারণ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, কারোর পক্ষেই।
সুতরাং মিনিট দশেকের দুঃখী অভিবক্তি চালিয়ে যাওয়া এমনকি কঠিন কর্ম।
এ দুনিয়ায় কেইবা কার খবর রাখে। সবই স্বার্থের সম্পর্ক। সম্পর্ক হলো স্বল্প আয়ুর ভেজাল নাটিকা।
যতক্ষণ প্রয়োজন, ততক্ষণ কাছে থাকা, খবরাখবর নেওয়া। আদিখ্যেতার জয়জয়ন্তী। প্রয়োজন মিটে গেলেই সটকে গিয়ে ভুলে যাওয়া।
আচ্ছা, সত্যিই কী কেউ ভুলে যায় ! নাকি প্রয়োজন ফুরোলে দূরে সরে যায় ইচ্ছাকৃত ভাবে, নানান ছলে, বাহানায়, শুধুমাত্র দায়িত্ব কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার নিশ্চিত কারণে?
এই বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে পি এইচ ডি করা চলে।

দাশরথি বাবু বিপত্নীক। বছর দুয়েক আগে মিনতি দেবী ক্যান্সারে ভুগে চলে গেছেন। সন্তানাদি নেই। মানে, হয়নি। তেমন কোনও আত্মীয় পরিজনও নেই। সেই দিক থেকে বলতে গেলে, দাশুবাবু ভাগ্যবান।
আত্মীয়ের মতো অবিশ্বাসী, পরশ্রীকাতর, হিংসুটে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর সন্তান? বিয়ে করার আগে আর বিয়ে করার পরে। আকাশ পাতাল পার্থক্য তৈরী হবে। সে পুত্রই হোক কিংবা কন্যা। তবে সবাই নিশ্চয় একইরকম নয়। সব জলাশয় এঁদো পুকুর নয়। কিন্তু গ্যারান্টি দেবার ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই।
বাজার থেকে দেখে শুনে বাছাই করে আম কিনে এনে, খাবার সময় সেটা দড়কচা বেরুলো। যাক,
থাকার মধ্যে আছে এক শালা অর্থাৎ শ্যালক। শ্যামল সূর।
“মহাপ্রস্থানের পথে” লেখা কাঁচ ঢাকা, রজনীগন্ধা ফুল আর চন্দন গন্ধ যুক্ত ধূপকাঠি জ্বালানো গাড়ি যখন, শ্মশানের দিকে গড়িয়ে গেল, একটুও অশ্রুপাত কোথাও ঘটলো না। শুধু দীর্ঘশ্বাস মেশানো একটি কন্ঠস্বর শোনা গেল, আহা, বড় পুণ্যবান মানুষ ছিলেন। একটুও কষ্ট পেলেন না। কাউকে কষ্ট দিলেনও না। কেমন নিঃশব্দে নীরবে চলে গেলেন। একেই বলে ভাগ্যবান মানুষ। হায় রে, আমাদের কপালে কী লেখা আছে কে জানে! আবারও দীর্ঘশ্বাস।
এবারেরটা আরও বড় এবং গভীর। সম্ভবত সে বেচারি অনুমান করতে পেরেছে, শেষের সেদিন বড় ভয়ঙ্কর।

শ্মশান যাত্রী মাত্র একজনই। শ্যালক, শ্যামল সূর।
তাতে অবিশ্যি অসুবিধের কিছু নেই। কেননা, সেই প্রাচীন হরিধ্বনি দেওয়া, কিংবা মুঠো মুঠো খই ছড়ানো কেস বিদায় নিয়েছে। বাঁচা গেছে। যা দিনকাল আসছে, এবার হয়তো ভার্চুয়াল শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থা হবে।

শ্মশানের যাবতীয় নিয়মাবলি শেষ করে, জামাইবাবুর মরদেহ, আধুনিক চুল্লীতে ঢুকিয়ে দিয়ে শ্যামল এসে বসলো শ্মশানের পাশেই নিরিবিলি গঙ্গা ঘাটের সিঁড়িতে।
সামনে পবিত্র গঙ্গা, পিছনে অন্তিম গন্তব্য শ্মশান, মাঝখানে মানুষ। আহা, কী অসাধারণ কম্বিনেশন। এইতো জীবনের বাস্তব চিত্র।

ঘড়িতে এখন রাত আটটা বেজে গেছে। কাজ সম্পূর্ণ করতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে।
জায়গাটা কেমন যেন আলো আঁধারি মতন। একটা গা ছমছম ভাব। অবিশ্যি এটাই যে কোনো শ্মশানের চিরাচরিত আবহাওয়া।
কেমন যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। শরৎকাল। এমনই হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পরক্ষণেই যেটা ঘটলো, সেটা কিছুতেই স্বাভাবিক নয়।
শ্যামলের পাশে একটি লোক এসে বসলো। তাকে দেখেই চমকে উঠে অস্ফুট গলায় বললো,
একি আপনি, মানে আপনি কী করে ? দাশুদা!
হ্যাঁ, জামাই বাবুকে দাশুদা বলেই ডাকতো শ্যামল।
দাশুবাবু চিরাচরিত অমাইক হাসিতে গাল ভরিয়ে বললেন, এলুম.. দেখলুম একা-একা বসে রয়েছো তাই..
শ্যামলের এখনো ঘোর কাটেনি। কাঁপা গলায় অবিশ্বাসির দৃষ্টি নিয়ে বললো, কিন্তু..কিন্তু, আপনি তো এখন..
হ্যাঁ, পুড়ছি। আধুনিক চুল্লীর ভেতর রগরগে আগুনে পুড়ছি। ভুল বললুম। পুড়ছে। আমার খোলসটা। আমি এখন এখানে, তোমার পাশে।
বাঁচা আর মরার মধ্যে এইটুকুই ফারাক। বেঁচে থাকলে দেহ আর আত্মার একত্র বাস। মরে গেলে দেহ আর আত্মার বিচ্ছেদ। এখন আমি বিদেহী।
শ্যামল হতবিহ্বল হয়ে শুনছে, তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে।
দাশুবাবু শ্যামলের চোখ মুখের অবস্থা দেখে আবারও হেসে বললেন, ওহে শালাবাবু, ঘোর কাটাও, স্বাভাবিক হও।
এতই সহজ! স্বাভাবিক হও। কী করে হবো শুনি। এতদিনের ধারণা, বিশ্বাস, অবলীলায় ধুয়ে মুছে ফেলা যায়? ইয়ার্কি নাকি, ফাজলামো হচ্ছে?
এই মশাই সত্যি করে বলুন তো কে আপনি? কেন মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছেন, কী মতলব?
শ্যামলের গলায় মোটামুটি তেজ ছিল, তবুও কুন্ঠিত। ইদানিং কালের বাঙালি স্বভাবের মতো। ঘরে বাঘ, বাইরে নেংটি ইঁদুর।
দাশুবাবু আবার হাসলেন। মুচকি হাসি। কেমন যেন কবি কবি হাসি। হাসি অথচ হাসি নয়। যেন ভাবের ঘোর।
সেই এক কবি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। বললুম, ভাই চা খাবে একটু, চলো। কবি বন্ধু আমার উদাস কন্ঠে ওই রকম হেসে বললো, চা? ও..চা, মানে খেলেও হয়, না খেলেও হয়।
যাইহোক, দাশুবাবু বললেন দ্যাখো শালা বাবু। তুমিই আমার অন্তিমকালের একমাত্র শেষ সঙ্গী।
তাই আমার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সব তোমর নামে উইল করে দিয়েছি। সেই সবকিছুর এখন তুমিই মালিক।
শ্যামল মনে মনে বললো, দুর মশাই, আমাকে ছাড়া আর কাকেই বা দিতেন। ত্রিভুবনে আছে কে আপনার?
এই হলো মানুষের মন। কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। কেবল সৌজন্যের চাটুকারিতা আছে।
তাই মুখে বললো, আমি তো আপনাকে বারণ করে ছিলাম দাশুদা। আমি কী ওসবের মর্যাদা দিতে পারবো। কোনও ভালো আশ্রম কিংবা মঠে দান করে দিলেই ভালো হতো।
দাশুবাবুর ঠোঁটে আবারও সেই হাসি। বললেন, বেশ তো। তোমার যদি তাই মনে হয়, করবে। সে সুযোগ তো তোমার হাতে রইলোই।

পথের মাঝে কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট, বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছে। মৃদুমন্দ বাতাসে প্রজাপতির ডানার মতো পিরপির করে নড়ছে। পড়বি তো পড় ন্যাপার চোখে। ব্যাস, আর যায় কোথায়। এদিক সেদিক আড়চোখে দেখে নিয়েই সটান পকেটে চালান। তারপরেই সদগতি।
হালকা করে চুল্লু মেরে, খানিকটা মাংস কিনে, বউয়ের সামনে ফেলে দিলো, ঝপাৎ। বউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এ সব নিয়ে এলে, টাকা পেলে কোথায়?
ন্যাপা দুলকি চালে বডি নাচিয়ে বললো, ভগবান দিয়েছে। যাও, মালটা কষে রাঁধো দেখি।
এই হলো পোড়ে পাওয়া ষোলো আনা।
পেলে ছাড়াছাড়ির কোনও সিন নেই। ভোগ করো , আয়েস করো। পরের ধনে পোদ্দারি করো। কিন্তু মুখে সাধু-সন্ত বুলি আওড়াও। ফোকটায় বাণী বিতরণ করো।
তবেই তো তুমি মনুষ্য পদবাচ্য। সম্মানীয় জ্ঞানী। পাড়ার ক্লাবের নিষ্কর্মা সভাপতি।

শ্যামল এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। জ্ঞানী মানুষের মতো ঠোঁট উল্টে বললো, ঠিকই বলেছেন। কী হবে এসব? সবই অনিত্য। এই আছে, এই নেই। খালি হাতে আসা, খালি হাতে যাওয়া। একটা দীর্ঘশ্বাস।
দাশুবাবু আআড়চোখে, এক আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে শ্যামলের মুখের দিকে। ঠোঁটে সেই মায়াবী কবি কবি হাসি। তারপরেই আচমকা ধমকে উঠলেন, দূর শালা। মানে শালাবাবু, এসব বাজে কথা। আমি বলছি শোনো, লোটা নিয়ে আসা, কম্বল বগলে যাওয়া। লোটা কম্বল নাতিদীর্ঘ জীবন।
শ্যামলের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী? মাথায় কিচ্ছু ঢুকলো না, তাই না? আরে বাবা অভিজ্ঞতা। এতো বচ্ছর যেখানে ছিলুম, সেইখান থেকেই অর্জন করা অমূল্য অভিজ্ঞতা।
লোটা মানে পেট, মানে খিদে। ভোগ, লালসা, কামনার খিদে নিয়ে এসেছিলুম। আর অছেদ্দা, লাঞ্চনা, অপ্রাপ্তির ক্ষেদ দিয়ে বোনা কম্বল বগলে, করুণ সুরে ভক্তিগীতি গাইতে গাইতে নিষ্ঠুর প্রস্থান। হা হা হা..
মন চলো নিজ নিকেতনে। কী হলো, মাথায় ঢুকেছে এবার?
শ্যামলের পিঠে জোরে জোরে দু’টো চাপড় মেরে, আকাশ কাঁপিয়ে হা হা হা করে হাসতে হাসতে হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেলেন দাশরথি দাশ।

শ্যামল চোখ খুলে দেখলো, সামনে ডোম দাঁড়িয়ে আছে। বাবু কী ঘুমিয়ে গেলেন? কাম তো সারা হো গিয়া বাবু। ও ছাই ভসম জোলে দিবেন তো?
আসুন আসুন, বহৎ দের লাগিয়ে গেলো, জলদি আসুন বাবু।
শ্যামল বহমান গঙ্গার দিকে তাকিয়ে, মনে মনে উচ্চারণ করলো, ঠিক বলেছ ভাই এক্কেবারে ঠিক বলেছ। দেরি হয়ে গেল, বড্ড দেরি।

Loading

Leave A Comment