আমার স্কুলে শিক্ষক দিবস
– অঞ্জনা গোড়িয়া
আমার প্রিয় দিদিরা,
আমি অঞ্জনা। জানি আজ হয়তো কারোর মনে নেই। আমি আপনাদের সেই অঞ্জনা। কেমন আছেন দিদিরা?
আপনাদের সবার উদ্দেশ্যে আমার এই চিঠি।
সবারে জানাই আমার অনেক অনেক ভালোবাসা ও শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা।
আমি জানি না আপনারা কতটা ভালো আছেন? আজ আমি অনেক দুরে। তবে মনের থেকে দুরে কোনোদিনও নয়। এখন আমি পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে সংসারী হয়েছি। মা হয়েছি। আর হয়েছি দিদিমনি। হ্যাঁ, আমিও আজ দিদিমনি। এ আমার গর্ব। আমার ভালোবাসা আমার স্কুল। আমার ছাত্র ছাত্রীরা।
আজ লিখছি স্কুল জীবনের শিক্ষক দিবসের কথা। দেখুন তো সবার মনে আছে কিনা? শিক্ষক দিবস—
সকাল থেকে বৃষ্টি। একটুও বিরাম নেই।
অথচ এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে আছি সেই কবে থেকে।
যেতেই হবে স্কুলে। কোনো বাধাই মানবো না। আমি যাবোই। মা রান্নাঘর থেকে হেঁকে বলে ওঠে। এত জল বৃষ্টির দিনে স্কুল কি যেতেই হবে? সেই তো ক্লাস হবে না। আজ নাকি কিসের পালনীয় দিন?
হ্যাঁ মা। আজ শিক্ষক দিবস। আমাদের শ্রদ্ধেয় দিদিদের বরণ করার দিন। শিক্ষকদের সম্মানিত করার দিন। আজ যেতেই হবে মা।
সেই বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম স্কুলে। তখন আমি নবম শ্রেণি। মনে দারুন আনন্দ। এ বছরই শিক্ষক দিবসের পুরো দায়িত্ব নবম শ্রেণির ওপর। নিজেদেরই মাথা খাটিয়ে অনুষ্ঠানটা সাজাতে হলো।
প্রথম তিন পিরিয়ড ক্লাস। তারপর শুরু মূল অনুষ্ঠান।
ক্লাস ফাইভ থেকে দেখে আসছি প্রত্যেক বছর এই দিনে উঁচু ক্লাসের দিদিরা ক্লাস নিতে আসে। ক্লাসের উপস্থিত দিদিমনিকে প্রণাম জানিয়ে শুরু করে ক্লাস।
খুব মনে আছে মীনাদি কি সুন্দর করে ভূগোল পড়া বুঝিয়ে ছিল। ঠিক যেন ভাবি দিদিমণি। সত্যিই এখন স্কুল টিচার। আমাদের দিদিমনিরাও ওদের পড়ানোতে ভীষণ খুশি।
এবছর আমিও নেব ক্লাস।
কি ভীষণ উত্তেজনা মনে। দিদিদের সামনে বসিয়ে আমরা ক্লাস নেব নিচু শ্রেণীদের। এক দিকে ভয় অন্য দিকে আনন্দ।
আমি নিয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেনীর ইতিহাস। মুঘল সাম্রাজ্য। ইতিহাস আমার বরাবরই প্রিয়। অতীত ঘটনা জানতে ভীষণ ভালো লাগে। ইতিহাস দিদি মুকুলিকাদির পায়ে প্রণাম করলাম। দিদি আশির্বাদ করে বললেন, ভয় পেও না অঞ্জনা। আমি তো আছি।
এই একটা কথাই মনের উদ্যম শতগুণে বাড়িয়ে দিল।
খুব মনে পড়ছে সেই দিনটা। যখন মুঘল সামাজ্যের সম্রাটদের নাম মুখস্থ করার সহজ উপায় বলে ছিলাম ছোটোদের কাছে৷ কি খুশি তারা।
” বাবার হলো আবার জ্বর,সারিল ঔষধে”। বাবর, হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর, সাজাহান, ঔরঙ্গজেব।” সহজ পথে সহজ উপায়। মনে রাখার। মুকুলিকাদি মুচকি হেসে বলে ছিল তুমি ইতিহাস নিয়েই পড়ো। ভবিষ্যতে দিদিমণি হয়ে এভাবেই পড়িও। আমার আশির্বাদ সব সময় তোমার সাথে।
মনের সুপ্ত ইচ্ছেটা দিদির মুখে শুনে চোখ দু’টো উজ্জ্বল হয়ে উঠে ছিল।
সেই প্রথম ক্লাস নেওয়া। দিদিদের সম্মানার্থে।দারুণ এক অনুভূতি।
ভবিষ্যৎ শিক্ষিকা হওয়ার প্রথম ট্রেনিং।
তারপরই বড় একটা হল ঘরে শুরু হলো শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান।
সমস্ত শিক্ষিকাদের বরণ করে নেওয়া হলো। আমরা প্রতি ক্লাস থেকে চাঁদা তুলে দিদিদের জন্য একটা করে উপহার তুলে দিলাম।
এই দিনটা আসলে শিক্ষাগুরু শ্রী সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের জন্মদিন। তাই সেই মহান শিক্ষাগুরুকে মালা পরিয়ে প্রদীপ জ্বেলে সম্মান জানানো হয়। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়া। খবরের কাগজ পড়ে দিদিদের সাহায্যে দু’পাতার বক্তৃতা রাখলাম। হাত থরথর করে কাঁপছে। ভীষণ ভয় করছে। তবু পারতেই হবে। কি করে বলবো জানি না। দিদিমনিদের সামনে দিদিদের কথা বলার সুযোগ এই প্রথম। সত্যি বলতে জীবনের এই প্রথম ভাষণ দিলাম। তাই এটুকু বলতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।
তারপর স্কুলের মেয়েরা নাচ গান আবৃত্তি ছড়া নাটক সবই করলো পরপর। আনন্দ সহযোগে।আমার স্কুলটা আসলে বালিকা বিদ্যালয়। স্যার কেউ ছিল না।
এ বছরই ছিল আমাদের প্রিয় মীরাদির বিদায়ী বছর। তাই এই আনন্দ মুহুর্তেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মীরাদি। আমাদের জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তোদের ছেড়ে কি করে বিদায় নেব? এ যে বড্ড কষ্টের দিন।
ঠিক তাই। একদিন সবাইকেই ফিরে যেতে হবে যে যার স্থানে। মেনে নিতে হয় সবই।
নিয়মের বাইরে আমরা কেউ নই। তবু চলে যাবার দিন বড়ো কষ্ট।
আজও শিক্ষক দিবস এলেই মনে করিয়ে দেয় সেই দিনগুলি। মনে করিয়ে দেয় কান্না হাসির মজার স্কুলের স্মৃতি। দিদিমনিদের সাথে ছিল আমাদের বন্ধুর সম্পর্ক। আজও ভুলিনি মুকুলিকাদি, শেলি দি, বড়দির হাসি খুশি মুখটা।
আজও ভুলিনি নীলিমাদির আদর মাখা বকুনি। আজও মনে আছে করুনাদির ভালোবাসা। আল্পনাদির প্যারেড রাধাদির মিষ্টি মুখটা। তাই এই দিনটা আমার খুব স্মরণীয় একটা দিন।
চিরকাল এভাবেই মনে রাখবো। যে যেখানেই থাকুন। খুব ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু দুরে। তাদের প্রতি রইলো আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
আজ এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ। ছাত্রছাত্রীরা গৃহে আটকে। শিক্ষকরা নিরুপায়। আবার সব কিছু স্বাভাবিক হোক খুব শীঘ্রই। আবার দেখা হবে সবার সাথে খুব শীঘ্রই।
ইতি —-
তোমাদের অঞ্জনা