পাঁচুদার সাধুসঙ্গ
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়
পাপী হইতে সাবধান। লাও ঠ্যালা। কীভাবে বুঝবো কে পাপী কে পুণ্যবান।
কোনও চিহ্ন আছে কী? কেউ কপালে সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখে না। বাসের সহযাত্রী। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কোন ফাঁকে সুযোগ বুঝে পকেট থেকে মানিব্যাগ নিয়ে হাওয়া। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ ব্যক্তিটি দুরাচারী ছিল, বুঝতে পারার উপায় কী?
পাহাড়ের কোলে ধুনী জ্বালিয়ে বসে আছে সাধুবাবা। কনকনে ঠান্ডায় উদোম মহাসাধক, জটাজুটধারী, ইয়া বড় দাড়ি, মহাসাধনায় রত।
সাধুবাবা মাত্রই ধুনী জ্বালে কেন কে জানে। মনে হয় গাঁজার ছিলিম সাজাতে আগুন পেতে সুবিধে হবে।
এটা গেল এক, আর শীতে আগুন পোহাবার জব্বর ব্যবস্থা। কেউ কেউ রান্নার ব্যাপারটা ওতেই সারে। রোস্টেড আলু, বেগুন পোড়া মন্দ হয় না। দুমুঠো চালও সেদ্ধ করা যেতে পারে।
সুতরাং বোঝা গেল, ধুনী আবশ্যিক। কিন্তু, এটা বোঝা গেল না, আধ্যাত্বিক সাধনার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক। আচ্ছা, এটাকে নেগেটিভ সাইন বলা যায় কী। হয়তো !
গঙ্গার ধারে বিশাল সাধুর সমাবেশ। গন্তব্য ঠিকানা গঙ্গাসাগর। এখানে, নানান প্রান্ত থেকে এসে মিলিত হয়ে পুণ্যযাত্রা হবে। টিভিতে সেই খবর দেখে, পাঁচুদা চললো। একসঙ্গে এতো সাধু জমায়েত। না দেখলে আফসোস থেকে যাবে।
পাঁচুদা হাজির। ব্যাপার স্যাপার দেখে, পাঁচুদা ভিরমি খাবার যোগাড়। চারিদিক ধোঁয়ায় ভর্তি। সারিবদ্ধভাবে বসে আছে, নানান চেহারার সাধুবাবা। কেউ ল্যাঙট পরিহিত, খালি গা। কেউ কেউ সম্পুর্ণ উদোম অবস্থা, নাগাবাবা। কিন্তু প্রত্যেকের সামনে ধূমায়িত ধুনী। পাশে রাখা ফুট তিনেক লম্বা চিমটে আর ত্রিশূল।
ভক্ত সমাগম ভালোই হয়েছে। ভক্ত, নাকি, কৌতুহলী জনতা!
একজন সাধুর সামনে অনেক লোকের ভীড় দেখে, পাঁচুদা সেই দিকেই গেল। ভীড়ের ফাঁক ফোকর খুঁজে ঠেলেঠুলে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দ্যাখে, একেবারে উলঙ্গ নাগাবাবা, সারা গায়ে ভস্ম মেখে জটাজুট নিয়ে চিমটে হাতে ধুনী জ্বালিয়ে বসে আছে।
একেই বলে কপাল।
সেই সাধুবাবার, নেশায় লাল হয়ে যাওয়া চোখ, বাঁইবাঁই করে চারিদিকে ঘুরছে। হঠাৎ পাঁচুদার চোখে চোখ পড়তেই, পাঁচুদার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। পাঁচুদাও সেই দিকে তাকিয়ে আছে।
আচমকা, সাধুবাবা পাঁচুদার দিকে চিমটে উঁচিয়ে, চিৎকার করে কাছে ডাকলো।
_ তু তু, হাঁ, তু..আজা মেরে সামনে আজা..
সেই ডাকের মধ্যে কী ছিল কে জানে, পাঁচুদা ভীড় ঠেলে ধীর পায়ে সাধুবাবার সামনে গিয়ে বসলো। এতো লোক থাকতে, আমাকে কেন? কী দেখলো আমার মধ্যে, নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু দেখেছে, নইলে আমাকে ডাকবে কেন! পাঁচুদা মনে মনে শুধু গর্বিতই নয় রোমাঞ্চিতও বটে। সকলের চোখ এখন পাঁচুদার ওপর আটকে আছে। এবার কপাল খুলবে নির্ঘাত। যাক, এখানে আসা সার্থক।
_ তেরা তকদির চমক রাহা হ্যায়..তু কৌন হ্যায় বেটা!
পাঁচুদার চোখের পলক স্থির। মন, দোটানায় দুলছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল।
_ আমি পাঁচু, প্রণাম বাবা..
গলা কাঁপছে।
_ তু, বহুত বড়া আদমি বনেগা, কোই নেহি রোক সকতা। বাবা ভোলেনাথ হ্যায় তেরে সংগ। ইয়ে লে, বাবা কা আশীর্বাদ, তেরে আচ্ছে দিন আগয়া..
ধুনী থেকে একমুঠো ছাই নিয়ে, পাঁচুদার কপালে ঘষে দিলো। যা বেটা তেরা মন কা ইচ্ছা, তুরন্ত সফল হোনে বালা হ্যায়।
পাঁচুদা কমপ্লিটলি ইম্প্রেসড। এতো লোকের মধ্যে থেকে, শুধুমাত্র তাকে ডেকেই বা সাধুবাবা আশীর্বাদ দিলেন কেন! নিশ্চয়ই তার মধ্যে এমন কিছু দেখেছেন, যা সাধারনের মধ্যে থাকে না, দিব্যদৃষ্টি দিয়ে সাধুবাবা নিশ্চয় তাই দেখেছেন এবং ডেকেছেন।
ধন্য, ধন্য সাধুবাবা। তুমি অন্তর্যামী। তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম।
সাধুবাবার পায়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ঠুকে, তার সামনে হাঁটু মুড়ে, হাতজোড় করে বসলো,
সাধুবাবা কটমট করে তাকিয়ে, লম্বা সরু হাত বাড়িয়ে দিলো। হাতের তালু, ধুনীর ছাইয়ের মতো কালচে। পাঁচুদা বিহ্বল হয়ে বসে আছে, আরও ভবিষ্যবাণী শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু না। এবার এলো সাধুবাবার হুংকার,
_ দে, তেরে পাশ যো কুছ ভি হ্যায় দে দে, নেহি তো ভোলেনাথ বিগড় যায়েঙ্গে, জলদি কর, দে দে, সবকুছ দে দে..
পাঁচুদা ভয়ে ভয়ে, টাকা, ঘড়ি, সোনার আংটি, একে একে সব দিয়ে দিলো।
সাধুবাবা মহাখুশি হয়ে, লম্বা চিমটেটা পাঁচুদার মাথায় তিনবার ঠেকিয়ে দিয়ে বললো,
_ বহুত আচ্ছা বেটা, ভোলেনাথ খুস হুয়া,
ইয়ে সব তেরা আচ্ছে দিন পানেকা দখছিনা হ্যায় বেটা, বোল বেটা, যো ইচ্ছা মাঙ, মাঙলে বেটা, মাঙ,,
পাঁচুদার হঠাৎ কী হলো কে জানে, বললো, যা চাইবো দেবে তো?
_ আরে বেটা মাঙ্ কর তো দেখ,
_ ঠিক আছে, তাহলে এক্ষুনি তোমাকে যা যা দিয়েছি, সব ফেরৎ দাও।
সাধুসঙ্গ করো, সৎসঙ্গে সঙ্গত করো। ঋষি বাক্য। আরে মান্যবর, আপনি তো বলেই খালাস। জ্ঞান দেওয়া আর জ্ঞান পালন করা, এককথা নয়।
কে সাধু, কে সৎ, বুঝতে পারার উপায় কী? দয়াকরে একটু বুঝিয়ে দিন দেখি। বুঝবো ক্ষ্যামতা। এ দুনিয়া পালটি খেতে ওস্তাদ। কে কখন কোথায় কোন মওকায় ভোলবদল করবে, শিবের বাবাও টের পাবেনা।
পাঁচুদা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ধম্মে কম্মে মতি আছে। সুযোগ সুবিধে মতো তীর্থভ্রমণ করে। সেবার চলে গেল কেদারনাথ দর্শনে। অনেক দিনের ইচ্ছে-পূরণ হলো। পুজো আচ্চা দর্শন হলো। দর্শন হলো অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। দুপুরের দিকে হঠাৎই তার কি খেয়াল হলো, মন্দির চত্ত্বর ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলো সেই দিকে, যে দিকে সাধারণত কেউ যায় না। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অন্য কিছুর সন্ধানে যেন তার এই চলা। নিজেই জানে না কোথায় চলেছে, কেন চলেছে, কিসের সন্ধানে! কে জানে কার জন্যে কোথায় কি নৈবেদ্য সাজানো আছে। তার হদিস কেউ পায়, কেউ পায় না। এই মায়াময় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে কতই রহস্য রত্নভান্ডার। তার কতটুকুই বা উন্মোচিত হয়।
একটা গুহা। মাথা অল্প নিচু করে সেই গুহামুখ দিয়ে গুহার ভেতর প্রবেশ করাই যায়। কিন্তু একটু রিস্ক থেকে যায়। বলা যায় না, এই জনমানবহীন পাহাড়ি গুহার অন্দরে কোনও বিপদ লুকিয়ে থাকা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। তবুও, মানুষের কৌতুহলী মন। বাগ মানতে চায় না। পাঁচুদার সঙ্গেও তাই হলো। পাঁচুদা ভেতরে ঢুকলো না, শুধু মুন্ডু বাড়িয়ে গুহার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা গেল না। প্রবল ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে কিছুক্ষণ গুহামুখের সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এবার কেমন যেন ভয়ভয় করতে লাগলো। একে সম্পুর্ণ অজানা জায়গা। একেবারে নির্জন। কেউ এদিকে আসে না। আসবার কোনও কারণও নেই। না মন্দির, না দোকান, না হোটেল, আশ্রম বা ধর্মশালা। কিছুই নেই। আছে বিশাল হিমালয়, আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শুধুমাত্র তার টানে যদি কেউ আসে, তবে সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ তীর্থ বলতে বোঝে, মন্দির, দেবতাদের মূর্তি, পুজো, মানত, ইত্যাদি। এইসবের টানেই তীর্থে আসা। কিন্তু, এর বাইরেও যে অসীম দেবমাহাত্ব চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে, তার খবর ক’জন রাখে।
প্রবল ঠান্ডা বাতাস বইছে। যতগুলো শীতের পোষাক এনেছিল সবই গায়ে মাথায় চাপানো হয়ে গেছে। তবুও মনে হচ্ছে আরও কিছু চাপাতে পারলে ভালো হতো। দরকার নেই বাপু, আশ্রমে ফিরে যাওয়াই মঙ্গল, কেন না, বিকেল হয়ে গেছে। পাহাড়ে ঝপ করে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদল করতে হলো পাঁচুদাকে।
সেই গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক সাধু। তার শরীরে একটি সুতোও নেই। নাগাসাধু, জটাজুট ধারী, সাদা লম্বা দাড়ি। শরীরের প্রত্যেকটা হাড় এক দুই তিন চার করে গোনা যাবে। গাল দু’দিকে দুটো বাটির মতো। চোখ কোটরাগত। কিন্তু চোখের মনি দুঊটো সন্ধ্যা তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। বয়স আন্দাজ করা খুবই কঠিন। সত্তর কিংবা চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ, সবই সম্ভব।
_ কৌন হো..
গলার আওয়াজ ব্যক্তিত্বে ভরা। তবে শ্লেস্যাজনিত ঘড়ঘড়ে শব্দ মিশে আছে।
পাঁচুদার পলক পড়ছে না। একি, অদ্ভুত দর্শন! সাধু, অনেক দেখেছে পাঁচুদা। কিন্তু এঁর মধ্যে অন্যরকম একটা আকর্ষণ আছে মনে হয়। নইলে পাঁচুদার হাত দুটো আপনা হতে জড়ো হয়ে বুকের কাছে উঠে আসবে কেন?
_ প্রণাম, বাবা,
পাঁচুদার এইটুকু উচ্চারণে গভীর ভক্তিভাব জাগ্রত হয়ে উঠেছিল।
_ বাংগালী হো?
_ হ্যাঁ বাবা, বাঙালি।
পাঁচুদা বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকেই তাকিয়ে রইলো। আসলে, চোখ ফেরানো কঠিন। এতোগুলো গরম জামা কাপড় দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে রাখা সত্বেও, পাঁচুদার সারা শরীর ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। অথচ সম্পুর্ণ উলঙ্গ এই মানুষটার কোনও হেলদোল নেই। সহজ স্বাভাবিক ভাবেই রয়েছেন। আচ্ছা, ওনার অনুভূতি বলে কোনও কিছু আছে তো? নাকি, বিকৃত মস্তিষ্ক! ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
সংসারী মানুষ, সংসার বোঝাপড়ার বাইরে গেলেই দিশা হারায়, হতচকিত হয়। পাঁচুদা ব্যতিক্রমী নয়।
_ আমিও বাঙালি ছিলাম ।
_ ছিলাম, মানে, এখন আর নেই..!
_ শুধু প্রাণ আছে, সেই প্রাণে একটাই নাম, ঈশ্বর। মুখে একটাই নাম, ঈশ্বর। একটাই বিশ্বাস, ঈশ্বর।আর কিচ্ছু নেই। সব ফাঁকা, সব ফাঁকি, সব মায়া প্রপঞ্চময়।
হর হর মহাদেব, জয় শিবশম্ভু, জয় কেদারনাথ।
_ আমি গুহাবাসী, তুমি গৃহবাসী। তোমার ভোগে সুখ, আমার ত্যাগে শান্তি। সুখ আর শান্তি, একঘরে বাস করে না। সুখের বাসনা ত্যাগ করলেই আসবে শান্তি। এই দেখ না, তুমি গরম পোষাকে সারা গা ঢেকেছো, কিন্তু নাক, কপাল, গাল, চোখ ঢাকো নি, কেন? কারণ, ওইটুকু জায়গায় ঠান্ডাকে বশে রাখবার ক্ষমতা তোমার আছে।
আমাকে দ্যাখো। সম্পূর্ণ আবরণহীন। সারা দেহই আমার ঠান্ডাকে বশে রাখবার ক্ষমতা রাখে।
গৃহবাসীও ত্যাগ করে, তবে তা নিতান্তই নগন্য। তোমার ওই মুখটুকু খুলে রাখার মতো। গুহাবাসী তপস্বীর সর্বস্ব ত্যাগ। বস্ত্র ত্যাগ প্রতীকী মাত্র।
কথাগুলো বলেই উনি ধীর পায়ে গুহার ভেতর চলে গেলেন। মনে মনে হতাশ হলো পাঁচুদা। খুবই ভালো লাগছিলো ওনার কথা। বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছিলেন। আরও কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে। এমন আচমকা উনি সভা ভঙ্গ করবেন বোঝা যায়নি। পাঁচুদা উপলব্ধি করলো, গৃহবাসী, পূর্ব মুহূর্তেও বুঝতে পারেনা, পর মুহূর্তে কী ঘটতে চলেছে। উনি আবার বাইরে আসবেন কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। কিছু বলে যাননি। যেমন আচমকা এসেছিলেন, তেমনই চলে গেলেন। এঁরা লৌকিকতার ধার ধারেন না। তথাকথিত সামাজিক সভ্যতা পালনের দায় এঁদের নেই। ত্যাগ অর্থে সর্বস্ব ত্যাগ। সমাজ, সংসার, নিয়ম, সংস্কার সব। এ এক অন্য জগৎ , যেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও দায় নেই। দলবাজির দৌরাত্ম্য নেই, রাজনীতির কুটকচালি নেই, ভোট নেই, ভোটার কার্ড নেই, আধার কার্ডের দুশ্চিন্তা নেই, আত্মীয় বিয়োগের ব্যথা নেই, সন্তানের দাগা দেওয়া নেই, প্রতিবেশীদের চুকলি নেই, ফাঁকিবাজি চাকরি নেই, অসৎ কারবারের জালিয়াতি নেই, অকেশনাল পুণ্যি পাবার আকুলিবিকুলি নেই, নাম যশের মোহ নেই, দূর্নীতি গ্রস্ত হয়ে গোয়েন্দা দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। ভক্তি আর বিশ্বাসে মোড়া এ জীবন, কেবল ঈশ্বরের কাছেই নত, আর কোথাও না।
বিকেল ঘনীভূত হচ্ছে। পাঁচুদা এবার ফিরে যাওয়াই উচিৎ বলে মনে করছে, ঠিক তখনই তিনি আবার গুহার বাইরে এলেন।
_ কী? কিছু বলবে? আমি কিন্তু হাতফাত দেখতে জানিনা। হা হা হা, ভেল্কি দেখাতে পারবো না।
পাঁচুদা কুন্ঠিত গলায় বললো,
_ না বাবা, সেসব নয়, আমার কিছু চাই না..
কথা শেষ করার আগেই সাধুবাবা বললেন,
_ কিছু চাই না, তাহলে এখানে এসেছিস কেন , কেদারনাথ এর কাছে। কী কামনা?
_ কোনও কামনা নেই, বাসনা আছে বাবা। এইদেশে জন্মেছি, তাই এই দেশটা দেখতে চাই। পৃথিবীটাকে দেখবার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। তাই আমার জন্মভূমিকে দেখতে চাই।
সাধুবাবা আরও গম্ভীর গলায় বললেন,
_ বহুত আচ্ছা,
গুহার পাশেই একটা পাথরের ওপর বসলেন। উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের মুকুট। একটা কমলা রঙের হেলিকপ্টার ফটফট আওয়াজ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। অর্থবান আর ভি আই পি ভক্তরা তাতে সওয়ার হয়ে দেব দর্শনে আসছেন আবার ফিরে যাচ্ছেন।
সাধুবাবা সেই দিকে তাকিয়ে বললেন,
তুই কী করে এলি?
পাঁচুদা হেসে বললো,
হেঁটে। একদম গৌরীকুন্ড থেকে হেঁটে। খচ্চরের পিঠেও নয়। ওতে অনেক খরচ। আমি গরীব মানুষ বাবা।
সাধুবাবা, একটু চুপ করে থেকে, কি যেন ভাবলেন। কপাল কুঁচকে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললেন,
_ পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। কিন্তু একসময় তাও ছিল না। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাথুরে ভাঙাচোরা পথ। হিংস্র জন্তুর ভয়। এখানে খাবার পাওয়া যেত না। চাল আটা সঙ্গে করে আনতে হতো। থাকবার আস্তানা বলতে গুটিকয়েক চটি। খাটিয়া আর কম্বল মিলতো সেখানে। তবুও ভক্তজন আসতো।
এবার চোখ খুললেন। লাল টকটকে। যেন চোখের তারায় আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে বললেন,
তখন ছিল তীর্থস্থান, এখন মস্তিস্থান। মজা পেতে আসে। ব্যবসা ব্যবসা, চারিদিকে ব্যবসা। কত হোটেল, দোকান। বিজলী বাতির ঝলকানি। হেলিকপ্টার,,
পাঁচুদা সাহস করে বললো,
ভালই তো, বেশ উন্নতি হচ্ছে। মানুষ একটু আরাম করে আসছে থাকছে খাচ্ছে। ক্ষতি কী?
_ ক্ষতি! বহুত ক্ষতি। দেবভূমিকে ব্যবসা ভূমি, মস্তি ভূমি বানিয়ে দেবে, ক্ষতি নয়?
নাগাবাবা বেশ উত্তেজিত হয়ে গেছেন। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
_ তুমি কেন এসেছ? ভক্তি নাকি মস্তি?
পাঁচুদা, নাগাবাবার ভৈরব মূর্তি দেখে একটু ভয় পেয়েছে। ঢোঁক গিলে, আমতা আমতা করে কী যেন বলতে গেল, কিন্তু বলা হলো না। সাধুবাবা উত্তেজিত নাগাড়ে বলতে লাগলেন,
তুমি কি মনে করো এইটা বিকাশ। হেলিকপ্টারে দেবদর্শন বিকাশ? এতো হোটেল, দোকানপাট, ব্যবসা, কিসের বিকাশ? ভক্তিহীন, বিশ্বাসহীন স্থান, কখনও দেবতার আবাস হতে পারে না। এখানে কোথাও দেবতা নেই। ওই মন্দিরে তিনি আছেন? নেই। ওই পাহাড়ে? নেই বরফচূড়ায়? নেই এই গুহায়? নেই, তিনি কোথাও নেই।
তিনি আছেন মনে, আত্মায়, বিশ্বাসে আর ভক্তিতে।
তুমি যাকে বলছ বিকাশ, আমি তাকে বলছি বিনাশ, বিনাশ, বিনাশ।
দেবভূমি এখন নরক ভূমি। পাপ, লোভ লালসার লীলাভূমি। এর বিনাশ অনিবার্য। অনিবার্য বিনাশ।
শুধু মন্দির আর দেবমূর্তি থাকবে, আগে যেমন আগে ছিল। বাকিসব ধ্বংস হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
তিনি আসছেন, তিনি আসছেন। নটরাজের প্রলয় নাচন আসন্ন প্রায়। পালাও পালাও সব। নইলে মরবে। সব মরবে, ভাগ যাও ভাগ যাও,
প্রবল উত্তেজনায় তাঁর সারাশরীর থরথর করে কাঁপছিল। যেন এক জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ছোঁয়া লাগলে ঝলসে যাবে সমগ্র জগৎ। জলন্ত আগ্নেয়গিরি প্রবল বেগে গুহার ভেতর চলে গেলেন।
ওই জ্বালামুখ আগ্নেয়গিরির সামনে, পাঁচুদা নিজেকে আর নিরাপদ মনে করলো না। জনমানবশূণ্য সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশের বাইরে চলে আসাই শ্রেয়।
সন্ধ্যা আসন্ন। আকাশে ঘনকালো মেঘের দুরন্ত আনাগোনা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা, সমস্ত পরিবেশকে যেন আরও ভয়াল করে তুলেছে।
পাঁচুদা, কেদারনাথ মন্দিরের সামনে হাত জড়ো করে দাঁড়ালো। মন্দিরে তখন সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। কাঁপন ধরানো ঠান্ডায়, কয়েক’শ ভক্তের মাঝে দাঁড়িয়ে, কাঁসর ঘন্টা দুন্দুভি আর হর হর মহাদেব ধ্বনির মিলিত আওয়াজকে ছাপিয়ে, তার কানে ভেসে আসছে নাগাবাবার কন্ঠস্বর,
পালাও পালাও সব, নইলে মরবে। সব মরবে।
অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
একি নিছক প্রলাপ, নাকি অভিশাপ? কিসের অশনিসংকেত?
পাঁচুদা মনস্থির করেই ফেললো, কাল সকালেই পালাবে। এখানে আর কিছুতেই থাকা নেই।
সন্ধ্যেবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টিভিতে খবর দেখা প্রায় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটা খবর দেখে চমকে উঠলাম। কেদারনাথে ভয়ঙ্কর হরপা বানে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। মন্দির আর দেবমূর্তি ছাড়া সবকিছুই প্রবল বানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ, বাড়ি ঘর জলের ধাক্কায় ভেসে গেছে।
মন ভীষণ রকম ভারী হয়ে গেল। কেদারনাথ আমার বড় ভালোলাগার জায়গা। হঠাৎ বুকটা ধরাস করে উঠলো। আরে, পাঁচুদা কেদারনাথ গিয়েছে না? সর্বনাশ! চায়ের কাপ ফেলে লাফ দিয়ে উঠে ফোন করলাম। জয় কেদারনাথ। ফোন বাজছে।
হ্যালো, কে পাঁচুদা। ওফ,
ফোনের ওপারে পাঁচুদা হা হা করে হেসে বললো,
না হে ব্রাদার মরিনি। কালকেই ফিরেছি। এ যাত্রায় খুব বাঁচান বেঁচে গেছি। এক মহান সাধুর দয়ায়।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
সাধু? কে সাধু?
ওপার থেকে পাঁচুদার উত্তেজিত কন্ঠস্বর,
আছে আছে। সব বলবো। শুধু শুনে রাখ, পৃথিবীতে এখনো কিছু আসল মধুও আছে, সত্যি সাধুও আছে। সব ভেজাল নয়।
অহংকার আর অভিমান ভরা জগতের পরিণাম দেখাচ্ছে টিভিতে। দেখছি আর শিখছি। দু’দিনের অতিথি রে ভাই, এ মায়া প্রপঞ্চময়, পারলে তুইও শেখ, রাখলাম।
ফোন কেটে গেল। আমি হতবাক।