অন্য পৃথিবী
-রীণা চ্যাটার্জী
সুধী,
অভিজ্ঞতা একটা সময় গল্প হয়। একজনের মুখ থেকে আর একজনের মুখে.. ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ে তার সুবাস- অভিজ্ঞতার সুবাস।
এমনি এক অভিজ্ঞতার গল্প খুব বলতে ইচ্ছে করছে। না, অভিজ্ঞতা আমার নয়- আমারো শোনা গল্প। অভিজ্ঞতা যাঁর, তাঁর মুখ থেকেই শোনা, আমার কাছে হয়তো একটি গল্প। ‘কোরাস’ একটি এন.জি.ও-র প্রধান উদ্যোক্তা- পল্লব ব্যানার্জী। কথা হচ্ছিলো তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে- জানতে চাইছিলাম তাঁর কাছে, বলছিলেন অনেক কিছুই। জানতে পারছিলাম অসহায় মানুষগুলোর কথা। হঠাৎ পাশে একটি স্থানীয় মানুষ এসে দাঁড়ালেন চোখে সম্ভ্রম, কৃতজ্ঞ দৃষ্টির মিশেল চাহনী। বেশভূষা, চোখমুখ বলছিলো ভালো নেই উনি। পল্লব বাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মেয়ে কেমন এখন? ঘাড় নাড়লেন মানুষটি, চোখের কোলে জল। পল্লব বাবু বললেন, কোনো অসুবিধা হলে সাথে সাথেই বলবে আমাকে।
মেয়েটির ক্যান্সার- চলনশক্তি নেই। বস্তির গুমোট ঘর থেকে বেরোতে পারতো না- কাঁদতো। পল্লব বাবু একটি হুইল চেয়ার কিনে দিয়েছিলেন ওকে। তাতে বসে ওর বাইরে আসা। উনি বলছিলেন, সে যে বাচ্চা মেয়েটির কি আনন্দ.. আপনাদের বোঝাতে পারবো না। মারণ রোগের সাথে বেশীদিন যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই ওই ছোট্ট শরীরে, তবুও বাইরের হাওয়া, আলো মেয়েটিকে রোজ নতুন করে আনন্দ দেয়। চোখে জল তো আমাদেরও এলো। সেই প্রসঙ্গে উনি আরো একটি ঘটনা বললেন। ঝড় বিধ্বস্ত সুন্দরবনে ত্রাণ নিয়ে গেছিলেন ওঁরা। সেখানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন বললেন তেমন বললেন একটি মধ্য ত্রিশের মহিলার কথা। কোমর থেকে পা অব্দি নাড়াতে পারেন না, গৃহবন্দী প্রায় কয়েক বছর। ওখানের স্থানীয় ছেলেদের অনুরোধে একটি হুইল চেয়ার নিয়ে গেছিলেন তিনি। সারাদিনের ধকল, আবহাওয়ার প্রতিকূলতা, রাজনৈতিক তরজায় ক্লান্ত শরীরে ওই ভদ্রমহিলার দরজার সামনে দাঁড়ান। হুইল চেয়ারটিতে তার পরিবারের লোকেরা তাকে বসিয়ে দেয়- একসাথে হাসি-কান্না দুই তার চোখে মুখে মাখামাখি হয়ে গেছিল। শিশুর মতো পাক খাচ্ছিলেন চেয়ারে বসে। পল্লব বাবু বললেন- একটি মার্সিডিজ কেনার আনন্দ ফিকে হয়ে যায় জানেন এই ছোট ছোট খুশীগুলোর কাছে।
গঙ্গার ধারে সন্ধ্যার নিভন্ত আলোতেও জ্বলজ্বল করছিলো তাঁর চোখ অনন্য প্রাপ্তিতে। মনে হচ্ছিলো সেই মুহূর্তে ঈশ্বর মানে আশা, ঈশ্বরবাদী মানে আশাবাদী- ধর্ম, জাতি, সামাজিক ভেদাভেদের অনেক উর্ধ্বে। স্বার্থের দুনিয়ায়, জনপ্রিয়তার কাঙাল দুনিয়ায়, আত্মম্ভরিতায় ব্যস্ত দুনিয়ায় এ যেন এক অন্য পৃথিবী। মনের ঝুলিতে আরো এক প্রাপ্তি সেইদিন।
ফিরে আসি আলাপী মনের কথায়- নতুন কিছু বন্ধু আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের প্রয়াস, ভালোবাসা, পরিবারের একজন হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলোতে মনে হচ্ছে আমরা আবার কবে এক হবো এক ছাদের তলায়- শুরু হবে হাসি গল্পের পালা। পুরোনো, নতুনের ভালোবাসার এই মেলবন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চাই আজীবন- এই বন্ধনের নাম হোক আলাপী মন।
ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, শুভকামনা নিরন্তর।