শক্তি রূপেণ
– পায়েল সাহু
জ্ঞান ফিরতে নিজেকে একটা জলা জঙ্গলা জায়গায় আবিষ্কার করলো ঐশানী। ওঠার চেষ্টা করতেই সারা শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁপে উঠলো একবার। সময়টা ভোররাত নাকি সন্ধ্যে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। মাথাটাও যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাল ছেড়ে দিয়ে আবারও ওখানেই শুয়ে পড়লো ঐশানী। আস্তে আস্তে মনে পড়তে থাকে সব কিছু।
“মা আজ অফিসফেরত সবার জন্য দূর্গা পুজোর কেনাকাটি করে ফিরবো, কয়েকজন অফিসকলিগও যাবে” জুতো পড়তে পড়তে মাকে কথাটা বলে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ঐশানী। মনটা বেশ খুশি আজ তার। অভিকের সঙ্গে সম্পর্কটা খুব বেশিদিনের না হলেও খুব গাঢ় হয়ে উঠেছে অল্পকদিনেই, নিউটাউনের একই অফিসে চাকরি সূত্রে ওদের আলাপ। যদিও কেউ কারো বাড়িতে কাউকে কিছু জানায়নি এখনো। ঐশানী শপিং করতে যাবে শুনে অভিক বলে সেও তার বন্ধুদের নিয়ে পুজোর কেনাকাটির প্ল্যান করছে কদিন ধরে, তাহলে একসাথেই যাওয়া যাবে সবাই মিলে।
আজ শনিবার হাফ ডে।
গাঢ় নীল রঙের কুর্তি আর হালকা গোলাপী লেগিংসে মাখনের মতো গায়ের রঙের অপরূপা ঐশানীকে দেখে অভিক আর তার বন্ধুরা যেন কথা হারিয়ে ফেলে। অভিকের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় ছিলো না ঐশানীর, অভিকের মুগ্ধ দৃষ্টি উপভোগ করতে করতে নিজে থেকেই আলাপ করতে এগিয়ে যায় অভিকের বন্ধুদের সঙ্গে।
একটা অনলাইন app ক্যাব বুক করে ওরা সবাই উঠে পড়ে গাড়িতে। প্রচুর কেনাকাটার পর অভিকের এক বন্ধু প্রস্তাব দেয় প্রথমে কোনো রেস্টুরেন্টে রাতের খাবারটা খেয়ে বাড়ী ফেরা হবে। সেই মতো সবাই ঢুকে পড়ে বাগুইআটির সুসজ্জিত একটি বার কাম রেস্টুরেন্টে।
রাত ন’টা বেজে গেলেও অভিক বা তার বন্ধুদের কোনো তাড়া নেই দেখে ঐশানী একাই বাড়ী ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালে মদের নেশায় চূড়ান্ত নেশাগ্রস্ত অভিক ও তার বন্ধুরাআরো কিছুক্ষণ বসার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। কথা হয় ফেরার পথে ঐশানীকে আগে তার বাড়িতে নামিয়ে যে যার বাড়ী ফিরবে।
ফেরার সময় ট্যাক্সি এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় আসতেই হঠাৎ অভিক গাড়ি থামাতে বলে ড্রাইভারকে।
ড্রাইভার যথারীতি অসম্মত হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যের আগে গাড়ি থামাতে, সঙ্গে সঙ্গে অভিক সদ্য কেনা মদের বোতলটা দিয়ে আঘাত করে তার মাথায় আর গাড়ি কন্ট্রোল নিয়ে নেয় ড্রাইভারের পাশে বসা এক বন্ধু। খানিকটা অন্ধকার দেখে গাড়ি থামিয়ে ঐশানীর ওপর এক এক করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিক ও তার বন্ধুরা। ঐশানী কখন জ্ঞান হারিয়েছে সে জানে না।
এতক্ষণে সব মনে পড়তে কোনোমতে উঠে বসতেই দেখতে পায় কিছুটা দূরে দাঁড় করানো ট্যাক্সি। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছায় গাড়ির কাছে। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাওয়া ড্রাইভারকে দেখে ঐশানী যেন নিজের সমস্ত ব্যাথা ভুলে যায়। তাড়াতাড়ি নাকের কাছে হাতটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে মানুষটা বেঁচে আছে কিনা।
খুব সামান্য শ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করে। গাড়িতে উঠে কোনোমতে ব্যাগটা পেয়ে ফোন বের করে ডায়াল করে পুলিশ স্টেশনে।
দীর্ঘ পাঁচ বছর কেটে গেছে, সমাজ সংসারের তীব্র কটাক্ষ, কুৎসা সহ্য করে একা লড়াই চালিয়ে গেছে ঐশানী। এতো বছরের নিজের মা বাবা ছাড়া একমাত্র পাশে পেয়েছে সেদিনের সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যিনি সেদিন ঐশানীর চেষ্টায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। আজ কোর্টের রায়ে অভিক ও তার দুই বন্ধুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো।
আজ আবার ঐশানীর মনে পুজোর আনন্দ, অসুর দলনী দেবী দূর্গার আরো একবার অকাল বোধন আজ।