Site icon আলাপী মন

গল্প- উত্তরাধিকারী

উত্তরাধিকারী
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

ক্রিং, ক্রিং করে ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠতেই কেমন যেন গলা শুকিয়ে এলো অনিমার। পায়ের জোর হঠাৎ যেন কেমন কম হয়ে গেছে। তবু প্রায় কাঁপতে কাঁপতে এসে ফোনটা রিসিভ করলো। কাঁপা গলায় ‘হ্যালো’ বলা মাত্র অপর প্রান্ত থেকে একটা কান্না মেশানো কন্ঠ শোনা গেল- ‘বাবা আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ চলে গেলেন। তোরা তাড়াতাড়ি আয়।’
এই কথা বলেই ফোনটা কেটে দিল অনিমার দাদা অনুপম।
বেশ কয়েক মাস অনিমার বাবা অসুস্থ ছিলেন। কর্কট ব্যাধিতে আক্রান্ত। একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী মানুষটা এই ক’মাসে একেবারে বিছানার সাথে মিশে গেছে। অনিমা তো শেষের দিকে অমল বাবুকে দেখতে যাওয়াটাও ছেড়ে দিয়েছিল। দিনরাত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলেছে, ‘বাবা কে মুক্তি দাও। এই কষ্ট আর সহ্য করা যায় না।’
ওড়নার খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়ালো অনিমা। সুভাষ তখন ব্লাক বোর্ডে পার্টস অফ স্পিচ বোঝাচ্ছে তার গোটা কুড়ি ছাত্র ছাত্রীদের।
অমল বাবুর একমাত্র বড় আদরের জামাই সুভাষ কান্তি দত্ত। সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ইংলিশে মাস্টার্স। প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ। এছাড়াও সুভাষ নানা সমাজ সেবা মূলক কাজ কর্মের সাথে যুক্ত আছেন। তবে সুভাষ বাবু নিজের বিয়ের সময় নগদ পাঁচ লাখ টাকা বরপন নিয়েছিলেন অমল বাবুর কাছ থেকে। যদিও এক্ষেত্রে সুভাষ বাবুর কোনো ভূমিকা ছিল না। সুভাষ বাবুর বাবা তার সরকারি স্কুল মাস্টার ছেলের জন্য এই বিশাল অঙ্কের বরপনটা হেঁকে ছিলেন।
অমল বাবুও ব্যবসাদার লোক। উনিও হিসেবে কষলেন সরকারি পাত্রের সাথে তার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হলে মেয়ের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুই সুরক্ষিত। সুতরাং জামাইয়ের পিছনে ইনভেস্ট করাই যেতে পারে। ষাট বছরের চাকরি তারপর পেনশন। যদি হঠাৎ কোনো অঘটন ঘটে তাহলে অনিমাও অর্ধেক পেনশন পাবে। এক কথায় পাঁচ লাখের বিনিময়ে অমল বাবু অনিমার নিশ্চিত ভবিষ্যৎ কিনে নিয়েছিলেন।
অনিমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে সুভাষ বাবু তার কোচিং ক্লাস বন্ধ করে তাড়াতাড়ি স্কুটার বের করে স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন শ্বশুরবাড়ির দিকে। সেখানে এসে দেখে স্তব্ধ সব কিছু। সেরকম কান্নার রোল নেই। সবাই কেমন যেন গুম হয়ে রয়েছে।
অনিমার দাদা অনুপম গম্ভীর মুখে বলে, ‘যা, মায়ের কাছে গিয়ে বস। আমি শবদেহের গাড়ি ডেকে পাঠিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে যাবে। সুভাষ তুমি কি শশ্মানে যাবে? তোমার আবার তো স্কুলে পরীক্ষা চলছে।’
সুভাষ বাবু বলেন ‘না আমি যেতে পারবো না শশ্মানে। আজ আমাকে স্কুল যেতেই হবে।আজ থেকেই ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। খুব অসুবিধা হয়ে যাবে না আপনাদের?’
অনুপম বলে ওঠে, ‘অসুবিধা যা করার তা তো তুমি ভালোই করে দিয়েছো?’
সুভাষ বাবু কথাটা শোনা মাত্র তো আকাশ থেকে পড়লেন। কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন, ‘ঠিক বুঝলাম না দাদা!’
এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না অনুপম। চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘তোমার সাথে তো বাবা সব পরামর্শ করতো। তুমি কি বাবার উইলের ব্যাপারে কিছুই জানতে না। বাবা ওনার বসত বাড়ি, অন্যান্য বিষয় সম্পত্তি এমনকি ব্যবসা থেকেও আমাকে বঞ্চিত করে গেছেন।’
সুভাষ বাবু বলে ওঠেন, ‘দাদা আপনার বোন তো কোনো কিছুই কোনোদিন দাবি করে নি। বাবা তো অনিমাকেও কিছু দেবেন এ কথা কোনোদিন বলেন নি। তাহলে সব সম্পত্তি কাকে দিয়ে গেলেন?’

অনুপমের উঁচু গলা শুনে অনিমা অমল বাবুর শবদেহ ছেড়ে উঠে আসে। এতক্ষণ চুপচাপ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনছিল। এবার সে ঘরে ঢুকে বলে, ‘দাদা তুমি বাবার দিকে আঙ্গুল তুলছো। তুমি কি করে ভাবলে বাবা তোমাকে বঞ্চিত করেছেন। প্রথমে আমি যখন মায়ের কাছে শুনি বাবা তার সম্পত্ত র কানাকড়িও আমাদের দুই ভাই বোনকে লিখিত ভাবে দিয়ে যান নি। তখন আমিও একটু অবাক হয়ে ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম অর্ধেক তো তোমার নামে লিখে দিতে পারতো। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে বাবার দূরদৃষ্টি ছিল।তাই তিনি এই ধরনের উইল করে চলে গেলেন।’

শোকের বাড়িতে অশান্তির তুমুল ঝড় উঠেছে। বেশ কিছু আত্মীয় স্বজনও এসে পড়েছেন। সকলের কৌতুহল আরও বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে শবদেহ নিয়ে যাওয়ার গাড়িও এসে গেছে। আপাতত বিষয় সম্পত্তির বাগবিতণ্ডা তখনকার মতো সাময়িক ভাবে পাশে সরিয়ে রেখে
অনুপম মৃতদেহ নিয়ে রওনা দিল শশ্মানে।প্রায় ঘন্টা পাঁচেক পর শশ্মান যাত্রীরা সকলে ফিরে আসে।
সন্ধ্যায় অনুপমের শ্বশুর বাড়ি থেকে শ্বশুর, শাশুড়ি আরও অনেক লোকজন আসে দেখা করতে। তাঁরাও অনুপমের নামে কোনো কিছু ব্যবস্থা করে যায় নি শুনে অবাক। কলেজ পাশ করে থেকে সে অমল বাবুর ব্যবসায় বসে। তার চেষ্টাতেই ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি যথেষ্ট। তবুও অনুপমের নামে কিচ্ছু নেই। অনুপমের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ফুঁসলেও অনুপমের স্ত্রী পূর্বা কিন্তু বেশ শান্ত ভাবেই আচরণ করছে। সকল অতিথিদের চা বিস্কুট দিয়ে গেল। রাতে কে কে থাকবে তার খোঁজ নিয়ে গেল।
পূর্বার মা’ও মেয়ের এই রকম নির্লিপ্ত আচরণে বেশ চিন্তিত। রান্নাঘরে পূর্বাকে একা পেয়ে তিনি তো বলেই বসলেন, ‘হ্যাঁ রে, তোর শ্বশুর মশাই তোদেরকে এইভাবে ধোঁকা দিয়ে গেলেন। তুই তো তাকে খুব সেবা যত্ন করতিস।’
পূর্বা মুখ নিচু করে বলে, ‘তিনি তো আমাকে কোন ধোঁকা দিয়ে যান নি।’
পূর্বার মা তো আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। মনে মনে ভাবছেন বোধহয় মেয়েটা এতো বড় সিদ্ধান্তটা মেনে নিতে না পেরে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি মেয়ের গায়ে স্নেহের হাত বুলিয়ে বলেন, ‘কী করবি বল সবই আমাদের মেনে নিতে শিখতে হয়।’
পূর্বা ঠোঁটের কোনে একটু হাসি দিয়ে বলে, ‘ঠিক বলেছো মা।স ব কিছু মেনে নেওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা আমাদের থাকা উচিত। তুমি কি জানো শ্বশুর মশাই তাঁর বিষয় সম্পত্তি কাকে দিয়ে গেছেন?
তবে শোনো তিনি তার স্থাবর, অস্থাবর সব সম্পত্তি তার সহধর্মিণীর নামে অর্থাৎ আমার শাশুড়ি মাতা অনুপমের মা-র নামে করে দিয়ে গেছেন। তিনি আরো বলে গেছেন উইলে শাশুড়ি মায়ের স্বাভাবিক মৃত্যুর পর সেই সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ পূর্বা রায়।’

পূর্বার মা তো হতবাক। তিনি প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হন বাড়ির সকল পুরুষ মানুষরা যেখানে আলোচনায় ব্যস্ত অমল বাবুর উইল সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। তিনি প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ‘শুনছো গো পূর্বার বাবা, তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎকে সব দিক থেকেই সুরক্ষিত করে গেছেন বেয়াই মশাই। আমরা মানুষটার পিছনে কত কথাই বলেছি। কৃপণ, খিটখিটে, বদমেজাজী আরো কত কিছু। কিন্তু মানুষটার দৃষ্টি ভঙ্গি এতোখানি উন্নত ও উদার ছিল কোনো দিনই কল্পনা করতে পারি নি।’
আপনারা সকলেই খুব চিন্তিত যে সব সম্পত্তি কাকে দিয়ে গেছেন অমল বাবু তাই তো?
অমল বাবু তার সহধর্মিণীর নামে তার সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন। তিনি ভেবেছেন সম্পত্তি হাতে পেলে অনেক সন্তানই তো বিধবা মা’কে আবর্জনা ভাবতে শুরু করে।তাই অনুপমের মায়ের নামে যদি সম্পত্তি থাকে তাহলে অনুপম ও পূর্বা বাধ্য হয়ে মায়ের সেবা যত্ন করবে। আর বিধবা মানুষটি নিরাপত্তা হীনতায় ভুগবে না। সরকারী চাকুরী জীবির মৃত্যু হলে তার স্ত্রী যেমন অর্ধেক পেনশন পায় তেমনি একজন ব্যবসাদার মানুষ হয়ে তিনি তার সব সম্পত্তি তার স্ত্রী’কে দিয়ে তার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করে গেছেন। সন্তান কখনো সখনো মা বাবাকে বোঝা ভাবলেও বৃদ্ধ মা বাবা কিন্তু সন্তানকে জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত আগলে রাখতে চায়।

পূর্বার মা ও কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন যেদিন আমাদের সমাজের প্রতিটি পুরুষ মানুষ এই রকম ভাবে অগ্নিসাক্ষী করা বিবাহিত স্ত্রীর কথা ভাবতে পারবে সেদিন সমাজে নারী নির্যাতনের, নারীদের অবহেলার একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

Exit mobile version