ফুটানি
-রীণা চ্যাটার্জী
-স্যালারি হয়েছে আজ?
-না..
-কবে হবে? কিছু বলছে না?
-দিয়ে দেবে, বিল তৈরী হলেই দিয়ে দেবে। তোমার অত চিন্তা কিসের?
-তিন মাস তো হয়ে গেল!
-এতো হিসেব করছো কেন? অত ভেবো না। রাত হয়েছে। ঘুম পাচ্ছে। বলে আনন্দ পাশ ফিরে শোয়। রূপা বসে থাকে চুপচাপ। এই রাতটুকুই একটু অবসর। কানে ভাসতে থাকে বিকেলে ছোট জায়ের বলা কথাগুলো- ফুটানি.. যত্তসব। বাইরে থেকে রঙচঙে। কেউ কেউ কষ্ট করে রোজগার করবে, আর কেউ শুধুই ফুটানি দেখাবে। লোক দেখানো ফুটানি..
শৌখিন রূপা ঘর গুছিয়ে রাখতে, বাচ্চাদের সাজিয়ে রাখতে, নিজে পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। তার স্বামী আজ তিন মাস যৌথ সংসারে মাইনের টাকা দেয় নি। অথচ সরকারী চাকরি! এমনও হয়? রূপার বৈষয়িক বাবা শহরে যৌথ পরিবারেও বিয়ে দিতে রাজী হয়েছিলেন শুধুমাত্র ছেলের সরকারী চাকরি দেখে। বলেছিলেন, ‘সরকারী চাকরি- ডাল ভাত খেয়েও সম্মান নিয়ে বাঁচবে।’ কিন্তু এই কি সম্মান? নিজের সামান্য ইচ্ছে, নিরীহ শখের জন্য ছোটো জায়ের বক্রোক্তি শুনতে হচ্ছে!
তিন ভাইয়ের যৌথ পরিবার। তিনজনেই সরকারী চাকরী করে। বিধবা শাশুড়ি পরিবারের সর্বময়ী কত্রী। স্নেহপরায়ণ, পরিশ্রমী, অতিথি বৎসল।
বড়ো ভাসুর অল্প কথার মানুষ, সৎ,পরিশ্রমী। ছোটো দুই ভাই মাসের শেষে মাইনে দাদার হাতে এসে তুলে দেয়। বড়ো জা সরল-ভালোমানুষ। সংসারে কিছুতেই তার তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। শাশুড়ির কথা মতো কাজ করে দিতেই সে অভ্যস্ত। বিয়ে হয়ে এসে সংসারের এই ছবি দেখেছে রূপা, তাতেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
আনন্দ কবে মাইনে পায়, সে জানতেও পারে না। দাদার হাতে সবটাই তুলে দিয়ে সে নিশ্চিন্তে থাকে। দাদা অফিস যাওয়া বাবদ হাতখরচ যা দেয়- তাতেই খুশী। শাশুড়ি যেভাবে বলেন, ভাসুর সেইভাবে সেই খাতে খরচ করে। বৌ- সন্তানের সব খরচ এজমালি সংসারে। তবে তাদের শখ- ইচ্ছের জন্য আলাদা করে কোনো ভাবনা- চিন্তা নেই।
অফিস থেকে ফিরে পরিবারের মাঝেই আসর বসে। সেখানে চায়ের পর্ব মিটলে, বন্ধুবৎসল আনন্দ বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে তবে ঘরে আসে। এই সময়টুকর জন্য রূপা অপেক্ষা করে থাকে। তার নিজেরও যৌথ পরিবারের কর্মকাণ্ডের মাঝে সময় কেটে যায়। রাতটুকুই অবসর। কিন্তু মনের কথা- ব্যথা কার কাছে বলবে? আনন্দ তো সদানন্দ- এমন গা ছাড়া লোকের কাছে মনের কথা বলতে ইচ্ছেও করে না আর.. কিন্তু বিকেলে ছোটো জায়ের কথা ভুলতে পারছে না। এটাও তো ঠিক কথা.. একটা সংসারে মানুষ তার স্ত্রী- সন্তান নিয়ে থাকবে, অথচ সংসারে খরচ দেবে না। কতোদিন চলতে পারে?
সকালে শুনলো ভাসুর আর শাশুড়ি কথা বলছে,
-মা, এ মাসেও তো মেজ বলছে মাইনে হয় নি।
-কি বলি বল? ও তো তেমন ছেলে নয়। কি যে হয়েছে? কে জানে!
-এদিকে ছোটোও পুরো মাইনে দেয় নি- বলছে ওর কি ব্যক্তিগত খরচ আছে। এবার থেকে আর পুরো মাইনে দিতে পারবে না। মেজোর অফিসে একবার যাবো? শিকদার বাবুর সাথে অনেক দিন দেখাও হয় নি। দেখা করে আসাও হবে। অসুবিধা কিসের? কি ব্যাপার অফিসে গেলে ঠিক জানা যাবে।
-সেই ভালো.. তাই কর।
একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রূপা। কিছু তো জানতে পারবে এবার। সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝেও অপেক্ষা করতে থাকে কখন সন্ধ্যা হবে, ভাসুর বাড়ি আসবে।
দিন গড়িয়ে বিকেল- সন্ধ্যার কিছু আগেই আজ দু’ ভাই একসাথে বাড়ি ফিরলো। মুখ থমথমে, গম্ভীর। চলে গেল সোজা মায়ের কাছে। আনন্দও গেল দাদার পেছু পেছু অপরাধী মুখে। এই সংসারে কি হয়- বৌদের জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। মা আর বড়ো ছেলের মধ্যেই সব আলোচনা, সব সিদ্ধান্ত সীমাবদ্ধ। তবুও পায়ে পায়ে রূপা শাশুড়ির ঘরের পেছনের বারান্দায় গেল। দুপুরে মেলে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে লাগলো। কাজের অছিলায় আশেপাশে থাকার চেষ্টা। এই কথাটা যে তাকে জানতেই হবে- মাইনে কেন হচ্ছে না। এখনো সন্ধ্যা হয় নি। দুই জা, বাচ্চারা সব ঘুমোচ্ছে। কানে এলো ভাসুরের গলা,
-ফুটানি, বুঝলে! ফুটানি…
-এ আবার কি কথা? কি হয়েছে সেটা তো বলবি? আনন্দ অমন মুখে দাঁড়িয়ে কেন রে, কি করেছিস?
-ও কি বলবে? ও তো যা করার করেছে। বলছে তো সবাই- ফুটানি!
-সোজোসুজি বল বাপু, রাগ থামিয়ে সোজা কথা বল..
-সোজা কথা! হ্যাঁ, সোজা কথাই বটে। তোমার ছেলে আজ তিন মাস টাকা দান করে আসছে। বাড়ি এসে বলছে- বিল বানানো হয় নি। তাই মাইনে হয় নি।
-দান করে আসছে? সব টাকা! কোথায় দান করেছিস রে? আনন্দের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
আনন্দ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ খোলে না। বড়ো ছেলেই উত্তর দেয় মায়ের কথায়,
-অফিসের পিওন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। হার্টের সমস্যা। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার। ক্যাজুয়াল স্টাফ। ওর স্ত্রী সাহায্যের জন্য অফিসে আসে। কান্নাকাটি করে। সবাই কথা দেয়- সাহায্য করবে সাধ্যমতো। মাইনে পেয়ে দিয়েছেও সবাই। কিন্তু এই হর্ষবর্ধন পুরো মাইনেটাই তুলে দিচ্ছে আজ তিন মাস ধরে। ফুটানি.. হ্যাঁ অফিসে সবাই এই কথাই বলছে। ওকে বোঝাবার চেষ্টাও করেছেন অফিসের কলিগরা। তো বাবুর বক্তব্য আমার কিসের অসুবিধা? ঠিক চলে যাবে। ‘ফুটানি’ ছাড়া আর কি বলতে পারে বলো? আরো আছে কথা- হেঁটে অফিসে যাচ্ছে আজকাল। ফুটানির পারিশ্রমিক, ফুটো পকেট।
মাথা নিচু করে অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে থাকে আনন্দ। মা বলেন,
-সংসারী মানুষ, ঘরে বৌ- বাচ্চা, বিধবা মা এতো দায়িত্ব যার মাথায়- তার কি এমন হলে চলে রে!
সংসারী মানুষ মাপের বাইরে পা ফেললে, লোকে তো ফুটানি বলবেই বাবা। সংসারে অনেক বুদ্ধি করে বুঝেশুনে চলতে হয়। বুঝলি? আর এমন বুদ্ধি করিস না রে। দাদার মাথায় সংসারের দায়িত্ব থাকে। ওর কতো চিন্তা হয় বুঝিস তো। চল অনেক হয়েছে, অফিস থেকে এসেছিস- হাত মুখ ধুয়ে নে। ভাই এসে যাবে। একসাথে চা- জলখাবার খেয়ে নিবি আয়।
কেউ দেখার আগেই রূপা ঘরে চলে আসে। বুক থেকে আশঙ্কার ভারী পাথর নেমে গেছে। হাল্কা করে নিঃশ্বাস নিয়ে মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। কোলে নিয়ে বসে পরম মমতায়। মাথায় আলতো করে গালটা রেখে চিরুনির দিকে হাত বাড়ায়। মেয়েকে সাজাবে- স্বামীর এমন ‘ফুটানি’তে সাজতে-সাজাতে কোনো লজ্জা নেই তার আর।
বাহ দিদি প্রতিবারের মতোই সাবলীল লেখা,খুব সুন্দর
ধন্য যোগ নিরন্তর
খুব ভালো লাগল
ধন্যবাদ সুহৃদ 🙏
খুব ভালো লাগল দিদি,,সুন্দর সৃজন
ধন্য যোগ নিরন্তর