লজ্জা
– অঞ্জনা গোড়িয়া
ওষুধ দোকান থেকে এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে মেয়েটি সোজা বেরিয়ে এল। খবরে কাগজে প্যাকিং করা প্যাকেটটি হাতে নিয়ে হেলতে দুলতে স্মার্টলি এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে।
পরনে জিন্স-সার্ট। পায়ে হিল। ডান হাতে ঘড়ি।চোখে সানগ্লাস।
একদল বয়স্ক মানুষ বিড়ি টানতে টানতে তাস খেলছিল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নাক তুলে ব্যঙ্গ করে বললো, আজকালকার মেয়েদের একেবারেই লজ্জা সরম নেই। বুঝলে ভায়া। দেখো কেমন করে নিয়ে যাচ্ছে? দেখিয়ে দেখিয়ে। ছি ছি ছি কি দিনকাল এলো?
মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ালো। কি বললেন? লজ্জা? কিসের লজ্জা? আপানারা জানেন না এটা কি? কি হয়? আমাদের নারী হয়ে ওঠার চিহ্ন বস্ত্র।
আর আপনাদের লজ্জা করে না?
যখন মেয়েদের সামনে রাস্তায় প্রস্রাব করেন পিছন ফিরে। মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সিগারেট ফুকিয়ে জুয়া খেলেন। বাচ্চারা চেয়ে চেয়ে দেখে । কি শিক্ষা পায় ওরা? বাড়িতে বউ থাকা স্বত্বেও পরের বউএর দিকে ছুকছুকানি। সামান্য ব্রা বেরিয়ে গেলে, হাসি ঠাট্টা করেন আপনারাই।
শাড়িতে সামান্য দাগ লাগলে তামাশা করতে ছাড়েন না। মুখ টিপে হাসেন।
তখন তো প্রতিবাদ করেন না?
একাকী পথ চলতি মেয়েকে যখন অসহায় ভাবে নির্যাতিত হতে হয়। কোথায় থাকেন তখন?
লজ্জা করে না মেয়েদের সম্মান নিয়ে এভাবে তামাশা করতে? প্রতিবাদ করতে শিখেছি লজ্জাহীন হয়ে।
লজ্জা বিসর্জন দিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবো। কথাগুলো একটানা বলেই গটগট করে এগিয়ে গেল।
সবাই মেয়েটির পথের পানেই তাকিয়ে থাকলো বিনা বাক্যবাণে। একেবারে ভাষাহীন।
কিছু দিন পর সেই মেয়েরই বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু হল। সবাই ভেবে ছিল প্রেম করেই বিয়ে করবে।
যা সাহসী মেয়ে। কিন্তু না। প্রতিবাদী মেয়ের সিদ্ধান্ত ছিল বিয়েই করবে না। চাই একটা চাকরি? কিন্তু কোথায়? নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। কিন্তু অসুস্থ বাবার অনুরোধে বাধ্য হলো দেখাশোনায় বসতে। পাত্র ছিল বাবারই বন্ধুর ছেলে।
এ মেয়ে শাড়ি পরতে পারে না। তবু মায়ের আদেশ। যা হয় আর কি। জোর করে পরিয়ে দিল একটা শাড়ি। মায়ের শাসন মানতে হবে। সবাইকে মাথা নত করে প্রণাম করতে হবে। নিচু গলায় কথা বলতে হবে। নম্র ভদ্র ভাবে বসতে হবে। যা জানতে চাইবে। ঠিক- ঠাক বলতে হবে। বাধ্য মেয়ের মতো ইন্টারভিউ দিতে হবে।
এক মুখ অসন্তোষ নিয়ে এগিয়ে চললো। সবার সামনে নমস্কার করে বসতে যাবে কি। হোঁচট খেয়ে পা জড়িয়ে পড়লো। একেবারে এক বয়স্কের সামনে। ইনিই নাকি পাত্রের বাবা। নামকরা ব্যারিস্টার ।
নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটি বসলো নির্দিষ্ট চেয়ারে। তবে মাথা নিচু হয়ে নয়। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে সবার দিকে।
দেখলো ওই বয়স্কদের মাঝে একজন লোফার গোছের ছেলে বসে আছে। খুব চেনা। লাল সার্ট পরা আধুনিক ছাটে চুল কাটা। লাল বাদামি চুল। মাথার ওপর খোঁচা খোঁচা উঠে আছে। আর এক কানে দুল। মেয়েটির দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। একটু ভয়ে জড়োসড়ো। মেয়েটিকে দেখে উঠে পড়ার চেষ্টা করলো।
মেয়েটি থামিয়ে দিয়ে বললো, আরে উঠছো কোথায়?
মেয়ে দেখতে এসে উঠলে হবে? কি প্রশ্ন আছে করো দেখি শুনি?
অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির দিকে।
বাবা ইশারা করে চুপ করতে বললো।
এ মেয়ে যে থামবার নয়। কি করে চুপ থাকবে?
সেই বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, তোমার সম্পর্কে সবই জানি মা। তেমন কিছু জানার নেই। তোমার সার্টিফিকেট পড়াশোনা সবই দেখেছি। আর কি দরকার বলো?
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, দরকার আছে। সব জানা দরকার আছে। আমাকে নিয়ে যাবেন আপনাদের বাড়ি। যাচাই করে তবেই তো।
মাথা থেকে নখ পর্যন্ত ভালো করে চেয়ে দেখুন। ঠিকঠাক আছি কিনা? কেমন হাঁটতে পারি? দেখুন, আমার চুলটা কত ছোটো। আমি মাসে মাসে পার্লারে যাই। ফেসিয়াল করি। ভ্রু তুলি। স্পা করি। রান্নাবান্না তেমন পারি না। আর মোবাইল ছাড়া আমার দিনই কাটে না।
আর অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে ছাড়ি না। পারবেন তো এমন মেয়েকে ঘরের বউ করতে?
আপনার এই ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন। খুব ভালো করেই চেনে আমাকে।
ছেলেটা মাথা নিচু করে থাকলো।
ভদ্রলোক মুচকি হেসে আবার জানতে চাইলো, কি করেছে ছেলে?
ব্যঙ্গ সুরে বললো, জুতোর দাগটা এখনো গালে লেগে আছে দেখুন। এই ছেলে কিনা আমার পাত্র?
কিছুদিন আগে আমার বন্ধুর ওড়না টেনে ধরেছিল। চোখে রঙিন চশমা ছিল তো। তাই নাকি বুঝতে পারে নি। এমন শায়েস্তা করেছি সেদিন। নিজেই জিজ্ঞাসা করুন কি করেছি? আমাকে চেনে কিনা?
ছেলেটা লজ্জায় মাথা নত করে বসে রইলো।
কারোর মুখে কোনো কথা নেই। মিষ্টির থালাটা এখনো শেষ হয় নি। সবাই উঠে দাঁড়ালো।
মেয়েটি বললো, মিষ্টি গুলি খেয়ে যান। এখনো শেষ হয় নি যে।
গম্ভীর মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সবাই।
বুঝতেই পারছে এবার বাবার বকুনি খেতে হবে। কিন্তু একটু অবাকই হলো মেয়ে। বাবা পিঠ চাপড়ে বলল। সাবাস। আমি গর্বিত মা।
ভাবতেই পারে নি মেয়ে, বাবা এত খুশি হবে এমন আচরণে।
মা কিন্তু গজগজ করতে করতে ভেতরে গেল। হায় পোড়া কপাল, এ মেয়ের বুঝি আর বর জুটবে না।
এমন ধিঙ্গি বাচাল মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
কিছুদিন পর ভদ্রলোকের ফোন। আমাদের মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছে।
শীঘ্রই পাকা কথা বলতে পাত্রকে নিয়ে আসবো।
অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকায় পাত্র সেদিন আসতে পারে নি। আমার ছেলে একজন নামী উকিল।
মেয়েটি তো অবাক! এ ছেলে তবে কে?
জানতে পারলো, সেই ছেলেটি ছিল আসলে এই গাড়ির ড্রাইভার। সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
লজ্জাহীন হয়ে লজ্জাবস্ত্রে মুখ ঢেকে একেবারে ফুলশয্যায় এ মেয়ে। তবু প্রতিবাদ থামে নি।