গল্প- অবশেষে

অবশেষে
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

দেখতে দশটা বছর পার হয়ে গেল। সুজয়ের জন্য একটা মনের মতো পাত্রী জুটল না। সেই কবে এম এ পাশ করা মাত্রই স্কুলের মাস্টারির চাকরিটা জুটিয়ে ফেলেছিল সুজয়। তবুও সে অবিবাহিত। পাত্রীর বাবা দাদারা আজও এসে চলেছে সম্বন্ধ নিয়ে। সুজয়ের মা, বাবা, দিদি, ভগ্নিপতি রবিবার হলেই বেরিয়ে পড়েন পাত্রী দেখতে। তারা তো ইতিমধ্যে গোটা দশেক পাত্রীকে ফাইনাল করে এসেছিলেন। কিন্তু সুজয় দেখতে গিয়ে একান্তে পাত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরই পরিস্থিতি যায় পাল্টে। কখনো পাত্রী সুজয়কে নাকচ করে আবার কখনো সুজয় পাত্রীকে।

হঠাৎই এক সম্বন্ধ এসে জুটেছে সুজয়ের। পাত্রীর বয়স আটাশ। দর্শন নিয়ে পড়াশোনা। উচ্চতা পাঁচ ফুটের কম। স্থূলকায় চেহারা। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। গান টান জানে অল্পবিস্তর। মুখশ্রী আহামরি না হলেও মন্দ নয়। সদা হাসিমাখা মুখ। দুইবেলা টিউশনি পড়ায়। মোটামুটিভাবে পরিশ্রমী মেয়ে।
সুজয়েরও বয়স যথেষ্ট হয়েছে। মাথায় হালকা টাক উঁকি ঝুঁকি মারছে। আত্মীয় স্বজনের কথা এবার খুঁত খুঁত করাটা বন্ধ করে সুজয়ের উচিত বিয়ের জন্য যোগ্য পাত্রী নির্বাচন করা। সুজয়ের বন্ধু বান্ধবরা তো সামনা সামনি সুজয়কে নিয়ে মশকরা করে।
সবার মনে একটাই প্রশ্ন পাত্রীর সাথে একান্তে সুজয় কী এমন কথা বলে যে তারপর বিয়ে নাকচ হয়ে যায়।

এবার তাই আর পরিবারের লোকজন আগে পাত্রী দেখতে না গিয়ে সুজয়কেই পাঠালো পাত্রী দেখতে। সুজয় তার ছেলেবেলার বন্ধু মিলনকে নিয়ে পাত্রী শোভাকে দেখতে যায় কোনো এক রবিবারে।
দোতলার বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে ক্লাস ইলেভেনের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীদের দর্শনের ফেলাসি চ্যাপ্টারটা খুব মন দিয়ে পড়াচ্ছিলো শোভা। হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ তুলে দেখে দুটি অপিরিচীত যুবককে নিয়ে শোভার বাবা দাঁড়িয়ে। শোভার বাবা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ‘ আমি এনাদের নিচে ড্রইং রুমে বসতে বলেছিলাম। কিন্তু সুজয় বাবাজীবন তোর পড়ানোটা শুনতে চাইছিল।তাই অগ্যতা….’

শোভা মনে মনে বিরক্ত হলেও ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বলে, ‘ভালোই করেছেন। এবার আপনারা দয়া করে ড্রইং রুমে গিয়ে বসুন আমি আসছি এদের ছেড়ে দিয়ে।’ কিছুক্ষনের মধ্যে ড্রইং রুমে এলো শোভা। কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলে ‘ আপনাদের যা জিজ্ঞাসা আছে তাড়াতাড়ি করুন। আমার আর একটা ব্যাচ আসবে এখুনি।’
সুজয়ও সময় নষ্ট না করে বলে, ‘আজকের দিনে টিউশনিটা বন্ধ রাখলে কি খুব অসুবিধা হতো?’
শোভা বলে, ‘দেখুন এটা আমার পঞ্চান্নতম দেখা শোনা। বিয়ে হবে কিনা এবারও তার ঠিক নেই। টিউশনি পড়িয়ে আমি নিজের হাতখরচাটুকু উঠিয়ে নিই। সেখানে আমি কোনো কম্প্রোমাইজ করতে চাই না।’
সুজয় বলে, ‘আমি একান্তে একটু কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে। যদি আপনার আপত্তি না থাকে?’
শোভা কোনো রকম সংকোচ না করে বলে, ‘আসুন। আমার বেডরুমে চলুন।’
মিলনকে বসিয়ে রেখে শোভার পিছন পিছন সুজয় গিয়ে ঢুকলো শোভার বেডরুমে। সুন্দর ঝিমঝাম গোছানো। খাটের পাশে রাখা চেয়ারটা এগিয়ে দিল শোভা। সে নিজে খাটের ওপর বসলো। হালকা পা দোলাতে দোলাতে বললো, ‘শুরু করুন। আপনার প্রাইভেট কথা।’
সুজয় শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দু’টো স্থির করে বললো, ‘আপনার তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আপনি নিঃশ্চয় প্রেম করেছেন।’
শোভা তো হতভম্ব! কি বলছে এ! নিজেকে একটু সামলে একটু মুচকি হেসে শোভা বললো, ‘জীবনে বসন্ত তো অনেক এসেছে। দেখতে আমি সুন্দরী নই বলে বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয় নি এখনো। তবে প্রেমে পড়েছি বার কয়েক।’
সুজয় তো হতবাক! এতবছর ধরে সে মেয়ে দেখে বেরাচ্ছে আর এই প্রশ্নটা করা মাত্রই পাত্রী একদম গুটিয়ে পড়তো। আর এই মেয়ে কি অবলীলায় জীবনের সত্যি খানা তুলে ধরলো।

সুজয় বাড়িতে এসে জানিয়ে দিল শোভাকেই সে বিয়ে করবে। বাড়ির লোকের খুব একটা পচ্ছন্দ ছিল না শোভাকে। তবু সবদিক বিবেচনা করে তারাও বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। সুজয়ের মা তো সবাইকে বলতে লাগলো ‘ নিঃশ্চয় এই মেয়ে অনন্যা। পনেরো বছর ধরে দেখাশোনার পর সুজয়ের এই প্রথম কোনো পাত্রীকে মনে ধরলো।’
অবশেষে সুজয়ের বউ পাওয়া গেল। শোভার বাড়ির লোকজনও তো হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
দুই পরিবারই খু্ব খুশি। তবে সুজয়ের বাড়ির সবার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি মারতে লাগলো এত বছর একান্তে সুজয় পাত্রীকে কী এমন কথা বলতো যে পাকাদেখাতে এসেই বিয়ের কথা ভেঙে যেতো। কিন্তু এবার শোভা কী এমন উত্তর দিলো যে সুজয় পুরো ক্লিন বোল্ট। শোভাকে পীড়াপীড়ি করতে শোভা তার ননদদের জানায়, ‘তোমার দাদা ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমি প্রেম করেছি কিনা। আমি বলে ছিলাম হ্যাঁ।’ সুজয়ের দিদি বোন সকলে তো হেসে অস্থির। তাদের কাছে এই কথাটাতে স্পষ্ট হলো রে এতদিনে সুজয় একান্তে পাত্রীকে কি জিজ্ঞাসা করতো। অনেক পাত্রী তো সুজয়কে পাগলও বলে ছিল।

তবে সুজয় বড়ো খুশি শোভার মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে। যার অন্ততঃ সত্যি কথা বলার মতো সৎ সাহস আছে। প্রেম ভালোবাসা কি খারাপ বস্তু যে একে লুকিয়ে বেড়াতে হবে। প্রেমে পড়লেই যে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিয়ের পর পরকীয়াতে সুজয়ের যথেষ্ট আপত্তি। সুজয়ের মুখে এই সব কথা ফুলশয্যার রাতে শুনতে বেশ লাগছিল শোভার। শোভা একটু লাজুক অবনত মুখে বললো, ‘তা তুমি কটা প্রেম করেছিলে শুনি।’
জানলার পাশ থেকে আওয়াজ এলো, ‘ধূস দাদার একটাও প্রেম টেম হয় নি। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেই জানে না। ও করবে প্রেম!’

তাড়াতাড়ি দরজা খুলে সুজয় দেখে তার তুতো ভাইবোনরা, বৌদিরা সবাই রীতিমত জানলায় কান পেতে বসে আছে। সুজয়ের দরজা খোলা দেখে যে যার মতো দৌড় লাগালো। পড়ে রইলো কেবল মিনু বৌদি। সে কিন্তু না পালিয়ে সোজা ফুলশয্যার খাটে গিয়ে বসলো আর হাসতে হাসতে শোভাকে বললো, ‘সব পুরুষ মানুষ যদি ঠাকুরপোর মতো হতো তাহলে বেশ হতো।’

Loading

Leave A Comment