রম্য- ভোজনে বাঙালী

ভোজনে বাঙালী
-রীণা চ্যাটার্জী

বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাবার আগে হাবিজাবি, এঁচোড়-থোর, ওল-ঢোল, মোচা-ওঁচা, কচু-ঘেঁচু, শাক-ঢাক সময়ে-অসময়ে না বুঝে না দেখে কেনার সাবধান বাণী প্রায় সব বাঙালী ঘর থেকেই ভেসে আসে। সে কথা কানের পর্দা ভেদ করে মন-মস্তিষ্ক কোথাও ঢোকে বলে মনে হয় না। কারণ বাজার থেকে বিশাল বপুর থলিটি নিয়ে হৃষ্ট চিত্তে কর্তা বাড়িতে ফিরে আসেন। অবশ্য ফিরে এলে একচোট চেঁচামেচিও প্রায় নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে তাতে ভদ্রলোকটির কিছুটি যায় আসে না। কখনো হুঙ্কারে বা কখনো মৌন থেকে ছুটির দিনের মধ্যাহ্নের আহারের যোগাড়টি করে মহানন্দে থাকেন। তারপর কানে তুলো, পিঠে কুলো নিয়ে তাস-ঢিভি-মোবাইল- আড্ডায় যত্ন সহকারে মনোনিবেশ করেন। গৃহিণী মরুক তাপে-ভাপে, ফোড়নের ঝাঁঝে, বটির মাঝে, বাসনের খাঁজে। রান্নার গন্ধে কর্তার মনে পুলক। মাঝে মাঝে চোখের তারা আনন্দে নেচে উঠছে- ভাগ্যিস কিনেছিলাম, ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে হতো আর কি! আহা! কি তাজা, বড়ো খাসা। মধ্যাহ্নের আহার শেষে তৃপ্তির উদ্গারে নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রা- আর কি চাই জীবনে! সব রসাতলে যাক.. বাঙালী ভোজনে-শয়নে বেঁচে থাক। বাঙালী বললাম আলাদা করে- কারণ ওই নামের সাথে ভোজন রসিক, পেটুক অনেক বিশেষণ জুড়ে আছে।
এক পরিচিত বাঙালী ভদ্রলোকের কথায়- ছ্যা ছ্যা বাঙালীরা ছাড়া কেউ খেতে জানে না কি? বলেই সুস্বাদু বেশ কয়েকটি রান্না জিহ্বাষ্ঠ করে উচ্চারণ করে গেলেন। জিভে জল এলো বোঝাই গেল। কেন না তারপরেই সুরুৎ করে একটা আওয়াজ এলো- ঢোঁক গিললেন।
প্রথম যৌবনে বৌয়ের হাতের কদু মুখে মধু লাগলেও, মধ্য চল্লিশে এসেই পাতের পাশে বসে, বা মজলিসে বসে মা-ঠাকুমার হাতের স্বাদু স্মৃতিতে কখনো বা চোখে জল কখনো বা জিভে জল নিয়ে সংসারে অবলীলায় আগুন ধরিয়ে দেন। নিত্যদিন পাতের পাশে অন্ন থেকে পরমান্ন সাজানো গৃহিণী তখন সেই আগুনের তাপে জ্বলতে থাকেন। কখনো সোচ্চারে কখনো নিরুচ্চারে বলতে থাকেন, ‘সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেল- হেঁশেল ঠেলতে আর চব্য চষ্য গেলাতে গেলাতে.. সব বেইমান, ঝাড়ে-বংশে বেইমান’। মনে কোনো আপশোষ না রেখে কর্তা কখনো আগুনে আপোষের জল ঢালেন, না হলে মৌনব্রতের ছাই চাপা দেন। ভাব খানা- সময়ের মলমে পোড়া ঘা শুকিয়ে সংসারের চাকা ঠিক ঘুরবে। অগত্যা চোখের জল আর দীর্ঘ নিঃশ্বাসের কেমিক্যালে অগ্নি নির্বাপন। এ অভিজ্ঞতা নিয়েই সংসার সমুদ্রে টিকে থাকা। এতো সহজে মুক্তি নেই- সাত পাকের বাঁধন। প্রতি পাকে অজস্র পাঁক- যত ঘাঁটবে, তত জড়াবে।

এ তো সংসারের ভেতরের কথা। একটু বাইরে কান পাতলেই শোনা যায়, ‘বাঙালী লোগ ছাপ্পান ভোগ খাতে হ্যায়’। অথচ দুপুরে এসে বলতে ভোলে না, ‘মেরী ঘর মে আপকি বানায়ি সব্জি সব বহৎ পেয়ার সে খাতে হ্যায়..’ উদ্দেশ্য খুব সহজে বোধগম্য। গা জ্বলে যায়! দাও এক বাটি তরকারি হাসি হাসি মুখে, ভদ্রতার খাতিরে। বাঙালী খাওয়াতে আবার কবে ভয় পায়? বাঙালী খেয়ে-খাইয়ে ফতুর এই প্রবাদ তো অলঙ্কার করে নিয়েছে। তোমাদের কি বাপু খাও রোজ আচার আর পাঁপড়- আবার ঘটা করে বলা চাই, ‘হাম তাজা খাতে হ্যায়..’ তাজা খাবারের মেনু কি? ডাল, আচার, পাঁপড়, চাউল-রোটি.. আরে নাঙ্গা নাহাগে কেয়া অর নিচোরেগা কেয়া! ওদের বাড়ি থেকে বাজারে যাবার আগে সাবধান বাণীও আসে না, দিবানিদ্রার বালাই নেই, রসনার আক্ষেপ নেই.. কেমন যেন পানসে।

বেঁচে থাক বাঙালি তেলে-ঝোলে-অম্বলে। শুধু ওই মধ্য চল্লিশের পুরুষগুলোর, ‘চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী..’ না হলে সংসারে গৃহিণীদের বলতে হবে, ‘তোর ভাবসাগরে ভেসে আমি, হবো মা তোর পদাশ্রয়ী..’ সাত পাকের ল্যাটা চুকে যাবে।

Loading

6 thoughts on “রম্য- ভোজনে বাঙালী

  1. দারুন দারুন, দুর্দান্ত রম্য হয়েছে. ……

Leave A Comment