Site icon আলাপী মন

গল্প- নূপুরের শব্দ

নূপুরের শব্দ
শিলাবৃষ্টি

 

 

সুনীতি দেবীর আজ আর মনে পড়েনা কবে থেকে তিনি কলম ধরেছেন ! প্রথমে কবিতা লিখতেন ,কবিতার বেশ কয়েকটা বইও নিজে শখ করে তখন প্রকাশ করেছিলেন । পরের দিকে গল্প লেখায় মেতে উঠলেন। সে সব অনেক কাল আগের কথা । একটু একটু করে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে । পাঠক মহল অপেক্ষায় থাকে সুনীতি রায়ের নতুন উপন্যাসের কবে মোড়ক উন্মোচন হবে! আর ফিরে তাকাতে হয়নি । সাহিত্য জগতে এখন সম্মান প্রতিপত্তি অগাধ । তবু নিজেকে মাঝে মাঝে বড় একা লাগে। বাবা মাও মারা গেছে । বোন ভগ্নীপতি মুম্বাইবাসী।
তবে এই পূজোর আগেটায় খুব চাপ থাকে।
শারদীয়া সংখ্যার জন্য পাবলিসার্সদের বায়নার শেষ নেই। এই তিন মাস দিনরাত লিখতে হয় সুনীতিকে। আর লেখার জন্য নিজেকে নির্বাসন দেন তিনি জয়পুর জঙ্গলের পাশের এই আস্তানায়, নাম “বনলতা”। ভীষন নির্জন । এই বাংলোটা বাবা কিনেছিলেন এককালে । নামটা অবশ্য সুনীতি দেবীই রেখেছিলেন “বনলতা”।
গতকাল বিকেলে জয়পুরে এসে পৌঁছেছেন তিনি । কেয়ারটেকার গঙ্গাধর আগেই সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল। বনলতার দোতলার ব্যালকনিটা সুনীতি দেবীর খুব প্রিয় । সন্ধেবেলায় আরামকেদারায় বসে আছেন, কুয়াশা মোড়া অন্ধকার গাছগাছালি মধ্যে জোনাকির মিটমিটে আলো। বেশ গা ছমছমে একটা পরিবেশ। নদীর ঢেউএর মৃদু শব্দ …এমন সময় কানে আসে শুকনো পাতার মচমচ আওয়াজ ।
-কে? গঙ্গাধর ? নাহ কেউ নয়।
পরের দিন সন্ধ্যা। বারান্দায় বসে ব্ল্যাক কফির পেয়ালায় চুমুক দেবেন হঠাৎ আগের দিনের মতোই শব্দ ! যেন শুকনো পাতায় কেউ নূপুর পায়ে হেঁটে গেল । সচকিত হলেন ,শব্দটা দূরে মিলিয়ে গেল। রহস্যের গন্ধ ! ডিনারের সময় গঙ্গাকে জানালেন। সে বলে দিল
– জন্তু জানোয়ার হবে !
সন্ধ্যায় বসে পরবর্তী উপন্যাসের কাহিনী ভাবছিলেন সুনীতি আর প্রতীক্ষায় ছিলেন সেই পদশব্দের। তখন আটটা দশ , আবার শুনলেন শুকনো পাতার উপর নূপুরের শব্দ । দেরী না করে দ্রুত নেমে এসে শব্দ অনুসরণ করে এগোতে থাকলেন।
অমাবস্যার ঘন অন্ধকারে কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। ঠিক সেই সময় শাল গাছটার পাশে হালকা আলোর আভাস দেখতে পেলেন । বুঝলেন ভুল হয়নি তাঁর। রহস্য ঘনীভূত। ভয় পেলেন খুব, তবু চিৎকার করে বললেন-
– কে ? কে ওখানে ? বেরিয়ে এসো।
সেই মুহূর্তে টর্চটাও বিট্রে করলো। ব্যাটারীর মশলা বোধহয় ফুরিয়ে গেছে। ছুটে পালালো কেউ । শুকনো পাতার ওপর ঝুমঝুম শব্দটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
ফিরে এলেন বনলতায় ।
আশ্চর্য হলেন আরও। নীচের ভাঙা স্টোর রুমে আলো জ্বলছে ! একি ! এতো রহস্যের ওপর রহস্য ! ঘুম আসছেনা । খুব চিন্তায় পড়লেন । এতবার এখানে এসেছেন ,মাসের পর মাস কাটিয়েছেন কিন্তু কখনো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
কে ছিল জঙ্গলে? রোজ শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কে হেঁটে যায় নূপুর পায়ে ! সে যে মহিলা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্টোর রুমে আলোই বা কিসের ! এ রহস্যের কিনারা করতেই হবে তাঁকে। গঙ্গাধর নিশ্চয় কিছু জানে ,কিন্তু বলছেনা। নাঃ ঘুম আর আসবেনা । এভাবেও তো চলতে পারেনা । এই রহস্যের কিনারা তাকেই করতে হবে।

পরের দিন রাতে …
গঙ্গাধর খাওয়ার জন্য তাগাদা দিল একটু বেশি তাড়াতাড়িই। খেয়ে দরজা বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন, তারপর অন্ধকার বারান্দায় সন্তর্পনে গিয়ে দাঁড়ালেন , হুমম – যা ভেবেছেন তাই। স্টোর রুমে আলো জ্বললো । সন্তর্পনে নেমে এলেন নীচে। রুমের ভেতরে ফিসফিস করে কথা বলছে কারা ! সুনীতি ঘেমে উঠলেন ,দরজাটা ঠেলে দিলেন । একি ! গঙ্গাধর আর একটি শ্যামলা আদিবাসী মেয়ে খেতে বসেছে ঘরের এক কোণে !
ততক্ষণে ওরাও ভয়ে কাঠ। ভুত দেখার মতো দুজনেই চমকে উঠেছে।
—খেয়ে নাও, তারপর ড্রইংরুমে এসো তোমরা‌। গম্ভীর গলায় বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
একটু বাদেই দুজনে ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়ালো সুনীতি দেবীর সামনে।
– বসো।
একটু তফাত রেখে মাটিতে বসল দুজন।
– গঙ্গাধর ! এই মেয়েটি কে ? আর কেনই বা আমার কাছে মিথ্যে বলেছ তুমি ? তোমার বাবা এই বনলতার দেখাশোনা করেছেন প্রায় তিরিশ বছর । এখন তুমি ।
কিন্তু এসব কি ? সব সত্যিটা আমাকে বলো।
এরপর গঙ্গাধরের মুখে যা শুনলেন –
এই মেয়েটি গঙ্গাধরদের পাশের গ্রামের , নাম দুগ্গা। গঙ্গাধর ভালোবেসে মন্দিরে বিয়ে করেছিল কয়েক মাস আগে, কিন্তু দুগ্গার দাদা বোনের বিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে দোজবরে বুড়োর সাথে পাকা করে ফেলেছিল । চার দিন আগে দুগ্গা ঘর থেকে পালিয়ে আসে। গঙ্গাধর উপায় না পেয়ে এই ভাঙা ষ্টোর রুমেই তাকে লুকিয়ে রাখে।

– কিন্তু তোমার বাড়িতে ওকে কেন নিয়ে গেলেনা ? আর ও প্রতি রাতে কেন বেরোতো জঙ্গলের দিকে ?

– না দিদিমণি। আমাকেও ওরা পাগলের মতো খুঁজছে।
দুগ্গা আমার ফোন থেকে ওর সইকে ফোন করতে রাতের বেলা বাইরে বেরোতো-গ্রামের পরিস্থিতি জানার জন্য ।
বনলতায় টাওয়ার থাকেনা।
এতক্ষনে সব রহস্যের জট খুললো । রাত দুটো বেজে গেছে। উঠলেন তিনি ।
-আমাকে সব কথা তোমার জানানো উচিত ছিল গঙ্গাধর।
– দিদিমণি ! কিছু তো কর । আমাদের বাঁচাও , খুঁজে পেলে উরা মোদের বলিটো দিবেক ।
দুগ্গার আকুতিতে ফিরে তাকালেন সুনীতি ,নজর পড়ল তার পায়ের নূপুরে। এবার তাঁর কাছে সবটা পরিষ্কার হল।

– না না ভয় পেয়োনা। আমি পুলিশ নিয়ে ঐ গ্রামে যাবো। বলি দেওয়া কী এতই সোজা ? যাও তোমরা। অনেক রাত হয়েছে । আমিতো আছি ,ভয় কি ?
নিঝুম ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন তিনি । মনে এসে ছুঁয়ে গেল নিজের যৌবন । কলেজ জীবনে সুশান্ত তাকে ভালোবেসেছিল । তিনিও নীরব সায় দিয়েছিলেন সেদিন ; কিন্তু বাবা মেনে নেননি সেদিনের সেই অসম প্রেমকে। অনেক কষ্টে নিজেকে একটু একটু করে সরিয়ে আনতে হয়েছিল সুশান্তর ভালোবাসা থেকে । ভালোবাসার মর্যাদা দিতে গিয়ে সারাজীবন একাই কাটালেন।
রাতজাগা একটা পাখি ডেকে উঠল শাল- সেগুনের জঙ্গলের ভেতর থেকে।
তাঁর জীবনে ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি, কিন্তু দুগ্গা আর গঙ্গাধরের ভালোবাসাকে তিনি বাঁচাবেন। তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের নাম দেবেন ” দুগ্গা “।।

Exit mobile version