প্রাপ্তি
– মানিক দাক্ষিত
মাকে জড়িয়ে ধরে অপরূপা কথাটা বলতেই মা সস্নেহে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে, “আর দেরী নয় এবার তোর বাবাকে কথাটা খুলে বল। ভালো হবে। ভয় কি, বাবা তো তোর বন্ধুর মতো। সব কথা তো তোরা শেয়ার করিস।”
অপরূপা সত্যিই অপরূপা। রূপে গুণে লক্ষ্মী, বিদ্যায় সরস্বতী। এবার এম.এসসি.কমপ্লিট করেছে।
গুটি গুটি পায়ে অপরূপা বাবার লেখার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবা লিখতে লিখতে মুখ না তুলে কৌতুক স্বরে জিগ্যেস করেন, “কিছু বলিবেন রাজকুমারী?”
–আজ্ঞে হ্যাঁ পিতাশ্রী, অতিশয় লজ্জায় কথাগুলি ঠিক মতো সাজাইয়া বলিতে পারিবো না বলিয়া এই অনুঘটকটিকে রাখিয়া যাইলাম। আপনি সময়মতো যত্নসহকারে শুনিয়া আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রদান করিবেন।”
উদার সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ অরুণবাবু মুখটা তুলে দেখলেন–একটা ছোট্ট মুঠো টেপ রেকর্ডার্। পরম
সাগ্রহে চালালেন— “আমি মাতাশ্রীর নিকট শুনিলাম আপনি আমাকে পাত্রস্থ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। সনির্বন্ধ অনুরোধ, দয়াপূর্ব্বক কষ্ট করিয়া আর আমার পতিদেবতার খোঁজ করিবেন না। বর্তমানে আমার সন্ধানে রহিয়াছে। পাত্র ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ। ভীষণ গরীব। সংসারে অসুস্থ মা ছাড়া আর কেহ নাই। অন্তর ও বাহির খুবই সুন্দর। বাজাইয়া দেখিতে পারেন। আদেশ পাইলে পাত্রকে সশরীরে আপনার সম্মুখে উপস্থিত করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।”
রবিবার সুদর্শন যুবক সৌম্য অরুণবাবুর বাড়ী আসলে অপরূপার মায়ের ভীষণ পছন্দ হয়। বিচক্ষণ অরুণবাবু সৌম্যকে নিয়ে একটা আলাদা ঘরে আলাপ আলোচনার জন্য বসলেন। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অরুণবাবু যখন শুনলেন তার মায়ের নাম বেলা সেন, তখন তিনি বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। প্রশ্ন করলেন, “তা’লে নিশ্চয়ই তোমাদের আদি বাড়ী টালিগঞ্জ নয়?”
-আজ্ঞে না।
-কোথায়?
-বর্ধমানের মেমারী। রেলস্টেশনের কাছেই।
-হাসপাতাল মোড়ে?
-হ্যাঁ – হ্যাঁ, আপনি জানলেন কিভাবে?
-সেসব কথা পরে হবে। তোমার মামারবাড়ী কি মন্তেশ্বর?
-হ্যাঁ, মন্তেশ্বর নীচু বাজারে। আমার দাদু, মামাকে কি আপনি চেনেন?
-চিনতাম। তোমার বাবার সম্বন্ধে তুমি কতটুকু জানো?
-বাবার চরিত্র মোটেই ভালো ছিলো না। মদ খেতো। রেসের মাঠে যেতো। মায়ের গায়ে যখন তখন হাত তুলতেও দেখেছি।
–মারা গেলেন কিভাবে?
–কার একিসেডেণ্টে।
-তোমাদের সংসারের অবস্থা তো ভালো নয়। চলে কিভাবে?
-ডিউটি করা অবস্থায় বাবা মারা যাওয়ায় সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণবাবদ বেশ কিছু নগদ টাকা মা পেয়েছিলেন। জমানো টাকার সুদ আর আমার কয়েকটা টিউশানি থেকে মোটামুটি চলে যায়।
-এই অবস্থায় বিয়ে করা তো একরকম দু:সাহস!
নির্ভীক সৌম্যর গলায় আত্মপ্রত্যয়ের সুর। স্বচ্ছন্দ সাবলীল ভঙ্গীতে বলে – অসুস্থ মা বিয়ের জন্যে পীড়াপীড়ি করলেও এই মুহূর্তে বিয়ের জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত নই।অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার পদে আমার কে.এম.সি’র প্যানেলে ১ নম্বরে নাম রয়েছে। প্রসেসিং হচ্ছে। আশা করি মাস দুয়েকের মধ্যেই অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাবো।
অরুণবাবু চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ভেতরে যাও।”
হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সৌম্য। অরুণবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে আসতেই দেখে দরজার আড়ালে অপরূপা দাঁড়িয়ে। এতক্ষন ঘাপটি মেরে সব শুনেছে দুষ্টু মেয়েটা। অপরূপা একরকম সৌম্যকে ছোঁ মেরে মায়ের কাছে হাজির করে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে।
-মা, দেখো টেনশনে ছেলেটার কি অবস্থা! ঘেমে নেয়ে উঠেছে। জামাটা ভিজে একেবারে গোবর
ভেজা।
সৌম্য কিছুটা অপ্রস্তুত। অসহায় দৃষ্টিতে ম্লান হেসে অপরূপার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে
বলে, “ওরাল পরীক্ষায় মনে হচ্ছে ডাঁহা ফেল মারলাম।”
রাতে খাবার টেবিলে খেতে বসে অপরূপার মা উদ্বিগ্ন চিত্তে কর্তাকে জিগ্যেস করে, “কি গো
ছেলেটাকে তোমার পছন্দ হয়নি? আমার তো খুব ভালো লেগেছে। একেবারে রাজপুত্তুর! যেমন মিষ্টি চেহারা, তেমনি আচার-ব্যবহার।”
রাশভারী অরুণবাবু গম্ভীর মুখে উত্তর দেন, “তোমাদের পছন্দ হলেও ছেলেটিকে আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। কোনোদিকেই ও-আমার মেয়ের উপযুক্ত নয়। ওর সাথে বিয়ে হলে আমার মেয়ে সুখী হবে না। সংসারের অবস্থা ভালো নয়, কোনোরকমে ওদের দিন চলে।”
গিন্নি বোঝাবার চেষ্টা করে, “কিন্তু ছেলেটা তো দু-একমাসের মধ্যেই চাকরীতে জয়েন করবে
শুনলাম। তা’লে আপত্তিটা কিসের?”
অরুণবাবু তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন, “ছাড়ো, ছাড়ো, অনেক দেখেছি। গাছে কাঁঠাল, গোঁফে
তেল! চাকরী বললেই চাকরী হয়ে যাবে! ছেলের হাতে মোয়া আর কি!”
একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত। অপরূপা নিশ্চুপ। নিশ্চল পাথরের মতো চেয়ারে বসে। মুখের গ্রাস
হাতের মধ্যেই ধরা। চোখ হতে নীরবে বইছে অবিরল অশ্রুধারা।
হঠাত্ মা-মেয়েকে চমকে অরুণবাবু হো-হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। হাসি থামিয়ে একঢোক জল খেয়ে স্মিতহাস্যে তারিয়ে তারিয়ে বলেন, “আরে না-না, তোমাদের সাথে এমনি মজা করছিলাম। সৌম্য ছেলে হিসাবে সত্যিই খুব ভালো। কাঁচ নয়, একেবারে হীরের টুকরো। আমারও ভীষণ পছন্দ। বলতে পারো আমার মেয়ের নির্বাচন একেবারেই সঠিক।”
অপরূপা অবাক বিস্ফারিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে। নিজের চোখ-কানকে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আনন্দে বিহ্বল। ভাতের গ্রাস থালায় নামিয়ে এঁটো হাতেই বাবার
গলা জড়িয়ে খুশীতে জুড়ে দেয় হাউহাউ করে কান্না।
বহু আকাঙ্খিত ঈপ্সিত বস্তুটি মানুষ যখন পায়, তখন এমনি করেই বোধ হয় তার হৃদয় খুশীর
জোয়ারে উথাল পাথাল করে!
মায়ের দু’চোখেও দেখা যায় টলটল করছে আনন্দ আর খুশীর যুগল অশ্রু।
সৌম্যের সাথে আলাপ আলোচনার পর থেকেই অরুণবাবুর মনটা উদ্বিগ্ন আর অস্থিরতায় পরিপূর্ণ।
কিছুতেই মনটাকে স্থির রাখতে পারছেন না। গভীর রাত। চোখে ঘুম নাই। বারান্দায় অস্থিরভাবে তার পদচারণা। জ্বলছে মুখে একটার পর একটা সিগারেট।
সাঁইত্রিশ বছর আগে কালের আবর্জনায় চাপা থাকা দু:সহ মর্মান্তিক ঘটনাগুলো একটার পর একটা তার মনের পর্দায় ফুটে উঠছে। স্পষ্ট মনে পড়ে, বেলার অনুরোধে এক শীতের সন্ধ্যায় সদ্য চাকরী পাওয়া এক গরীব যুবক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার প্রভাব প্রতিপত্তিশালী বড়লোক বাবার কাছে গেলে জুটেছিল কি চরম অপমান আর লাঞ্ছনা। সদম্ভে বেলার বাবা বলেছিলো, “কোন সাহসে তুমি বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াও? আর একবার আমার মেয়ের নাম উচ্চারণ করলে তোমায় কুচি কুচি করে কেটে খড়ি নদীর জলে ভাসিয়ে দেবো মনে রেখো। বেরোও আমার বাড়ী থেকে।”
দারোয়ান দিয়ে ধাক্কা মেরে বাড়ীর বাইরে বার করে দিয়েছিলো। বেলা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। ফল হয়েছিলো উল্টো। টানা ছ’মাস ঘরের মধ্যে আটকে রেখে মেমারীর এক ধনীর দুলালের সাথে জোর করে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।
অদৃষ্টের কি পরিহাস! যে ভালোবাসার মানুষটি এতোদিন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিলো, এতোদিন পর বেলাশেষে আবার একটা নতুন পবিত্র সম্পর্কে বাঁধা পড়তে চলেছে।
চাওয়া-পাওয়ায় নয়, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়াও
যেন মনে হয় তার কাছে এক পরম প্রাপ্তি। অরুণের দেহ-মনে-প্রাণে বয়ে যায় এক অনির্বচনীয় আনন্দের শিহরণ।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিন তিনটে মাস। সুখবর। সৌম্য চাকরী পেয়েছে। কে.এম.সিতে
সে এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনীয়রের পদে কর্মরত। গত সপ্তাহে মহা ধূমধাম সহকারে অপরূপা+সৌম্যর বিয়েটাও নির্বিঘ্নে চুকে গেল। দুই পরিবারে এখন খুশীর হাওয়া।
মেয়েটা চলে যাবার পর থেকে কর্তা-গিন্নি দুজনের মনটাই বেশ ভারাক্রান্ত। কোনো কাজে মন বসছে
না। অরুণবাবু টেবিলে খাতা-পেন নিয়ে কি সাত- পাঁচ ভাবছে—অমনি তার মুঠোফোনটা বেজে
ওঠে। ফোনটার দিকে তাকিয়ে অরুণ একগাল হেসে বলে, “হ্যাঁ, বলো বেলা।
-উঁহু, বেলা নয়। এখন থেকে বেয়ান।
-তথাস্তু দেবী। বলো, কি বলবে!
-দুদিন ধরে মনের ভেতর কয়েকটা কথা কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে, বলবো বলবো করেও বলা হচ্ছে
না তোমাকে। এখন বলি।
-বলো।
-আমরা দুজনেই সমবয়সী। একই স্কুলে, একই কলেজে একই ক্লাসে আমরা দুজনে পড়াশুনা
করেছি। তোমার মনে আছে–আমরা দুজনে স্ট্যান্ড করতাম। কখনও তুমি হতে ফার্স্ট, কখনও
আমি। দুজনেই আমরা ফার্স্ট-সেকেণ্ডের মধ্যে থাকতাম। কখনও আমরা থার্ড হইনি। হায়ার সেকেণ্ডারীতে আমরা দুজনেই তিনটে বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশানে পাস করেছিলাম, তোমার মনে আছে অরুণ?
-বেশ মনে আছে।
-জানো সমবয়সী হয়েও ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমায় একবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে। তুমি মহান। আমার বিত্তশালী অহংকারী বাবা সেদিন যা পারেনি, আজ তুমি তোমার মেয়েটাকে আমার ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তুমি তাই করে দেখিয়েছো। আমি ধন্য তোমার লক্ষ্মী প্রতিমার মতো সুন্দরী বিদুষী মেয়েকে আমার ছেলের বৌ হিসাবে পেয়ে। এতোটুকু মিথ্যা নয়–সত্যি বলছি, অপরূপা মায়ের স্পর্শে আমার সংসার পেয়েছে নতুন জীবন। এই ক’দিনে ওর অকৃত্রিম ভালোবাসা আর সেবায় মনে হচ্ছে আমার অসুস্থ শরীর অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে। বলতে পারো অরুণ, বেলা শেষে বেলার এটা পরম প্রাপ্তি।
ফোনটা কেটে যায়।
———-