খিদে
– জয়তী মিত্র
ঝড়ের পর চার দিন কেটে গেছে। আজ ত্রাণ শিবির থেকে চাঁপা আর একমাত্র ছেলে বল্টুকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো পরান। ঘরের উঠোনের কাছে এসে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো পরান, আর চাঁপা। এতো কষ্ট করে জমানো টাকাতে ঘরের চালে টিন লাগিয়েছিল সেটা আজ দুমড়ে, মুচড়ে পাশের জমিতে পড়ে রয়েছে। এক্ষুনি কী করে এই টিন কিনবে? হাতে তো টাকা নেই।ভাগ্যিস কিছু দরকারী জিনিস,জামাকাপড় টিনের বাক্সটা করে নিয়ে গিয়েছিল, না হলে সেগুলোও যেত।
চাঁপা বললো,”কিছু টালি কিনে এখন সামাল দিতে হবে। না হলে বর্ষায় আরো খারাপ অবস্থা হবে।” “ভগবান খালি আমাদেরই মারে রে চাঁপা, আমরা গরীব, এটাই আমাদের অপরাধ। যাক আজকের রাতটা এই খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে দেই।কাল ভোর হলে বাবুদের বাড়ি থেকে পাওনা টাকাটা নিয়ে কিছু খাবার আর টালি কিনে নিয়ে আসবো। তুই চিন্তা করিস না।”
পরান একজন রিকশা চালক। খুব সহজ সরল মানুষ। কোনও নেশা নেই। খুব ভদ্র। সারাদিন রিকশা চালিয়ে আবার সন্ধ্যায় যায় মোড়ের মাথাতে ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করতে। সবসময় কি করে দুটো টাকা রোজগার করবে সেই চেষ্টা করে।
চাঁপা বলে, “তোর মত মানুষ পেয়ে মোর জীবন ধন্য রে।”
গতকাল রাত থেকে চাঁপার শরীর, মন কোনোটাই ভালো না। যার মাথাতে ছাদ নেই, পেটে ভাত নেই তার মন কি ভালো থাকে? পরান বলে, “মন খারাপ না করে বল্টুকে দু’মুঠো চিঁড়ে, গুড় খাইয়ে দে। আর দু’মুঠো শুকনো মুড়ি আমরা খাই।” চাঁপা মুড়িটুকু পরানকে দিয়ে নিজে জল খেয়ে বল্টুকে বুকে জড়িয়ে রাত কাটলো। সকালে উঠে বল্টুকে বললো,”বাবা, কাপড়ের আঁচলে বিস্কুট বাঁধা আছে খা। তোর বাবা খুব ভোরে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেছে, খাবার কিনে আনলে ভালো করে খাবি।”
বল্টু বললো, ‘তুমি কি খাবে মা? তোমার তো শরীর খারাপ, রাতে জল খেলে আমি দেখেছি।” চাঁপা বললো, “মায়েদের খিদে পায় না বাবা। আমার খিদে নেই..” বলতে,বলতে দু’চোখ জলে ভরে উঠলো।
বল্টু ভাবলো, বাবা কখন আসবে খাবার নিয়ে কে জানে, আমাকেই কিছু করতে হবে, না খেলে যে মার আরোও শরীর খারাপ হবে।
এই সব চিন্তা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বল্টু অনেক দুর গেল। তারপর পাকা রাস্তায় উঠে একটা দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই এক বয়ষ্কা মহিলা বেরিয়ে এলো। বল্টু বললো, “আমাকে কিছু কাজ দেবেন, টাকা দিতে হবে না, খাবার দিলেই হবে।”
ছেলেটাকে দেখে মহিলার খুব মায়া হলো। মহিলা ভাবলো, কতই বা বয়স হবে ছেলেটার এগারো, কি বারো। আমার নাতির বয়সী। ওকে দিয়ে কি কাজ করানো যায়?
বাচ্চাটাকে দু’টো রুটি আর তরকারি দিয়ে মহিলা বললো,”তোকে কিছু কাজ করতে হবে না বাবা, এই নে পঞ্চাশ টাকা রাখ, কিছু খাবার কিনবি, এখন রুটি দুটো খেয়ে বাড়ি চলে যা।’
বাচ্চাটা বললো, “আমাকে কাজ দিন। আমার মা বলেছে বিনা পরিশ্রমে কারোর থেকে কিছু নিতে নেই। কাজ করে তবে কিছু নিতে হয়।”
মহিলা বললো, “ঠিক আছে, আমার ছোটো বাগানটা তুই ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দে।” তারপর বাগান পরিষ্কার হলে বল্টু রুটি তরকারিটা প্যাকেটে ভরে নিল। মহিলা বললো, “তুই খেলি না।” বল্টু বললো,”আমার মা কাল থেকে কিছু খায় নি। মাকে খাবারটা দেব।” মহিলার দু’চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো, মনে মনে উনি ভাবলেন, বল্টুর মা খুব ভাগ্যবতী যে এমন ছেলে পেয়েছে, আমার ছেলে তো বছরে একটা ফোনও করে খোঁজ নেয় না।
মহিলা বল্টুকে রুটি দু’টো নিজের হাতে খাইয়ে ওর মায়ের জন্য আরো দু’টো রুটি তরকারি দিয়ে বললো,”যা মাকে গিয়ে দে গে। মা যে তোর অপেক্ষায় রয়েছে।”
বল্টু তারপর বাড়ি গিয়ে মাকে রুটির প্যাকেটটা তুলে দিল।” চাঁপা বল্টুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
আর বল্টু তখন রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ে মাকে খাওয়াতে লাগলো। মায়ের খিদে মেটানোর ব্যবস্থা করতে পেরে বল্টু খুব খুশি হলো।